কয়েক বছর আগে পুরসভার তরফ থেকে অভিযান চালানো হয়েছিল শহরের কয়েকটি নামী রেস্তোরাঁয়। সেখানে মিলেছে বাসি, পচা, ছত্রাকধরা খাবার। যা দেওয়া চলছিল খদ্দেরদের। আরশোলা, কেঁচোও পাওয়া গেছে রান্নাঘরে। আরশোলা, কেঁচো মেশানো খাবার খেয়ে নিলে কোনো ক্ষতি হয়তো হবে না, কিন্তু খাবারে যদি ব্যাক্টেরিয়া থাকে তাহলে কী হতে পারে, সে ব্যাপারেই এবার আমরা আলোচনা করব।
Table of Contents
খাবারে বিষক্রিয়া
খাদ্যে বা পানীয়ে ব্যাক্টেরিয়া অথবা ব্যাক্টেরিয়ার টক্সিন সংক্রমণের ফলে অথবা রাসায়নিক পদার্থ এবং উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ বিষ মিশ্রণের ফলে পেটের রোগের নানা উপসর্গ হঠাৎ দেখা দিতে পারে। এরকম বিষক্রিয়াকে ইংরেজিতে ডাক্তারি পরিভাষায় ফুড পয়জনিং বলে।
খাবারে বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে সাধারণ বিষয়গুলো থাকে, তা হল –
- একই খাবার অনেকে খেয়েছে এরকম ইতিহাস থাকে ৷
- একই সময়ে প্রায় সকলেই আক্রান্ত হয় ।
- সকলেরই প্রায় একই উপসর্গ ও লক্ষণ থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গ্রামবাসী সকলে মিলে কোনো পুজোর প্রসাদ খাওয়ার পরে একই রকম উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে প্রায় সকলেই হাজির হয়ে যায়।
খাবার থেকে বিষক্রিয়া মূলত চারধরনের হয়। ব্যাক্টেরিয়ার নাম হিসেবে খাবারে বিষক্রিয়াকে চার ভাগে ভাগ করা হয়—
- সালমোনেলা থেকে সংক্রমণ।
- স্টাফাইলোকক্কাস থেকে সংক্রমণ।
- ক্লসট্রিডিয়া থেকে সংক্রমণ।
- ব্যাসিলাস সেরেয়াস থেকে সংক্রমণ।
সালমোনেলা সংক্ৰমণ
বর্তমানে এই জীবাণু সংক্রমণ থেকে খাবারে বিষক্রিয়ার সমস্যা খুবই বেড়ে গেছে। এর কারণগুলো হল—
- বিভিন্ন কারণে ভোজসভা বা সম্মিলিত খাওয়া-দাওয়ার বাড়-বাড়ন্ত।
- আন্তর্জাতিক ব্যবসার প্রসারের ফলে এক দেশের খাবার অতি দ্রুত অন্য দেশে পৌঁছে যাওয়া।
- চটজলদি পাওয়া যায় এমন তৈরি খাবারের বহুল প্রচলন।
- হাঁস, মুরগিতে সালমোনেলার সংক্রমণ বৃদ্ধি।
সংক্রমণের বৈশিষ্ট্য :
সাধারণত সংক্রামিত মাংস, দুধ, মেয়োনিজ, ক্রিম, সসেজ, কাস্টার্ড, ডিম ও ডিম থেকে তৈরি খাবার থেকে সংক্রমণ ঘটে। এরকম সংক্রামিত খাবার খাওয়ার বারো থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণত হঠাৎ শীত শীত ভাব, জ্বর, বমি, বমিভাব এবং জলের মতো পাতলা পায়খানা, সালমোনেলা সংক্রমণের লক্ষণ। দু’-তিনদিন এই উপসর্গ চলতে পারে।
স্ট্যাফাইলোকক্কাস ঘটিত সংক্রমণ
স্ট্যাফাইলোকক্কাস মানুষের ও অন্য প্রাণীদের চামড়ায়, নাকে, গলায় থাকে। এই ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফোঁড়া হয়। সাধারণত সংক্রামিত গরুর দুধ, দুধ থেকে তৈরি কাস্টার্ড, মেয়োনিজ, ক্রিম এবং স্যালাড থেকে এই সংক্রমণ হয়ে থাকে। খুবই সাধারণ খাবার থেকে স্ট্যাফাইলোকক্কাস সংক্রমণ হয়। ৩৫–৩৭° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই টক্সিন খাবারে তৈরি হয়। খাবার আধঘণ্টা ধরে গরম করার পরেও এই টক্সিন থেকে যেতে পারে। এই বিষক্রিয়ায় জ্বর সাধারণত হয় না। বমি, পেটেব্যথা, জলের মতো পায়খানা, খাবার খাওয়ার এক থেকে ছ’ঘণ্টার মধ্যে শুরু হয়ে যায়।
ক্লসট্রিডিয়া ঘটিত সংক্রমণ
মাংসের কোনো পদ খাওয়ার পর এই ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ হয়। সাধারণত দেখা যায় যে মাংস রান্নার পর চব্বিশ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। এরপর খাওয়ার আগে আবার গরম করা হয়েছিল। তার থেকেই এই সংক্রমণ। এক্ষেত্রে ৩০ – ৪০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটে ও বিভিন্ন ধরনের টক্সিন তৈরি হয়। এই সংক্রমণে ছয় থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রোগের উপসর্গ যেমন পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা দেখা দেয়। জ্বর সাধারণত থাকে না। উপসর্গগুলো একদিন স্থায়ী হয়।
ব্যাসিলাস সেরেয়াস ঘটিত সংক্রমণ
ফ্রায়েড রাইস, আইসক্রিম, রান্না করা মুরগির মাংসে টক্সিন তৈরি হলে এই ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ হয়। এক্ষেত্রে খাবার খাওয়ার ছয় থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সংক্রমণ ঘটে। উপসর্গগুলো হল বমি, পাতলা পায়খানা, পেটেব্যথা ইত্যাদি ।
খাবারে বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে কী কী সতর্ককা নেওয়া দরকার
- অসুস্থ বা সংক্রামিত প্রাণীর মাংস, দুধ না খাওয়াই ভালো।
- বাড়িতে ও রেস্তোরাঁর রান্নার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের পোশাক ও শারীরিক পরিচ্ছন্নতা জরুরি।
- রান্নার জায়গায় পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে, বাড়িতে ও অন্য জায়গায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের তদারকি প্রয়োজন।
- ডায়রিয়া, ডিসেনট্রি, আমাশা, গলা ও চামড়ায় সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খাবার তৈরির কাজের সাথে যুক্ত না রাখাই শ্রেয়।
- ইঁদুর, মাছি, আরশোলার উপদ্রব থেকে রান্নার জায়গাকে মুক্ত রাখতে হবে।
- অধিকাংশ ব্যাক্টেরিয়া ৬০o সেলসিয়াসের ওপরের তাপমাত্রায় মারা যায়। সেজন্য খাবার ভালোভাবে গরম করে নিতে হবে। আগে তৈরি করা খাবার গরম করার সময় ভেতরের অংশ ঠিকমতো গরম হচ্ছে কিনা তা দেখে নিতে হবে।