Tuesday, September 17, 2024
Homeস্বাস্থ্য পরামর্শস্বাস্থ্যসম্পর্কিত খবরসামাজিক অবক্ষয়ের ক্যান্সারে ধুঁকছে আজকের সমাজ

সামাজিক অবক্ষয়ের ক্যান্সারে ধুঁকছে আজকের সমাজ

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পশুর মনোভাব থেকে মানবিকভাবের উত্তরণ ঘটলো। তখন মানুষ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভালভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝতে শিখল কোনটা তার করণীয় আর কোনটা তার করণীয় নয় এবং তার কার্যকারিতা কতটা পৰ্য্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তার সম্যক জ্ঞান অর্জন করল। ধীরে ধীরে সেই জ্ঞানের গভীরতায় ডুবে নিজেকে পরিপক্ক করল। মানুষ বুঝতে শিখল তার আপনজন কে বা কারা এবং শত্রু কে তা চিহ্নিত করার দূরদৃষ্টি লাভ করল। মানুষ তখন নিজের মনোভাবের লোক খুঁজে গোষ্ঠী তৈরি করল। ধীরে ধীরে নিজের মগজ প্রসূত চিন্তা ধারায় নিত্যনতুন কল্যাণ মূলক কাজে নিজেকে সামিল করে অন্যকে সামিল করল। সৃষ্টি হল প্রেমের আকুলতা, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং তার পাশাপাশি মনের মধ্যে জন্ম নিল হিংসা বিদ্বেষ, শত্রুতা, প্রভুত্ব এবং দাসত্ব বোধ। জন্ম হল সমাজের চারটি শ্রেণীর, ব্রাহ্মণ,বৈশ্য, ক্ষত্রিয় এবং শূদ্র। এই চারিটি শ্রেণীর মধ্যে ধীরে ধীরে সামাজিক দায়িত্ব অর্পিত হল। কিন্তু এই শ্রেণীর মধ্যে জন্ম নিল জাত পাত। এই জাত পাতের মধ্যে চোরা স্রোতের মত প্রবাহিত হল কুসংস্কার। এর ফলে চারটি শ্রেণীর মধ্যে মতাদর্শের ঐক্য লোপ পেল। ফলে সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে চলতে থাকল অধিকার বোধের প্রতিযোগিতা।শুরুহল ক্রমবর্ধমান অর্ন্তদ্বন্দ্ব এবং অন্তর্কলহ। পরে সেই স্তর পেরিয়ে লড়াইয়ের মাধ্যমে চোরা গুপ্ত হত্যা ও কিডন্যাপ করার প্রবণতার জন্ম। যে দুর্বল তার উপর চলল অত্যাচার এবং পেশী বলের সাহায্যে সেই দুর্বল শ্রেণীর অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হল। এক শ্রেণীর লোকেদের হাতে এল সম্পদ। তারা তাদের অর্থ ও সম্পদ বৃদ্ধি করার প্রয়াসে নানান রকমের অপকৌশলের পথ বেছে নেয়। সামাজিক নিয়মের রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাদের লোভ চরিতার্থ করে। সাধারণ ছা-পোষা মানুষ তাদের শোষণের শিকার হয়। প্রতিবাদ করতে গেলে তার ভাগ্যে জোটে খুন। ধর্ষণ এবং হয়রানি। এই ব্যাপারটা প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে। তখন যেভাবে দুর্বল শ্রেণীকে অত্যাচার করা হত এখন তার ধরন পাল্টেছে। কিন্তু মুল জিনিষটা রয়ে গেছে আজও।

কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি আজও প্রবহমান। প্রতিরোধের কোন উপায় থাকলেও কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্য যথাযথ ভাবে তা প্রয়োগ করা যায় না। কারণ সেইসব মানুষ রাজনৈতিক দলের নেতা হয়ে বা মন্ত্রী হয়ে ধামা চাপা দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে। এই ধামা চাপা দেওয়ার একটা কৌশল হচ্ছে তদন্ত কমিশন। এই তদন্ত কমিশন কাদের দিয়ে গঠিত হয়? যাদের নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠিত হয় তারা হলেন সেই নেতা বা মন্ত্রীর প্রতিভূ। মানুষের ক্ষোভের আগুনের আঁচ পেয়ে রাতারাতি কমিশন বসানোর প্রক্রিয়া চলে। তার ফলাফল কবে যে প্রকাশ পাবে তা স্বয়ং ভগবানেরও জানা নেই। সামাজিক অবক্ষয়ের প্রক্রিয়া শুরু কিন্তু এখন থেকে হয়নি। বরং বলা যায় অনেক আগের থেকেই এর ক্ষয়ের সূচনা শুরু হয়ে যায়। অবক্ষয় আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে। যেমন ধরা যাক, শিক্ষার ক্ষেত্র। এই মহৎ পেশায় যারা যুক্ত তারা কি তাদের দায়িত্ব ঠিক ঠিক ভাবে পালন করেন? শিক্ষক শিক্ষিকারা তাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দানের আন্তরিকতার দৈন্যতা স্বীকার করেন? স্কুলে কলেজে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর সিলেবাস শেষ করার কোন উদ্যোগ না নিয়ে তারা কোচিং ক্লাস, প্রাইভেট টিউশন পড়ানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেষ্ট। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তাদের দায়িত্ব পালন না করে নিজেদের বেশী বেশী করে অর্থ রোজগারের লালসা চরিতার্থ করেন প্রাইভেট এবং কোচিং ক্লাসের মধ্যে দিয়ে। ফলে ছাত্রসমাজ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা কি কখনও ভেবে দেখেন? যে রাজনৈতিক দলই শাসন ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা তাদের কাজ চালিয়ে যান। হাজার হাজার টাকার পারিশ্রমিক নিতে তাদের হাত কাঁপে না। ছাত্র সমাজকে তৈরী করার সামান্য মানসিকতা তাদের নেই। সবার মূলে রয়েছে যেনতেন প্রকারে বিত্তবান হওয়ার মানসিকতা। অর্থলিপ্সার আগুনে তাদের বিবেক বুদ্ধি সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ওই একই অবস্থা। সাধারণ গরীব মানুষের চিকিৎসা যথাযথভাবে হয় না। হাসপাতালে ওষুধ রক্ত কিছুই পাওয়া যায় না। সেখানে ওষুধপত্র আসার আগেই সমস্ত নার্সিংহোমে চালান হয়ে যায়। এক্সরে করার ফিল্ম পাচার হয়ে যায় রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন নার্সিং হোমে বা প্রাইভেট হাসপাতালে। টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে বেড পাওয়া সহজ লভ্য হয়, কিন্তু যাদের অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাদের জায়গা হয় মাটিতে। দিনের পর দিন এই অবস্থা চলছে। এর প্রতিকার কে করবে? এই মানুষগুলোর মনের পর্দায় কি কখন দাগ কাটে না ?

এইবার কৃষিক্ষেত্রের প্রসঙ্গে বলা যায় চাষিরা তাদের শস্য উৎপাদনে যে পরিশ্রম করেন সেই অনুযায়ী অর্থ রোজগার তাদের হয় না। দালালেরা অর্থাৎ ফোড়েরা কম দামে চাষিদের কাছ থেকে উৎপাদিত ফসল কিনে চড়া দামে বিক্রি করে অর্থ রোজগার করেন। সরকার যদি সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে সংগ্রহ মূল্য বেশী না দেয় তাহলে কৃষিক্ষেত্রে বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে। আগে ফোড়েদের না হঠালে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শিল্পক্ষেত্রে গরীব মানুষের ফসলি জমিতে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগের ফলে চাষিরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে তাদের জমি ক্রয় করার প্রয়াসে কোন নিয়ম নীতি মানা হয়নি। গরীব মানুষকে ভয় দেখিয়ে স্বল্প মূল্যে জমি অধিগ্রহণ করে। সেখানে প্রতিবাদ না করলে গরীব মানুষের সর্বনাশ ঘটে যেত। রাজার হাটে লেঠেল বাহিনী পাঠিয়ে জমি কেড়ে নেওয়া হয়। এই প্রবঞ্চনা প্রতারণা চলতেই থাকত যদি মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার না হত।

এর পরে চলে আসতে হয় সামাজিক সম্পর্কে। এই সমাজে মা-বাবার স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। যাঁরা সন্তানকে বুকে আগলে মানুষ করে বড় করেছেন। সেই সন্তানেরা নিজেদের কর্তব্য না করে তাদের মা-বাবাকে পাঠিয়ে দেয় বৃদ্ধাশ্রমে। এমনও দেখা গেছে নিজের মা-বাবাকে রেল স্টেশনের চত্বরে বসিয়ে রেখে আসছি বলে আর আসে নি। সেই বৃদ্ধ বাবা, মা রাস্তায় ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির সাহায্য নেয়। আজ বাবা, মা সংসারে বোঝা। সুতরাং সেই বোঝা সন্তানের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। এই সমাজে এই ধরনের কার্যকলাপে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে সন্তানেরা। দয়া, মায়া, ভালবাসা সব কৃত্রিম। এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে মানুষের মূল্যায়ন হয় গাড়ি বাড়ি অর্থ প্রতিপত্তির হিসাব কষে। সুকুমার বৃত্তিগুলো এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনুশোচনা, অনুতাপ বলতে কিছুই নেই। ধীরে ধীরে সংসারে ভাই ভাইকে খুন করছে বাবা মাকে ঘর থেকে জোড় করে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে একই কারণে। সেই কারণ অর্থ, সম্পত্তি।

যে সমস্ত সন্তানেরা এই কাজ করছে তারা একবারও ভাবে না তাদেরও অবস্থা একদিন এরকমই হবে। ধীরে ধীরে সামাজিক সম্পর্ক হারিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে চললে অচিরেই সুস্থ সামাজিক সম্পর্কের কাঠামো ভেঙ্গে চূড়মার হয়ে যাবে। যাচ্ছেও তাই। মানবিক দিকটা ক্রমে ক্রমে ধ্বংস হয়ে এক যান্ত্রিক সভ্যতায়। মানুষ নিজেকে সঁপে দিচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা এই অবস্থার কারণ কি তা বলতে পারছেন না। বলতে পাচ্ছেন না এই অবক্ষয়ের শেষ কোথায় ? সমাজটা কি এইভাবে চলবে। তার কি কোন পরিবর্তন হবে না? যারা আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ তাঁরা বলছেন এই যুগ ঘোর কলিযুগ। এই ঘোর কলিযুগে মিথ্যাচার, অসম্মান, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা সমানে বাড়বে। এর প্রতিকার কি হতে পারে? আজ সমাজটা অবক্ষয়ের ক্যানসারে ফুঁকছে। যার প্রতিকারের ওষুধ এখনও জানা নেই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular