হাসিখুশি ঝকঝকে মানুষ তপনবাবু। পঞ্চাশোর্ধ বয়স। চেহারার গড়ন বেশ শক্তপোক্ত। রীতিমতো সুস্থ-সবল। ফুটপাতের দোকানে নিয়মিত যাতায়াত। পেটের অসুখকে এক্কেবারে ডোন্ট কেয়ার। অফিসে এই নিয়ে কম গলাবাজি করেননি।
কিন্তু একদিন হঠাৎই বুকে জ্বালা। সঙ্গে বমি। চটজলদি চিকিৎসা : অ্যান্টাসিড খেয়ে ফেলা। কিন্তু রেহাই কি মেলে? দুদিন পরে সেই একই ব্যাপার। অ্যান্টাসিডের বোতল একের পর এক শেষ হতে চলল। ফুটপাতের দোকানেও যাওয়া বন্ধ হল। বন্ধ হল মশলাদার খাবার।
কিন্তু রোগটা, সারলো না। চেহারা হল বিবর্ণ। প্রিয়জনেরা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে হলেন গ্যাসট্রো এন্টারোলজিস্টের শরণাপন্ন। দেখেশুনে ডাক্তারবাবু ওষুধ আর কিছু পরীক্ষার নির্দেশ দিলেন। সব পরীক্ষাও হল। কিন্তু এন্ডোস্কোপি করতে গিয়ে ধরা পড়ল মারণব্যাধি। তপনবাবুর পাকস্থলিতে ক্যানসার।
গল্পটা এখানেই শেষ হলে ভালো হত। ক্যানসারের একেবারে শেষ পর্যায়ে পৗঁছেছেন—আয়ু এখন হাতে গোনা। কিন্তু এটা গল্প নয়। তপনবাবু নন কোনো কাল্পনিক চরিত্র।
তাই হঠাৎ করে অম্বল ব্যাপারটা কিছুই নয়, এটা ভেবে বসবেন না। অম্বল বলে অবহেলা করবেন না চিকিৎসার ব্যাপারেও। উদাসীন থাকবেন না চিকিৎসকের পরামর্শে। কিংবা নিজেই চিকিৎসক হয়ে উঠবেন না। কিছুটা খাওয়া নিয়ন্ত্রণ আর: অ্যান্টাডিকে সঙ্গী করে রোগ পুষে, তার জটিলতা ও স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দেবেন না। আনবেন না কোনো মারাত্মক ব্যাধিকে ডেকে।
Table of Contents
কীভাবে হয় পরিপাক
আমাদের মুখের ভেতর স্যালাইভার গ্ল্যান্ডস আছে, ওই গ্রন্থির নিঃসৃত রসে শর্করা জাতীয় খাবার হজম করার এনজাইম বা উৎসেচক থাকে।ভালো করে চিবানো খাবার পাকস্থলিতে পৌঁছলে গ্যাসট্রিন হরমোনের প্রভাবে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নির্গত হয় এবং তার প্রভাবে প্রোটিন জাতীয় খাবার হজম করার জন্য পেপসিন আসে এনজাইমের সংস্পর্শে। অতএব স্বাভাবিক খাদ্য হজমের জন্য অ্যাসিড এবং পেপসিন খুবই জরুরি। এরপর খাদ্যমন্ড স্মল ইনটেস্টাইনে পৌঁছলে, সিক্রেটিন (Secretin) ও কোলোসিসটোকাইনিন (Cholecystokinin) -এই দুই হরমোনের প্রভাবে প্যাংক্রিয়াটিক জুস এবং বাইল বা পিত্ত নিঃসৃত হয়। এদের সাহায্যে পাকস্থলিতে নিঃসৃত অ্যাসিড নিউট্রালাইজড হয় বা তন্ন, পিত্ত বা বাইল এবং ডাইজেস্টিভ এনজাইম খুবই প্রয়োজন।
অতিরিক্ত অ্যাসিড খুব কম ক্ষেত্রেই নিঃসৃত হয়। সেরকম খুব কম ক্ষেত্রে প্যাংক্রিয়াস গ্ল্যান্ডের স্থায়ী ক্ষতি হলে এনজাইমের অভাবে হজমের গণ্ডগোল হতে পারে।
তবে পঞ্চাশ থেকে সত্তর শতাংশ লোক ।যে অম্বল’ রোগে ভোগেন, সেটা কোনো ‘সিরিয়াস গ্যাসস্ট্রো ইনটেস্টিনাল প্রবলেম’ নয় — ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম ডিসপেপসিয়া (নন-আলসার ডিসপেপসিয়া)।
অম্বল এর লক্ষণ
রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কিছু কিছু উপসর্গের মধ্য দিয়ে। অম্বলের উপসর্গ ডাক্তারি শাস্ত্র অনুযায়ী মোটামুটি তিনটি ভাগ—
- কখনও বুকে জ্বালাভাব। মুখ দিয়ে টক ঢেকুর। আবার কখনও গৃহীত খাদ্যবস্তুর মুখ দিয়ে উঠে আসা। সেইসঙ্গে থাকতে পারে গলাজ্বলা। এসমস্ত উপসর্গগুলোর ডাক্তার পরিভাষায় নাম রিফ্লাক্স ডিসপেপসিয়া (Reflux Dyspepsia)।
- আর একধানের লক্ষণ হল—পেটে ব্যথা, বিশেষত পেটের উপরাংশে এছাড়া খালি পেটেই বেশি ব্যথা অনুভূত হতে পারে, কিন্তু কিছু খেলে ব্যাথা বা ব্যাথার ভাব চলে যেতে পারে। যাকে বলে আলসার ডিসপেপসিয়া (Ulcer Dyspepsia)।
- আর একদল রোগী উপসর্গ হিসাবে বলেন, পেট যেন ফুলে গেছে, গলায় কিন্তু এটি যেন আটকে আছে সামান্য কিছু খেলেই অনেকক্ষণ আর ক্ষিদে থাকে না। আবার কিছু খেলেই গ্যাস হয়। একে বলা হয় মোটিলিটি ডিসপেপসিয়া (Motility Dyspepsia)।
অম্বল কেন হয়
পেপটিক আলসার
সাধারণত ডিওডিনাল আলসার আমাদের দেশে প্রধান রোগ। এই রোগ সাধারণভাবে কম বয়সে হয়। বেশি ভোগেন ধূমপায়ীরা। এর প্রধান কারণ হিসাবে এইচ পাইলোরিক ব্যাকটেরিয়া এবং এন. এস. এ. আই. ডি. জাতীয় ওষুধকে ধরা হয়, যেগুলির প্রভাবে পাকস্থলীতে গ্যাস্ট্রাইটিস হয়ে থাকে এবং পাকস্থলির আস্তরণ বা লইনিং দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে স্বাভাবিক পরিমান অ্যাসিডের উপস্থিতিতেও ক্ষতের সৃষ্টি হয়। গ্যাস্ট্রিক আলসার ততটা ব্যাপক নয়। সাধারণত বয়স্ক মানুষদের হয়ে থাকে। গ্যাস্ট্রিক আলসার হলেই সবসময় বায়োপসি করে ক্যানসার আছে কিনা দেখে নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
রিফ্লাক্স এসোফেগাইটিস
রোগীদের বুকজ্বালা, বুকব্যথা প্রধান লক্ষণ। পাকস্থলির অ্যাসিড খাদ্যনালীতে চলে এলে এই উপসর্গ দেখা দেয়। অনেক সময় খাদ্যনালীতে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে। এন্ডোস্কোপির সাহায্যে খাদ্যনালী, পাকস্থলি ও ডিওডিনাম দেখা হয়।
গলস্টোন
পিত্তথলিতে পাথর হলে ওপর-পেটে ব্যথা ছাড়াও গা-বমি ভাব, পেট ফুলে থাকা, খিদের অভাব ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।
প্যাংক্রিয়াটাইটিস
সাধারণত ক্রনিক প্যাংক্রিয়াটাইটিস রোগে ডিসপেপসিয়া আসতে পারে। এই রোগে প্রায় সবসময়ই ওপর পেটে খাবার পরে ব্যথা হয়ে থাকে।
আলট্রাসোনোগ্রাফি দ্বারা গলব্লাডার ও প্যাংক্রিয়াস পরীক্ষা করা যেতে পারে।
পরামর্শ: কী থেকে কী হতে পারে এটা যেমন জানা ভালো তেমন ভালো কেন হয় কিংবা লক্ষণ সমূহ। কিন্তু সবথেকে ভালো— জানার পর সচেতনতা। উপসর্গ দেখা গেলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। যাঁর চিকিৎসা করাই কাজ তাকেই ছেড়ে দিন চিকিৎসার দায়িত্ব। ভয় পাবেন না, আধুনিক চিকিৎসায় সব উপায়ই আছে। আছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে।
অ্যান্টাসিড কতটা জরুরি
আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে এমন কোন ওষুধ নেই যার কোনো না কোনো কিংবা কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। মনে রাখা উচিত, অ্যান্টাসিড অতিরিক্ত অ্যাসিডকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করে ঠিকই, কিন্তু তাতে অতিরিক্ত ক্ষরণের মূল কারণগুলির কিছুমাত্র উন্নতি ঘটে না।
অ্যাসিড খাদ্য পরিপাকে বিশেষ প্রয়োজনীয়। তাই ভারি খাওয়া দাওয়ার পরেই যারা পরম নিশ্চিতে অ্যান্টাসিড খান, তারা নিজেরাই হজমে বাধার সৃষ্টি করেন। তাই শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টাসিড খাওয়া উচিত। নিজে চিকিৎসক হয়ে ডেকে আনবেন না আরও কোনো কঠিন ব্যাধিকে। তবে কখনও সখনও অ্যাসিড তাড়াতে দু’-একটা অ্যান্টাসিড খাওয়া যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন, তা যেন আপনার প্রতিদিনের সঙ্গী না হয়ে ওঠে।
নিরাময়ের উপায়
ডাক্তারি মতে অম্বল কোনো একক রোগ নয়। পেটের নানান অসুখের লক্ষন মাত্র। যাদের খুব বেশি মাত্রার অ্যাসিড ক্ষরিত হয়, তাদের বিভিন্ন শারীরিক অসুবিধার সৃষ্টি হয়, কিন্তু যাদের ক্ষরণের মাত্রা স্বাভাবিক তাদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজনই হয় না।
ডিওডিনাল আলসার-গ্যাসট্রিক আলসারের কারণে অ্যাসিড হয়, তাহলে মূল রোগের নিরাময় হলেই অ্যাসিডের অসুবিধা উধাও। আধুনিক চিকিৎসায় ক্যানসার ছাড়া সবধরণের আলসারের নিরাময় সম্ভব। দরকার প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা, সর্বোপরি সঠিক চিকিৎসা।
এছাড়া ছোটোখাটো কিংবা সাধারণ কারণেও অ্যাসিডিটি হতে পারে। চেষ্টা করলে যার প্রতিরোধ আপনি নিজেই করতে পারেন। ওষুধ ছাড়াই। অন্য কোনো রোগের কারণে না হলে কিছু আচরণবিধি মেনে চললেই অম্বল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ব্যবস্থা নিন নিজেই
- ধূমপান ছেড়ে দিন। না পারলে যতটা সম্ভব কম করুন।
- মদ্যপান বন্ধ করুন। পেটে আলসার থাকলে একেবারেই নয়।
- কাপের পর কাপ চা না খেয়ে পরিমিত পরিমাণে পান করুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন। অভ্যাস করুন প্রাতঃভ্রমণ।
- অতিরিক্ত মশলাদার, মুখরোচক খাবার থেকে দূরে থাকুন। বন্ধ করুন অতিরিক্ত ভাজাভুজি। খাবার খান পরিমিত, সুষম ও সহজপাচ্য।
- দিনে চারবার খান। সকালে প্রাতরাশ, দুপুরে পেট ভরা খবার, বিকালে হাল্কা টিফিন আর রাত্রে পরিমিত খাবার। খাবারের সময়টা নিয়মিতভাবে মেনে চললে নিশ্চয়ই ভালো।
- রাতজাগা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন কোনো প্রয়োজনে অধিক রাত্রি জাগতে হলে, পরের দিন ঘুমিয়ে নিন।
- ঘরোয়া চিকিৎসা হিসাবে অনেকেই সকালে বেশি জল খেয়ে তা আবার বমি করে ফেলেছেন, যাতে অ্যাসিড না হয়। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ত্যাগ করুন অবিলম্বে। কেননা, জোর করে বমি করার ফলে ফুড পাইপের নীচের দিকে যে ভালভ আছে, তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাহলে পেটের গ্যাস অথবা অ্যাসিড সরাসরি বুকে চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিণতি কিন্তু বিপজ্জনক।
- আপনার খাদ্য তালিকায় রাখুন শাক -সবজি। সঙ্গে ডাল, মাছ, মাংস। তবে কোনোকিছুই অতিরিক্ত নয়।
- যে কোনো খাবার সঠিকভাবে চিবিয়ে খাবেন। কেননা আমাদের মুখ থেকে নিঃসৃত লাল। পাকস্থলীতে অম্লরস ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
- মনকে রাখুন সদা প্রফুল্ল। টেনশনমুক্ত হয়ে সমস্যার সমাধান করুন। স্রেফ মনের অশান্তি থেকে অম্বল হয় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষের।
জেনে রাখুন
- বুকে ব্যাথা মানেই অম্বল নয় যদি মনে হয় এটা অম্বলজাত ব্যথা নয়, তাহলে হাতেও পারে হার্টের কোনো সমস্যা। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে একদম দেরি করবে না।
- সকলেরই কিছু পরিমাণ অ্যাসিড বা অম্ল নিঃসরণ হয়, যা শরীরের পক্ষে প্রয়োজন। যেমন, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের উপস্থিতিতে পেপসিন এনজাইম প্রোটিন জাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে।
- আলসার হতে গেলে বিশেষত স্টমাক বা ডিওডিনামে দরকার অতিরিক্ত বা স্বাভাবিক মাত্রার ক্ষরিত অ্যাসিড। কিন্তু পাকস্থলির দেওয়াল থেকে কিছু পরিমাণ মিউকাস বা বাইকার্বোনেট বের হয়, যেগুলি পাকস্থলির কোষসমূহকে আলসারের হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু দেখা গেছে, কোনোরকম পেনকিলার, যেমন- অ্যাসপিরিন, ব্রুফেন ইত্যাদি ওষুধ পাকস্থলির দেওয়ালের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এবং এর ফলেই এই অবস্থায় স্বাভাবিক মাত্রার অ্যাসিডও পাকস্থলির দেওয়ালে ক্ষতের সৃষ্টি করে। এইভাবেই সৃষ্টি হয় গ্যাসট্রিক আলসার।
- এছাড়া পাকস্থলির দেওয়ালের ওপর হেলিকো ব্যাকটর পাইলোরি নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা গ্যাসট্রাইটিস সৃষ্টি করে। এর থেকে ভবিষ্যতে স্টমাক ও ডিওডিনামে আলসার হতে পারে।
মাথায় রাখুন
- গ্যাস-অম্বল মোটেই অবহেলা করার মতো সমস্যা নয়।
- হৃদরোগের সঙ্গে অম্বলের কোনো সম্পর্ক নেই।
- বেশি বয়সে হঠাৎ করে অম্বল মারাত্মক রোগের লক্ষণ হতে পারে। বয়স হলে সতর্ক থাকবেন।
- সামান্য অম্বল হওয়ার প্রবণতা জৈবিক ক্রিয়ারই অঙ্গ। তবে কথায় কথায় অ্যান্টাসিড খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
- পেপটিক, গ্যাসট্রিক ও ডিওডিনাল আলসার সঠিক চিকিৎসায় সহজেই সারিয়ে তোলা সম্ভব। কারণ যাইহোক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কোনও রোগই দুরারোগ্য নয়।
- ভুলে যাবেন না গ্যাস-অম্বল বহু ক্ষেত্রেই অন্য রোগের উপসর্গ।
- সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই নিরাময় সম্ভব।