ধরি মাছ না ছুঁই পানি— না, মাছ ধরতে গেলে জল ছুঁতেই হবে। পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে তেমনই ধুলো-বালির সংস্পর্শে আসতে হবে, ভেজালের আওতায় আসতে হবে। প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার খপ্পরে যেমন পড়তে হবে ঠিক তেমনই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে সাময়িক বা পাকাপাকি ভাবে দুশ্চিন্তা ও অবসাদের খপ্পরেও পড়তে হবে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই অবসাদের হাত থেকে রেহাই পাননি। যদিও এর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। হার্টের অসুখে দুশ্চিন্তার প্রকোপ শতকরা হিসেবে কত তার এখনও কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। হার্টের মূলত দুটো অসুখ— মাইট্রাল ভালভ প্রোল্যাপস ও বুকে ব্যথা। এবং এ ব্যাপারে অনেক গবেষণা হয়েছে। বুকে ব্যথার জন্য সব পরীক্ষার পর করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করেও যদি বুকে ব্যথার কারণ খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে সাধারণত তা অ্যাটিপিক্যাল চেস্ট পেন হিসেবে ধরা হয়, যা দুশ্চিন্তা ও হাইপারভেন্টিলেশনের পরিণতি। গবেষণায় দেখা গেছে ‘স্বাভাবিক দুশ্চিন্তার কারণে কিছু ক্ষেত্রে করোনারি হার্ট ডিজিজ (সি.এইচ.ডি) হয়। এটাও দেখা গেছে হার্ট অ্যাটাকের পর যাদের হার্টের ছন্দবৈকল্য (ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিদমিয়া) হয় তাদের দুশ্চিন্তা ও চাপযুক্ত জীবন যাপনের বেশি করে সম্মুখীন হতে হয়।
Table of Contents
লিভারে যেমন গ্লুকোজ জমা হয়, তেমনই ব্রেনের থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাসের পাশে অবস্থিত অ্যামিগডালা বডি সব আবেগপ্রবণ স্মৃতিগুলোর জমাকেন্দ্র। ইলেকট্রিকের মেইন সুইচ থেকে যেমন তার বেরোয় ও ফেরত আসে, তেমনই সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারের মতো যাওয়া-আসার সংযোজনে সমৃদ্ধ এই অ্যামিগডালা বডি দুশ্চিন্তার সঠিক কারণগুলো এখনও অধরা, যদিও—
- সাইকোডায়ানামিক থিওরি বিহেভিয়ারাল থেরাপি
- কগনেটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি
- বায়োলজিক্যাল থিওরির ওপর ভিত্তি করে দুশ্চিন্তার কারণগুলো বিশ্লেষণ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নরএপিনেফ্রিন, ফাইব হাইড্রোক্সোট্রিপ্টামিন, ডোপামিন, ওপিয়ড রিসেপটর ও নিউরোএন্ডোক্রিন ডিসফাংশন দায়ী।
বিভিন্ন রকমের দুশ্চিন্তাগুলো হল—
- জেনারেল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।
- প্যানিক ডিসঅর্ডার।
- পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার।
- অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার।
আর দেরি নয়, এই বোধহয় মরলাম, প্যানিক অ্যাংজাইটির লক্ষণ। কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে হাত-পা কাপা, বুক ধড়ফড় করা বা আমার সম্বন্ধে কেউ কিছু বলছে বা ভাবছে—এটা সোশ্যাল ফোবিয়ার চিন্তাধারা। কোনো শারীরিক বা মানসিক আঘাতজনিত কারণে হওয়া দুশ্চিন্তার নাম পি.টি.এস.ডি। ও.সি.ডি-তে উদ্ভট, অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক চিন্তাধারা মাথায় আসে। যতক্ষণ না রোগী এখান থেকে বেরিয়ে আসছে দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।
দুশ্চিন্তার লক্ষণ
- হাত-পায়ের কম্পন, অস্থিরতা, ভয়ার্ত মুখের ভাব।
- বুক ধড়ফড়, ঘাম, মুখ-চোখের রক্তিম ভাব, শ্বাসকষ্ট, বুকে-পিঠে কিছু চেপে বসে থাকার অনুভূতি, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঘনঘন প্রস্রাব, মাথাঘোরা, চোখ ছানাবড়া হওয়া।
- মনোনিবেশের অভাব, ডিপার্সোন্যালাইজেশন, ডিরিয়ালাইজেশন, অনিদ্রা, হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠা।
আরে এ তো আমারও হয়। পড়ছেন আর ভাবছেন। বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে কমবেশি সবাই এই রোগের শিকার। আর দূষণ, কাজের চাপ, মানসিক টেনশন, ধূমপান, ‘অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা ইত্যাদি নানা কারণে বাড়ছে হার্টের রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী অদূরভবিষ্যতে সারা পৃথিবীতে হৃদরোগে আক্রান্তের ষাট শতাংশ হবে ভারতীয়। এ দেশে প্রতি বছর ত্রিশ লাখ লোক হৃদরোগে মারা যান এবং এদের মধ্যে পঁচিশ শতাংশের বয়স চল্লিশের নীচে।
যারা হতাশা ও দুশ্চিন্তায় ভোগেন রক্তে তাদের ইনফ্ল্যামেটরি ও কোয়াগুলেশনের মার্কার বেশি পরিমাণে থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন, টিউমার, নেক্রোসিস ফ্যাক্টর, আলফা, ইনটারলিউকিন-৬, হোমোসিস্টিন ও ফাইব্রিনোজেন লেভেল বেশি থাকে।
প্যানিক রোগীদের স্বাভাবিক অবস্থায় হার্ট থেকে এপিনেফ্রিন ক্ষরণ বেশি হয় ও প্যানিক অ্যাটাকের সময় এপিনেফ্রিন সার্জ হয়। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও দুশ্চিন্তাপ্রবণ রোগীদের অ্যাথেরোস্ক্লেরোটিক প্লাক রাপচার, রক্তনালীর সংকোচন, হার্টের ছন্দবৈকল্য বেশি হয়। প্যানিক অ্যাটাকে রোগীদের বেশি মাত্রায় শ্বাসপ্রশ্বাস (হাইপারভেন্টিলেশন) করোনারি আর্টারির স্প্যাজম ও হার্ট অ্যাটাক ঘটাতে পারে।
দুশ্চিন্তাপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলার কারণ—
- হার্টের অসুখ : মাইট্রাল ভালভ প্রোলাপস্, আই.এইচ.ডি, ব্লাডপ্রেসার বেশি বা কম।
- অন্তক্ষরা গ্রন্থির অসুখ : হাইপো বা হাইপার থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, ক্যালসিয়াম কম।
- স্নায়ুর অসুখ : আধকপালি (মাইগ্রেন), পারকিনসনস ডিজিজ।
- ফুসফুস : অ্যাজমা, সি.ও.পি.ডি.
- নেশার জিনিস : কোকেন, অ্যালকোহল, দুশ্চিন্তার ওষুধ হঠাৎ করে বন্ধ হওয়া।
প্রতিরোধ
রোগ থাকলে তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। অল্পমাত্রার দুশ্চিন্তাপ্রবণতার জন্য সাধারণত নন- ফার্মাকোলজিক্যাল চিকিৎসাই যথেষ্ট। এগুলো হল জ্যাকবসন রিল্যাকশন পদ্ধতি, যোগা, প্রাণায়াম ও ধ্যান। বেশি দুশ্চিন্তাপ্রবণ হার্টের রোগীদের অবশ্যই অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট অ্যাঞ্জিওলাইটিক দিতে হয়। আমেরিকার এফ.ডি.এ অনুযায়ী প্রথম পছন্দের ওষুধ এস.এস.আর.আই। এর মধ্যে সারটালিন-এর অ্যান্টিপ্লেটলেট এন্ডোথেলিয়ালের কার্যকারিতা আছে। তবে যাদের বাই ফ্যাসিকুলার বা ট্রাইফ্যাসিকুলার ব্লক আছে তাদের ট্রাইসাইক্লক অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট নৈব নৈব চ।
সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই। বেশির ভাগ রোগ প্রতিরোধ ও দুশ্চিন্তার প্রশমন ঘটাতে মাঝারি গতিতে সকাল বা সন্ধ্যে ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই। উপকারগুলো হল—
- ভালোর অনুভূতিবাড়ায় ও দুশ্চিন্তা কমায় (পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের নিঃসরণ বাড়ায়)।
- রক্তে চর্বির আধিক্য কমায়।
- ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ায় ও রক্তে গ্লুকোজ কমায় ৷
- হাড়ের ডেনসিটি বাড়ায় ৷
- অ্যালজাইমার্স রোগ প্রতিরোধ বা আক্রমণ বিলম্বিত করে।