Friday, August 23, 2024
Homeস্বাস্থ্য পরামর্শপ্রস্টাইটিস কি এবং কেন হয়- Prostatitis in Bengali

প্রস্টাইটিস কি এবং কেন হয়- Prostatitis in Bengali

প্রস্টেট গ্রন্থি পুরুষের শরীরের একটি খুব ছোট গ্রন্থি হলে ও পঞ্চাশোর্ধ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা নামে আকারে বৃদ্ধি পেয়ে বহু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। প্রস্টেট গ্রন্থির এই বৃদ্ধি এবং সে কারণে সৃষ্ট হওয়া নানাবিধ অসুবিধার কথা মোটামুটি ভাবে সর্বজনবিদিত। কিন্তু সম্ভবত এটা অনেকেরই জানা নেই যে, অপেক্ষাকৃত কম বয়সে কিংবা অন্যভাবে বললে বলা যায় যৌন কার্যক্ষম বয়সেও প্রস্টেট গ্রন্থি পুরুষ মানুষদের সমস্যায় ফেলতে পারে। 

প্রস্টেট গ্রন্থি কী: 

প্রথমেই জানাই, প্রস্টেট গ্রন্থি পুরুষের একটি যৌনগ্রন্থি। মূত্রথলির ঠিক নিচে মূত্রনালির (urethra) সংযোগস্থলের চারিদিকে গলাবন্ধের মতো এদের অবস্থান। আখরোট আকৃতির এই ক্ষুদ্র গ্রন্থিটি শুধুমাত্র পুরুষদের শরীরে থাকে। 

এর প্রধান কাজ

প্রস্টেটিক ফ্লুইড তৈরি করা। এই গ্রন্থি নির্গত প্রস্টেটিক ফ্লুইড সিমেনের উপাদানের একটি বড় অংশের জোগান দেয় এবং শুক্রাণুর পুষ্টি ঘটায়। সুতরাং যৌন কার্যক্ষম বয়সে পুরুষের শরীর থেকে যে সিমেন বেরোয় তাতে প্রস্টেট গ্রন্থির একটি বড় ভূমিকা থাকে। অবস্থানগত কারণে এই গ্রন্থিটিকে চোখে দেখা যায় না, হাতে স্পর্শ বা অনুভব করা যায় না। এই কারণে এই গ্রন্থিতে কোনও সংক্রমণ ঘটলে কিংবা গ্রন্থিটি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তা নির্ধারণ ও নিরাময় অনেক পরিশ্রম সাপেক্ষ। 

প্রস্টেট গ্রন্থির গঠন: 

প্রস্টেটিক ফ্লুইড এপিথেলিয়াম নামে এক ধরনের বিশেষ কোষস্তর অঞ্চলে তৈরি হয়। শরীরের সমস্ত ধরনের গ্রন্থিতে অবস্থানকারী কোষের এপিথেলিয়াম স্তর স্ট্রোমা নামক কলা দিয়ে ঘেরা থাকে। প্রস্টেটের স্ট্রোমায় থাকা পেশি তন্তু এই গ্রন্থির বিশৃঙ্খলায় উপসর্গের সৃষ্টি করে। প্রস্টেট বাড়তে শুরু করলে এপিথেলিয়াম ও স্ট্রোমা ক্রমশ প্রসারিত হতে শুরু করে।

প্রস্টেটকে একটি গ্রন্থি মনে হলেও আসলে এর দুটি ভিন্ন অংশ রয়েছে। অংশ দুটি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রস্টেট সংলগ্ন দুটি গুরুত্বপূর্ণ পেশির নাম স্ফিংক্টার (Sphincters)। এরা মূত্রথলি থেকে মূত্রকে বেরিয়ে যেতে বাধা দেয় এবং মিলনকালের চরম মুহূর্তে সিমেন নির্গমনে সাহায্য করে। প্রস্টেটের ঠিক নিচের পেশিটিকে এক্সটার্নাল ব্লাডার স্ফিংক্টার বলা হয়।

প্রস্টেট গ্রন্থির গঠনগত অসুবিধা

প্রস্টেট গ্রন্থির গঠন অনেকটা মৌচাকের মতো। গঠনগত কারণে এই গ্রন্থিতে নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। মুশকিল হল, একবার যে-কোনও সমস্যা হলে তা ক্রমশ জটিল আকার নিতে পারে। যেমন, প্রস্টেট ক্যান্সার। আমরা অনেকেই জানি, পঞ্চাশোর্ধ বয়সে প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধির পেছনে থাকে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের প্রভাব। এই বৃদ্ধি প্রস্রাবে বাধা-সহ নানা রকমের সমস্যা ঘটায়। এই ধরনের বৃদ্ধিকে বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া বা বি. পি. এইচ. বলা হয়

01 1

প্রস্টেট গ্রন্থির সংক্রমণ

প্রস্টেট গ্রন্থিতে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউ টি আই-এর মতো সংক্রমণ ঘটতে পারে। একে প্রস্টাইটিস (Prostitis) বলে। খুব সাধারণভাবে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের কারণে প্রস্টেট গ্রন্থির প্রদাহকে প্রস্টাইটিস বলা হলেও শুধু প্রদাহ-প্রসঙ্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করে এই রোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অস্বাভাবিকতার বিষয়ে কিছু বোঝানো যায় না। মোটামুটি ভাবে পঞ্চাশ শতাংশ পুরুষের জীবনে প্রস্টাইটিসের উপসর্গ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও রোগটির বিষয়ে অনেকেই তেমন কিছু জানেন না। তবে একটা কথা জোর দিয়ে বলা যায়, প্রস্টাইটিস ক্যান্সার নয় কিংবা এর থেকে ক্যান্সার হওয়ার কোনও সম্ভাবনাও থাকে না।

ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটায়

এই রোগটির পেছনে রয়েছে ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ। ইউ. টি. আই.-এর ক্ষেত্রে যেমন কিডনি, ইউরিনারি ব্লাডার, মূত্রতন্ত্রের অন্যান্য অংশ কিংবা ইউরিনারি ব্লাডারে সিস্টাইটিস হতে পারে, তেমনি এক্ষেত্রে শুধু প্রস্টেট গ্রন্থি ব্যাকটিরিয়ার দ্বারা আক্রান্ত হয়। ইকোলাই নামে যে ব্যাকটিরিয়া ইউ. টি. আই. ঘটায়, প্রস্টাইটিসের নেপথ্যে রয়েছে সেই একই ব্যাকটিরিয়া। এরা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট দিয়ে ঢুকে প্রস্টেট গ্রন্থিকে আক্রমণ করে। প্রস্টাইটিস রোগটি যে খুব সাধারণ রোগ তা কিন্তু নয়, তাই এই রোগ খুব বেশি হয় না। তবে একবার প্রস্টাইটিস হলে তাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

প্রস্টাইটিসের প্রকার

মোটামুটি চার ধরনের প্রস্টাইটিস হতে পারে। অ্যাকিউট ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিস, ক্রনিক ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিস, ক্রনিক প্রস্টাইটিস/ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোম এবং অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ইনফ্ল্যামেটরি প্রস্টাইটিস।

অ্যাকিউট ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিস- 

অ্যাকিউট ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিস খুব কম দেখা গেলেও বিপদের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। সৌভাগ্যবশত এই প্রস্টাইটিসকে খুব সহজে নির্ধারণ ও চিকিৎসা করা যায়। এই রোগের উপসর্গের মধ্যে জ্বর, ঠান্ডা লাগার অনুভূতি, কোমরের কাছে ব্যথা, বারবার এমনকী রাতেও প্রস্রাব পাওয়া, প্রস্রাবের সময় জ্বালা ও যন্ত্রণা করা, শরীরে ব্যথা হওয়া ইত্যাদির কথা বলা যেতে পারে। এই রোগীর প্রস্রাব পরীক্ষা করে শ্বেত রক্তকণিকা ও ব্যাকটিরিয়ার সন্ধান পাওয়া যায়। এই উপাদানগুলি ইউ. টি. আই.-তেও উপস্থিত থাকে। চিকিৎসার জন্য মূলত ব্যাকটিরিয়া নিরোধক ওষুধ ব্যবহার করা হয় । 

ক্রনিক ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিস- 

ক্রনিক ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিস নামের রোগটিও অপেক্ষাকৃতভাবে কম হয়। ব্যাকটিরিয়া যখন প্রস্টেট গ্রন্থিতে বসবাসের উপযোগী কোনও স্থান খুঁজে পায় তখনই এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগ চট করে সারতে চায় না। একবার সেরে যাওয়ার পরেও একই ব্যাকটিরিয়া দ্বারা বারবার ফিরে ফিরে এই রোগ হয়। দীর্ঘকাল ধরে ব্যাকটিরিয়া নিরোধক ওষুধ প্রয়োগ করে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়।

ক্রনিক প্রস্টাইটিস বা ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোম- 

প্রস্টাইটিস এর বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে প্রকারটি দেখা যায়, সেটি হল ক্রনিক প্রস্টাইটিস বা ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোম । যে-কোনও বয়সী পুরুষের এই রোগ হতে পারে। এটি দু’ধরনের- প্রদাহমূলক (Inflammatory form) বা অপ্রদাহমূলক (Non Inflammatory form) হতে পারে। প্রদাহমূলক হলে রোগীর প্রস্রাব, সিমেন এবং প্রস্টেটিক ফ্লুইডের মধ্যে শরীরে সৃষ্টি হওয়া সংক্রমণ প্রতিরোধী কোষের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অপ্রদাহমূলক রোগের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনও কোষ উপস্থিত থাকে না। প্রদাহমূলক ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোমের রোগীকে প্রথমে কিছুদিনের (৬ সপ্তাহ) জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। যদি তাতে উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায় তা হলে আরও কিছুদিন (৬ সপ্তাহ) ধরে সেই ওষুধ ব্যবহার করতে বলা হয়। যদি কাজ না হয় তবে প্রদাহ কমাবার জন্য আলফা ব্লকারস ব্যবহার করা যেতে পারে ।

অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ইনফ্ল্যামেটরি প্রস্টাইটিস- 

অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ইনফ্ল্যামেটরি প্রস্টাইটিসে রোগী কোনওরকম ব্যথা বা অসুবিধা বোধ না করলেও রোগীর সিমেন বা প্রস্টেটিক ফ্লুইডে শরীরে সৃষ্টি হওয়া সংক্রমণ বিরোধী কোষ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে বন্ধ্যাত্বের কারণ অনুসন্ধান ও প্রস্টেট ক্যান্সার নির্ধারণের পরীক্ষা করার সময় এই রোগ ধরা পড়ে।

04

প্রস্টাইটিস কাদের হয়

এই রোগটি হওয়ার পেছনে জীবনযাত্রার একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যে-কোনও বয়সের পুরুষেরই এই রোগ হতে পারে। তবে মূলত কম বয়সী ছেলে এবং পঞ্চাশ বছরের চেয়ে কম মধ্যবয়সী পুরুষেরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন।

প্রস্টাইটিস এর উপসর্গ

ব্যথা, জ্বর ও প্রস্রাব করতে বাধা পাওয়া প্রস্টাইটিস এর পরিচিত উপসর্গ। এই রোগ আক্রান্তদেরকে খুব কাহিল করে ফেলে। এ ছাড়া অধিকাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে বসতে অসুবিধার মতো একটি উপসর্গ দেখা যেতে পারে ৷ পুরুষের পশ্চাদদেশের সামনে কিংবা অণ্ডকোষের পেছনে যে অংশটি রয়েছে, বসবার সময় সেই অংশটিতে ব্যথা লাগতে পারে। প্রস্টাইটিসের প্রাথমিক অবস্থায় এই সব উপসর্গের পাশাপাশি ইউ. টি. আই. এর উপসর্গও থাকে। অর্থাৎ, প্রাথমিক পর্যায়ে দুটি সমস্যাই পাশাপাশি অবস্থান করে। এই রোগের অন্যান্য আরও কয়েকটি উপসর্গ হল- ঠান্ডা লাগা, বমি বমি ভাব ও বমি, দিনে ও রাতে বারে বারে প্রস্রাব পাওয়া, প্রস্রাবে জ্বালা করা ইত্যাদি।

প্রস্টাইটিস নির্ধারণ

প্রস্টাইটিস রোগ নির্ধারণ ও তার চিকিৎসা করা কিছুটা জটিল। কারণ, রোগী ভেদে উপসর্গের ধরনে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া ব্যথা কিংবা প্রস্রাব করবার সময় জ্বালা করা কিংবা প্রস্রাব শেষ। হতে না চাওয়ার অনুভূতির সঙ্গে অন্য কয়েকটি রোগের উপসর্গের সাদৃশ্য রয়েছে। তাই কোনও ইউরোলজিস্টের কাছে পরামর্শের জন্য যাওয়ার পরে তিনি রোগীকে অন্য কোনও বিশেষজ্ঞের কাছে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাঠাতে পারেন যে রোগীর শারীরিক উপসর্গের পেছনে অন্য কোনও রোগের ভূমিকা নেই।

02 1

রোগী প্রস্টাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন এই সন্দেহে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডিজিটাল রেক্টাম এগ্‌জামিনেশন বা ডি. আর. ই. করেন। ডি. আর. ই. করবার জন্য রোগীকে শুইয়ে বা কাত করে নেওয়া হয়। তার পরে ইউরোলজিস্ট কৃত্রিমভাবে পিচ্ছিল করে নেওয়া গ্লাভস পরা আঙুলকে পায়ুপথে ঢুকিয়ে প্রস্টেট গ্রন্থির পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষা করার সময় রোগীর প্রস্টেট গ্রন্থি ফুলে রয়েছে কি না তা বোঝা যায় ৷ প্রস্টাইটিসে আক্রান্ত রোগী ডি. আর. ই. পরীক্ষা চলাকালে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। বর্ধিত প্রস্টেট কিংবা প্রস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও ডি. আর. ই. করা হয়। ওই রোগ পরীক্ষার সময় ইউরোলজিস্ট বুঝতে পারেন যে, প্রস্টেট গ্রন্থি খুব বড় হয়েছে বা শক্ত হয়ে গেছে। রোগী এক্ষেত্রে কিন্তু কোনও ব্যথা পান না। কম বয়সী কোনও রোগীর প্রস্টাইটিস হলে ডি. আর. ই. করবার সময় দেখা যাবে, রোগী প্রস্টেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছেন, তবে তার গ্রন্থি খুব বড় আকারের হয়ে গেছে এমনটা নয়। আসলে সংক্রমণ যেখানেই হোক না কেন তার জন্য প্রস্টেট গ্রন্থিতে প্রদাহ হয়। ফলে, গ্রন্থিটি ফুলে যায়। এই প্রদাহকে ভেতর থেকে দেখলে দেখা যাবে জায়গাটি লাল টকটকে হয়ে আছে। ফুলে যাওয়া আর বড় হয়ে যাওয়ার মধ্যে মূলগত একটা পার্থক্য রয়েছে। ফুলে যাওয়াটা অস্থায়ী হলেও বড় হয়ে যাওয়াটা একটি স্থায়ী পরিবর্তন। একমাত্র ডি. আর. ই.-র মাধ্যমেই এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ছাড়া ওই সময়ে প্রস্টেটের সোনোগ্রাফি করলে দেখা যাবে যে, গ্রন্থিটি ফুলে রয়েছে। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ডি. আর. ই. করার সময় রোগীকে অজ্ঞান করে প্রস্টেটিকে মাসাজ করা হয়। মাসাজের ফলে প্রস্টেট থেকে সিমেন বেরিয়ে আসে যার বেশিরভাগটাই প্রস্টেটিক ফ্লুইড। মাসাজ পরবর্তী প্রাপ্ত তরলকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে পরীক্ষা করলে ব্যাকটিরিয়া ও শরীরের সৃষ্টি হওয়া সংক্রমণ বিরোধী কোষের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ক্রনিক প্রস্টাইটিস বা ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোম নির্ধারণ করা বেশ শক্ত ব্যাপার। কারণ, প্রস্টেট ছাড়াও অন্যান্য কিছু কারণে একই ধরনের উপসর্গ হতে পারে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে গেলে মূত্রতন্ত্রের ইত্যাদি যে নেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হয়। যেহেতু এই কারণে নানা অন্যান্য রোগ, যেমন কিডনি স্টোন, মুত্রথলির বিশৃঙ্খলা ও সংক্রান্ত জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে তাই আল্ট্রাসাউন্ড, এম. আর. আই., রক্তের কিছু পরীক্ষা ও মূত্রথলির কার্যকারিতা পরীক্ষার মতো কিছু বিশেষ পরীক্ষা করে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তাতে যদি মূত্রতন্ত্রের অন্যান্য রোগের সম্ভাবনাকে বাতিল বলে মনে করা যায়, একমাত্র তা হলেই ক্রনিক প্রস্টাইটিস বা ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোমের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।

প্রস্টাইটিস এর চিকিৎসা

প্রস্টাইটিসের চিকিৎসার কয়েকটি বিশেষ ধরন রয়েছে। 

  • প্রথমত, রোগীকে আরাম দেওয়ার জন্য ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয়। 
  • দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ দমন করবার প্রয়োজনে কিছু ব্যাকটিরিয়া নিরোধ ওষুধ দেওয়া হয়। 
  • তৃতীয়ত, যে ব্যবস্থাটি নেওয়া হয় সেটি হল, আলফা ব্লকারস বা এনজাইম ব্লকারসের মতো ওষুধের প্রয়োগ। বি. পি. এইচ. জনিত কারণে যে-সব বয়স্ক মানুষের প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যায় তাদের ক্ষেত্রে এই জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে প্রস্টেট গ্রন্থিকে চুপসে দেওয়া হয়। 

প্রস্টাইটিসের ক্ষেত্রে প্রস্টেট গ্রন্থির সাময়িক প্রদাহ রুখতে এই ওষুধগুলি কাজে লাগে। এই ওষুধগুলি প্রস্টেট গ্রন্থির গ্ল্যান্ডুলার কলা ও নরম পেশি কলাকে শিথিল করে মূত্রনালির ওপরে প্রস্টেট গ্রন্থির অবাঞ্ছিত চাপ কমিয়ে দেয়। তার ফলে সংক্রমণের তীব্রতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি প্রস্রাব করার সময়কার বাধাটাও চলে যায়। তা ছাড়া সামগ্রিকভাবে ব্যথাও কমে ৷

অ্যাকিউট ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিসের রোগীকে কিছুদিনের জন্য ব্যাকটিরিয়া বিনাশী ওষুধ দিলেও ক্রনিক ব্যাকটিরিয়াল প্রস্টাইটিসে দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ ব্যবহার করার দরকার হয়। প্রদাহমূলক ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোমের রোগীকে প্রথমে কিছুদিনের (৬ সপ্তাহ) জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। তাতে উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া না গেলে আরও কিছুদিন (৬ সপ্তাহ) ধরে সেই ওষুধ ব্যবহার করতে বলা হয়। ওষুধে কাজ না হলে প্রদাহ কমাবার উপযোগী আলফা ব্লকারস ব্যবহার করা যেতে পারে ৷ প্রদাহমূলক ক্রনিক পেলভিক পেন সিনড্রোমের ক্ষেত্রে অন্য কোনও ওষুধ ব্যবহারের আগে ৪ সপ্তাহ ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এখানে অন্য ওষুধ বলতে পেশি শিথিল করার ওষুধের কথা বলা হচ্ছে। রোগীকে আরাম দেওয়ার প্রয়োজন হলে সিস্টোস্কোপি করা যেতে পারে। এর ফলে প্রস্রাব বেরোবার পথ বাধা মুক্ত হয়ে যাওয়ায় রোগী অনেকখানি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে একটা কথা মনে রাখা উচিত সংক্রমণের চিকিৎসা আগে না করে নিয়ে সিস্টোস্কোপি করাটা ঠিক নয়। তা ছাড়া প্রস্টাইটিস হলে বায়োপসি করবার কোনও প্রয়োজন হয় না। বায়োপসি করলে বরং রোগটির বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সুতরাং এক কথায় বলা যায়, প্রস্টাইটিসের চিকিৎসা মূলত অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টি-প্রস্টেটিক মেডিসিনের দ্বারা করা হয়। 

প্রস্টাইটিস এর জটিলতা: 

প্রস্টাইটিস সেরে গেলেও মানুষটি একেবারে বিপন্মুক্ত হয়ে গেছে এমনটা বলা যায় না। প্রস্টেট গ্রন্থির বিষয়ে আগেই জানিয়েছি যে, এর গঠন অনেকটা মৌচাকের মতো। এই গঠনের গ্রন্থিটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাকটিরিয়া ঢুকে পড়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু মুশকিল হল ব্যাকটিরিয়া দমনকারী অ্যান্টিবায়োটিক ওই অঞ্চলগুলিতে ভাল করে প্রবেশ করতে পারে না। সেই কারণে একবার প্রস্টাইটিস হলে রোগটির বারবার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। রোগটিকে দাঁতের ব্যথার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যা একবারে কমতে চায় না, বারবার হয়। বি. পি. এইচ. রয়েছে এরকম কোনও বয়স্ক মানুষের যে-কোনও ধরনের প্রস্টেট উপসর্গে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে প্রস্টাইটিস হলে বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার কারণ এর ফলে মূত্র নির্গমনে অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় টেস্টিকেলের সংক্রমণজনিত রোগ এপিডিডাইমাইটিস (Epididymi- tis) প্রস্টাইটিসকে জটিলতর করে তুলতে পারে।

রোগীর যৌনজীবন ব্যাহত হবে বলে যৌনকার্যক্ষম বয়সে (কুড়ি থেকে চল্লিশ) এই রোগে অস্ত্রোপচার করা যায় না। কারণ, অস্ত্রোপচার হলে সিমেন সামনের দিকে আসতে না পারায় সন্তান সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই কম বয়সে অস্ত্রোপচার এড়িয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় যতবারই সংক্রমণ হোক না কেন ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা চালিয়ে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত রোগটি বারবার হলেও বারবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়। তবে কিছুটা বেশি বয়সে এবং পরিবার সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে এই রোগের বারংবার আক্রমণে এড়াতে প্রয়োজনে ট্রান্স ইউরেথ্রাল রিসেকশন অফ প্রস্টেট বা টি. ইউ. আর. পি.-র মতো অস্ত্রোপচারের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য এটা একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা। অন্তত পঁয়তাল্লিশ বছর না হলে এবং অসুখের মাত্রা বিপজ্জনক জায়গায় না গেলে সাধারণত এই ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয় না। যদি এই অস্ত্রোপচার করা যায় তা হলে প্রস্টেটের মৌচাক আকৃতির গঠন উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং সংক্রমণ দমন করা সহজ হয়ে যায়।

প্রস্ট্যাটোডাইনিয়া বনাম প্রস্টাইটিস: 

প্রস্ট্যাটোডাইনিয়া নামে এক ধরনের রোগের সঙ্গে প্রস্টাইটিসের উপসর্গের অত্যন্ত সাদৃশ্য রয়েছে। সম্ভবত প্রস্টেট পেশির খিঁচুনির ফলে এই রোগ হয়। এই রোগের উপশমে আলফা ব্লকার্সের মতো ওষুধের ব্যবহার করা হয়। দেখা গেছে মানসিক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাতে পেশির খিঁচুনির মতো সমস্যা বাড়ে। 

প্রস্টাইটিসে আক্রান্তদের পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল গ্রহণ এবং সেই সঙ্গে প্রচুর বিশ্রাম নেওয়া দরকার। এই সময় যৌনমিলন এড়িয়ে চলাই ভাল। অবশ্য এই সময়কার শারীরিক পরিস্থিতিও এই ধরনের ইচ্ছের অনুকূল থাকে না।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular