Thursday, January 23, 2025
Homeস্বাস্থ্য পরামর্শস্বাস্থ্যসম্পর্কিত খবরশুক্রাণু কম থাকলেও এখন বাবা হওয়া সম্ভব | Male Infertility Treatment in...

শুক্রাণু কম থাকলেও এখন বাবা হওয়া সম্ভব | Male Infertility Treatment in Bengali

রজত আর লীনার তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী আজ। সকাল থেকে অজস্র ফোন আর এস.এম.এস- এ শুভেচ্ছার বন্যা। কিন্তু লীনা মন খুলে হাসতে পারছে না। কারণ প্রত্যেক শুভার্থীর সেই একই প্রশ্ন, ‘তোমরা কবে তৃতীয়জন হচ্ছ’? লীনা ভাবে তার একার পক্ষে কি সন্তানকে পৃথিবীতে আনা সম্ভব? রজত মনে করে তার কোনো সমস্যা নেই, দরকার মনে হলে লীনা ডাক্তার দেখাক।

সন্তান ধারণে কোনো সমস্যা দেখা দিলে আজও অভিযোগের আঙুলটা প্রথম ওঠে মেয়েদের দিকে। অনেকেই বুঝতে চায় না সন্তান ধারণ মেয়েদের কাজ হলেও সন্তান আসার পিছনে পুরুষদের একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। দেখা গেছে ইনফার্টিলিটি সংক্রান্ত সমস্যায় যে সব দম্পতি ভুগছেন তাদের মধ্যে সাধারণত পুরুষরাই দায়ী থাকে শতকরা চল্লিশ ভাগ।

স্পার্ম কাউন্ট এবং স্পার্ম মর্টালিটি পুরুষের যৌন সক্ষমতার এক বিশেষ পরিচায়ক। একটি বেবিকে তৈরি করতে লাগে স্ত্রীর ডিম্বাণু আর স্বামী দেয় স্পার্ম, এই দুইয়ের মিলনেই বেবি আসে। স্পার্ম থাকে পুরুষের সিমেনে। যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্তানকে পৃথিবীতে আনার জন্য।

প্রেগন্যান্সি আনার জন্য জরুরি হল স্পার্ম । স্পার্মে তিনটে জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে একটি হল সংখ্যা, দুই স্পার্মের গঠন অর্থাৎ স্পার্ম থাকলেই হবে না স্বাস্থ্যকর বা হেলদি স্পার্ম চাই আর তিন হল স্পার্মের মুভমেন্ট। যথেষ্ট মুভমেন্টযুক্ত স্পার্ম থাকতে হবে।

স্পার্মের সংখ্যা কত হতে হবে, 

এর একটা মাপ ঠিক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’। তারা প্রথমে বলত একশো মিলিয়ন হচ্ছে নর্মাল । কিন্তু সারা পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছে যে, ছেলেদের মধ্যে স্পার্মের সংখ্যা কমে আসছে। বিভিন্ন ধরনের কারণ এর জন্য দায়ী। তার মধ্যে প্রাকৃতিক কারণ ও জীবনশৈলীর কারণও রয়েছে।

বর্তমানে ‘ছ’ বলছে কুড়ি মিলিয়ন নর্মাল। কারণ একশো মিলিয়ন স্পার্ম পাওয়াই যাচ্ছে না তাই কুড়ি মিলিয়নকেই নর্মাল বলা হয়েছে। কুড়ি মিলিয়নের কম স্পার্ম থাকলে ওলিগো স্পার্মিয়া বলা হয়।

ওলিগোস্পার্মিয়া তিন ধরনের হয়, যেমন মাইল্ড, মডারেট এবং সিভিয়ার। মাইল্ড হল কুড়ি মিলিয়নের কম। মডারেট হল দশ মিলিয়নের কম আর সিভিয়ার হল পাঁচ মিলিয়নের কম। আর খুব বেশি সিভিয়ার হল এক মিলিয়নেরও কম।

যদি মাইল্ড হয় প্রথমে স্বামীকে পরীক্ষা করে দেখা হয় তার ডায়াবেটিস ও থাইরয়েডের সমস্যা আছে কি না। সোনোগ্রাফি করে দেখা হয় টেস্টিসে যেখানে স্পার্ম তৈরি হয়, সেখানে কোনো ভেরিকোসিল বা রক্ত জমাট বেঁধে আছে কি না। বিভিন্ন কারণ খুঁজে বার করার চেষ্টা করা হয় কম স্পার্মের জন্য। কারণ কিছু পাওয়া গেলে, সে ডায়াবেটিস হোক বা থাইরয়েড, তার চিকিৎসা করাতে হয়।

যারা স্মোকিং করেন তাদের স্মোক কম করতে বলা হয়। যারা ফার্নেসের সামনে বা আগুনের সামনে কাজ করেন, গরম মেশিন কিংবা উনুনের সামনে কাজ করেন তাদের টেস্টিস স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে যায়। স্পার্মটা যেহেতু টেস্টিসে তৈরি হয় তাই স্পার্মের সংখ্যাটা কমে যায়। যারা ল্যাপটপ কোলের ওপর রেখে কাজ করেন, যদি টেস্টিসের কাছে থাকে তাহলে ছোঁয়া লেগে গরমের ফলে তাদেরও স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়। এইজন্য এদের জীবনশৈলীর পরিবর্তন করতে বলা হয়। জীবনশৈলীর পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু ওষুধ আছে যা দিয়ে স্পার্ম কাউন্টটা বাড়ানো যায়। স্পার্ম কাউন্ট কুড়ি মিলিয়নের ওপরে গেলে স্বাভাবিক মেলামেশা করে কনসিভ করানো সম্ভব।

3d image of sperm cells

মডারেটের চিকিৎসাও একইরকম হবে । কিন্তু মাইল্ড এর বেলায় যেমন আশাপ্রদ ফল পাওয়া যায়, মডারেটে অত আশাপ্রদ ফল পাওয়া যায় না। কারণ তার সংখ্যাটা আরো কম। সিভিয়ারের ক্ষেত্রে এই ধরনের চিকিৎসা করে তেমন কোনো লাভ হবে না। কারণ তার প্রোডাকশন খুব কম। তাই এক্ষেত্রে তাকে কৃত্রিম উপায়ে প্রেগনেন্সি আনতে হবে। সেই উপায়টা হল আই.ইউ.আই অর্থাৎ ইন্ট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনেশন। এই পদ্ধতিতে কোনো মহিলাকে ওষুধ দিয়ে এগ তৈরি করা হয়। স্বাভাবিকভাবে কোনো মহিলার মাসে একটা এগ তৈরি হয় কিন্তু এখানে ওষুধের সাহায্যে দুটো কি তিনটি এগ তৈরি করা হয়, যাতে চান্স অফ প্রেগনেন্সিটা বেশি থাকে। ওষুধ দিয়ে ডিম তৈরি করার পর একদিন অন্তর অন্তর ক’টা ডিম তৈরি হল সেটা দেখে নেওয়া হয়। সাইজ কেমন হল সেটাও পর্যবেক্ষণ করা হয়। এবার ইঞ্জেকশন দিয়ে সেই ডিমটাকে ফোটানো হয়। যেদিন ডিমটা ফোটানো হল। সেদিন মহিলার স্বামীর কাছ থেকে সিমেন সংগ্রহ করে একটু শোধন করার পর স্ত্রীর ইউটেরাসের মধ্যে সিমেনটা দিয়ে দেওয়া হয়। যেটা মেলামেশা করে হত সেটা কৃত্রিম উপায়ে করা হয়। এর নাম ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন, মানে ইউটেরাসের ভেতর সিমেন প্রবেশ করানো। এই পদ্ধতিতে দেখা গেছে শতকরা বাইশ থেকে পঁচিশ শতাংশ ক্ষেত্রে সফলতা আসে। বার বার সোনোগ্রাফি করতে হয় এই পদ্ধতিতে। কারণ ডাক্তারবাবু যদি বুঝতে না পারেন ডিমটা কখন ফুটবে তাহলে সিমেনটা প্রতিস্থাপন করবেন কীভাবে।

প্রথমবারে সাফল্য নাও আসতে পারে। সে কারণে একাধিক বার প্রয়োগ করতে হতে পারে ‘এই পদ্ধতি। তাই এ ব্যাপারে রোগীর কাউন্সেলিং টা জরুরি। মনে রাখতে হবে প্রথমবারে সাফল্য না এলেও হতাশ হবার কোনো ব্যাপার নেই ।

মডারেট বা মাইল্ডেও যদি ওষুধ দিয়ে স্পার্ম কাউন্ট বাড়াতে না পারা যায় তাহলে আই.ইউ.আই পদ্ধতিতে আসতে হবে।

যদি পাঁচ মিলিয়নেরও কম হয় স্পার্ম কাউন্ট তাহলে আই.ইউ.আই পদ্ধতিতে হবে না। তখন টেস্ট টিউব পদ্ধতির সহায়তা নিতে হবে। যাকে বলা হয় আই.ভি.এফ

আই.ভি.এফ-এ ওষুধের দ্বারা মহিলার শরীরে একাধিক ডিম তৈরি করা হয় এবং সোনোগ্রাফির গাইডেন্সে সেই ডিমটা বার করে নিয়ে আসা হয় ল্যাবরেটরিতে এবং কালচার মিডিয়াতে সেটা রাখতে হয়। এবার ল্যাবরেটরিতে পেট্রি ডিশে ডিম্বাণুর সঙ্গে স্পার্মকে মিলিত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। সেই ভ্রূণকে মহিলার ইউটেরাসে স্থাপন করা হয়, একে বলে আই.ভি.এফ পদ্ধতি।

স্পার্মের সংখ্যা যাদের এক মিলিয়নেরও কম তখন ইকসি নামক পদ্ধতির সাহায্যে বাবা হওয়া সম্ভব। ইকসিতে স্পেশাল মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ডিম্বাণুটাকে ধরে তার মধ্যে একটা স্পার্মকে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এটা আরো উন্নত পদ্ধতি।

তাহলে সংক্ষেপে বলা চলে, যদি স্পার্ম কাউন্ট কুড়ি মিলিয়নের কম মানে দশ থেকে কুড়ি মিলিয়ন হয়, সেটা হল মাইল্ড। তারা নিজেরা চেষ্টা করবে ওষুধের দ্বারা। দশ থেকে পাঁচ মিলিয়ন হল মডারেট, নিজেরা চেষ্টা করবে, ওষুধ থাকবে, যদি স্পার্ম কাউন্ট না বাড়ে তাহলে আই.ইউ.আই পদ্ধতি গ্রহণ করবে। যদি পাঁচ থেকে এক মিলিয়ন হয় তাহলে আই.ভি.এফ পদ্ধতি গ্রহণ করবে। যদি এক মিলিয়নেরও কম হয়, দেখা গেল পঞ্চাশ হাজার বা কুড়ি হাজার আছে, সেক্ষেত্রে ইকসি পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয় ।

এমন অনেক পুরুষ আছেন তাদের সিমেন বা বীর্যে একটিও শুক্রাণু পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থাকে বলে ‘অ্যাজো স্পার্মিয়া’। এদের ক্ষেত্রে দুটো কারণ হতে পারে। স্পার্ম তৈরি হচ্ছে কিন্তু প্যাসেজে কোথাও একটা ব্লক থাকার জন্য বাইরে আসতে পারছে না। আর দ্বিতীয় কারণ হল তৈরিটাই কম হচ্ছে।

স্পার্ম তৈরি হচ্ছে কিন্তু প্যাসেজে আসতে পারছেনা সেক্ষেত্রে টেস্টিসে স্পার্ম পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে একটা সিরিঞ্জ দিয়ে বার করে আনা হয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে খুব সামান্য পরিমাণে তৈরি হচ্ছে। যেখানে কুড়ি মিলিয়ন পাওয়া উচিত সেখানে দশ থেকে পনেরোটা পাওয়া গেল। দুই ক্ষেত্রেই সিমেনে স্পার্ম না পাওয়া গেলেও টেস্টিস থেকে নেওয়া যেতে পারে। একটা স্পার্ম দরকার। সেই স্পার্মটাকে নিয়ে ইকসি পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব।

যেহেতু ইকসিটা খরচসাপেক্ষ, যাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে ডোনার-এর সিমেন নিয়ে করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আই.ইউ.আই করা হল কিন্তু স্বামীর বীর্য নয়, অন্য পুরুষের বীর্য কিনতে হবে। এদের বলা হয় আই.ইউ.আই ডোনার সিমেন

এক্ষেত্রে স্বামীর ক্যারেক্টার মিলিয়ে সিমেন নেওয়া হয়। ডোনারের কোনো পরিচয় থাকে না। ডোনারও জানবে না কে সিমেন পেল । যে সিমেন পেল সেও কোনোদিন জানতে পারবে না কে ডোনার। কিন্তু ক্যারেক্টারিস্টিক মিলিয়ে দেওয়া হয় তার স্বামীর মতো করে। হাইট, চুল, গায়ের রঙ, শিক্ষা, চোখ সব কিছু মিলিয়ে দেওয়া হয়। এইসব জিনিস দেখে সিমেন বাছা হয়।

এরপর আছে অ্যাডাপশন । যে কোনোভাবে খরচা জোগাতে পারছে না বা কোনোমতেই যাদের বাচ্চা এল না তারা অ্যাডাপশন করতে পারে কোনো বাচ্চা।

স্পার্ম ঠিকমতো তৈরি হলেও তা কার্যকর হবে কি না তা নির্ভর করে যে প্যাসেজ দিয়ে বেরোনোর কথা সেগুলো ঠিকমতো খোলা আছে কি না তার ওপর। এছাড়া কোনো সংক্রমণ বা আঘাতের ফলে এই পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এসব কারণ ছাড়াও স্পার্ম কাউন্ট কমে যায় বিশৃঙ্খল জীবন যাপন, বেশি মদ্যপান ও ধূমপানের কারণে।

স্পার্ম তৈরি হয়ে বেরোতে মোট বাহাত্তর দিন সময় লাগে, তাই একটা সিমেন অ্যানালিসিস দেখে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া বা হতাশ হওয়া অনুচিত। ‘অ্যাংজাইটি, টেনশন, মানসিক চাপ সব কিছুই ইনফার্টিলিটির কারণ। ডিপ্রেশনের ওষুধ নিয়মিত খেলে স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়। সবশেষে একটা কথা বলা দরকার লাইফ স্টাইল পরিবর্তনের জন্য ইনফার্টিলিটি দিন দিন বাড়ছে। তাই লাইফ স্টাইল সব সময় হেলদি রাখুন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular