রীতা। বয়স ২৮। সুন্দরী। মাত্র তিন বছর বিয়ে হয়েছে। স্বামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। কোনো সন্তান নেই। স্বামীকে কাজের জন্য প্রতি মাসেই বাইরে থাকতে হয়। রীতার হঠাৎ ডান পা অবশ হয়ে গেছে। হাঁটতে পারছে না। অনেক স্পেশালিস্ট দেখানো হল। সি.টি. স্ক্যান, এম.আর.আই হয়েছে। রক্তে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স কম ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি। ওকে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম দেওয়া হল। ঘুমের সমস্যার জন্য অ্যালপ্রাজোলাম দেওয়া হল। অনেকক্ষণ কথা বলার পর জানা গেল ছোট বয়স থেকে বাবা-মায়ের অত্যধিক আদরে বড় হয়েছে। বিয়ের আগে মায়ের সঙ্গে রাতে ঘুমোত। রাতে একা ঘুমোতে ভয় ভয় করে। স্বামীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কও খুব ভালো নয়। স্বামী অনিমেষ নিয়মিত ড্রিঙ্ক করে। তারপর উত্তেজিত হয়ে সহবাসের জন্য জোর করে। শৃঙ্গার প্রায় হয় না। ফলে রীতার শরীর ও মন তৈরি হয় না। মিলন নেহাত কষ্টদায়ক একটা যান্ত্রিক যৌনমিলনে পর্যবসিত। বিগত তিন বছরে কোনোদিন ‘রাগমোচন’ (অর্গাজম), অর্থাৎ যৌনমিলনের সময় চরম আনন্দ-অনুভূতি হয়নি।
ওর পায়ের অবশতা কোনো নার্ভঘটিত কারণে নয়, একে ‘কনভার্সন ডিসঅর্ডার’ বলা হয়। আগে একে “হিস্টিরিয়া’ বলা হত। রীতার ফিজিওথেরাপির সঙ্গে সাইকোথেরাপিও করা হয়েছে। তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলা হল। আস্তে আস্তে রীতার অবচেতনের ভয়, উৎকণ্ঠা কমতে শুরু করল।
সরমার বয়স ৪২। দুই সন্তানের জননী। স্বামী ব্যবসায়ী। সারাদিনই ব্যস্ত। শ্বশুর-শাশুড়ি ‘ নিয়ে সংসার। ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে শুরু করে সংসার – সবেরই দায়িত্ব। ইদানীং সরমার কাজে মন নেই। ভালো লাগে না। অল্পেতে মেজাজ হারিয়ে যায়, রাতে ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটছে। মাসিক ও অনিয়মিত হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের ওপর কথায় কথায় রেগে যায়। স্বামীকেও দু’চার কথা শোনাতে পিছপা হয় না। পরীক্ষা করে দেখা গেল রক্তে শর্করা বেশি, অর্থাৎ ডায়াবেটিস। থাইরয়েড হরমোন কম বলে থাইরক্সিন শুরু হল। ভাত, মিষ্টি খাওয়া কমাতে বলা হল। কথা বলে জানা গেল স্বামীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে । স্বামীও ব্যবসা ও টাকায় মত্ত। স্ত্রীরও যে একটা মন আছে, তারও চাহিদা আছে এসব কিছুই বোঝে না। বিয়ে হয়েছে, তিন বছরে দুটো সন্তান—আর কি চাই। সন্তান ধারণের জন্যেই শারীরিক মিলন, সন্তান হয়ে গেছে অর্থাৎ সহবাসের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে ! সরমার জীবনে শুধু কাজ। কর্তব্যপালনের দায়িত্ব। তার যে একটা নিজস্ব মন থাকতে পারে, যেখানে আবেগ, প্রেম-ভালোবাসা, হৃদয়ের উত্তাপ, এসব কিছুই তার আর নেই। স্বামীর মনে শুধু সিন্দুকের টাকা আর চাবি, লাভ আর লোকসান। সরমা ধীরে ধীরে হতাশার গভীরে ডুবে গেল। ডিপ্রেশন ডায়াবেটিসকে আরো তীব্র করেছে। সে এখন কতকগুলো পিল আর ক্যাপসুলে বন্দী।
রীতা, সরমারা আমাদের চারপাশের অতি পরিচিত মুখ। তাদের মনের কষ্ট, দুঃখ সব সময় সকলে বুঝতেও পারে না। বিশেষ করে জীবন সঙ্গী বা স্বামী অনেক সময় স্ত্রীর মনের খবর জানতে পারেন না। এখনও ভারতীয় সমাজে মেয়েদের অবস্থানের খুব হেরফের হয়নি। মেয়েরা সমাজে অনেক এগিয়েছে। শিক্ষা, কাজেকর্মে তারা পুরুষদের শুধু সমকক্ষই নয়, অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। কিন্তু কি গ্রাম, কি শহরে মেয়েদের যৌন ইচ্ছা, কামনা-বাসনা সব সময় সেভাবে গুরুত্ব পায় না। যৌন ইচ্ছা, যৌন মিলনের ব্যাপারে মেয়েরা খুব কম সময় এগিয়ে আসে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম এই মনোভাবে সবাই একমত। যৌন মিলনের ক্ষেত্রে স্ত্রী বাধ্য পার্টনার, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
“বিবাহ’মানে শুধুমাত্র সমাজ স্বীকৃত দৈহিক মিলনের ছাড়পত্র নয়। শরীর, মন ও আত্মার মিলনই প্রকৃত বিবাহ। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা, অলিখিত আনুগত্যের মধ্যে দিয়েই বিবাহ চিরন্তন হয়ে ওঠে। স্ত্রীর শরীরের প্রতি পুরুষের অধিকার জোর করে দেখাতে গেলে যৌনমিলন যান্ত্রিকতায় পরিণত হয়। যেখানে শুধুমাত্র যন্ত্রণা থাকে; প্রেম, রতিসুখ থাকে না। একথা স্বামীদের বুঝতে হবে। মাস্টার-জনসনের কথায়, যৌনমিলনের প্রথম পর্যায় হল ইচ্ছা বা ডিজায়ার। অনেক স্ত্রী এখানেই আঘাত পেয়ে থাকেন। পুরুষদের যৌন আবেগ তাৎক্ষণিক, হঠাৎ ইচ্ছে হলেই, চাই’। তখন স্ত্রী শরীর ও মনের দিক থেকে প্রস্তুত কি না বোঝার – জানবার সময় কোথায় ? কল্পনা করে, রঙিন কথা ভেবে, ছবি দেখে, বই পড়ে (সব সময় পর্নোগ্রাফি নয়) যৌনইচ্ছা বা আকাঙ্খার সৃষ্টি হয়। সফল যৌন সম্পর্কের জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। স্ত্রী মিলনের জন্য তৈরি হয়। এই শৃঙ্গার বা ‘ফোর প্লে’ খুবই জরুরি। না হলে জোর করে যৌন মিলনে উদ্যত হলে যোনিপথে সংকোচন হয়, যৌন মিলন স্ত্রীর কাছে অসম্ভব . যন্ত্রণাদায়ক ও ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে। এমনকী এর জন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি হয়ে পড়ে। অনেক সময় লুব্রিকেটিং জেল বা ব্যথা উপশমকারী মলম ব্যবহার করলে যন্ত্রণাদায়ক যৌনমিলন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যে কোনো পুরুষকেই মনে রাখতে হবে যাবতীয় যৌন কামনা-বাসনার উৎপত্তি মস্তিষ্কে, যৌন অঙ্গে নয়। সুতরাং মনের ইচ্ছে, মানসিক চাহিদা যৌনমিলনকে সুন্দর উপভোগ্য করতে সাহায্য করে। আবার মেয়েদের চাহিদার প্রকাশ অনেক সময় সরাসরি হয় না। মন চাইলেও মুখে বলতে পারে না। পুরুষ সঙ্গীকে এটা বুঝে নিতে হবে। অবশ্য তাতে অনেক সময় ভুলও হয়ে যায়। বলপূর্বক দৈহিক মিলন ধর্ষণের নামান্তর মাত্র। অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতা, ডায়াবেটিস, শ্বাসের কষ্ট প্রভৃতিতে মেয়েদের যৌন ইচ্ছা কমে যায়। পেলভিক ইনফেকশন, জননেন্দ্রিয়ের প্রদাহ, ইউরিনের ইনফেকশন হলে যৌনমিলন কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। আবার স্ত্রী দীর্ঘ অসুস্থতা ও স্বামীদের মিলন-বিমুখ করে তোলে। এর জন্য অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ জরুরি।
মহিলাদের যৌনতা, যৌনইচ্ছা যেমন মনের অবস্থা, অর্থাৎ আবেগ, অনুভূতি, মুক্ত বা মেজাজের ওপর নির্ভর করে তেমনই হরমোন অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, প্রোল্যাকটিন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। সন্তান প্রসবের পর শারীরিক কারণে দেড়-দু’মাস যৌনমিলন অস্বস্তিকর ও কখনও কখনও কষ্টদায়ক। সিজারিয়ান হলে পেটের কাটা অংশে ব্যথা থাকতে পারে, তেমনি স্বাভাবিক প্রসবেও অনেক সময় যোনিপথে সেলাই হয়, তাতেও ব্যথা, অস্বস্তি হতে পারে। এসব কিন্তু স্বামীকে বুঝতে হবে। এ সময় জোরাজুরি করা ঠিক নয়। আবার গর্ভাবস্থায় প্রথম তিনমাস যথেষ্ট সতর্কভাবে যৌনমিলন করা উচিত। কারণ আঘাতজনিত কারণে গর্ভপাত ঘটতে পারে।
যৌনমিলনের ব্যাপারে স্বামীর আচার-আচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় মদ্যপানের পর স্বামী উত্তেজিত হয়ে জোর করে সহবাসে লিপ্ত হতে চায়। যদিও যারা নিয়মিত মদ্যপান করে তাদের যৌনক্ষমতা অনেকাংশে কমে যায় । দৈহিক মিলনের ক্ষেত্রে স্বামীর ভালোবাসা, অনুরাগ বিশেষ প্রয়োজনীয়। স্ত্রীকে আগ্রহী করে তুলতে হলে বা মিলনকে আনন্দঘন করতে হলে স্ত্রীকে বুঝতে হবে। শুধুমাত্র স্বামীর অধিকার নয়, প্রেম ও ভালোবাসার অধিকারও দেখাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই সময়ের সাথে সাথে যৌনমিলন একঘেয়ে হয়ে পড়ে। স্ত্রীর কাছে কর্তব্যরক্ষা হয়ে ওঠে। এর জন্য মিলনে বৈচিত্র দরকার। মিলনের পদ্ধতির পরিবর্তন, সময় ও পরিবেশের পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়ে। মিলনের সময় প্রসাধনী সামগ্রী যেমন সেন্ট, পাউডার প্রভৃতি ব্যবহার করলে মিলনের পরিবেশই পাল্টে যায়। স্বামীকে স্ত্রীর মন, ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝতে হবে। এবং দৈনন্দিন জীবনে বৈচিত্র আনতে হবে। তাতেই চেনা স্ত্রীকে নতুন করে আবিষ্কার করা যাবে।