Tuesday, June 25, 2024
Homeমানসিক স্বাস্থ্যকিভাবে বাড়বে স্মৃতিশক্তি; সাথে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা?

কিভাবে বাড়বে স্মৃতিশক্তি; সাথে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা?

স্মৃতি সততই সুখের। কিন্তু স্মৃতিভ্রংশ কখনও কখনও দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে। কাছের মানুষকে চিনতে না পারা, দরকারি কথা ভুলে যাওয়া, বাড়ির ছোটখাটো জিনিস যেমন ঘরের চাবি, আলমারির চাবি কোথায় রয়েছে ভুলে যাওয়া, গ্যাস ওভেন বন্ধ করা হয়েছে কি না এরকম অসংখ্য ভুলের পেছনে থাকে মেমরি লসের মতো ঘটনা। অনেক সময় ব্রেনে চোট পাবার কারণেও মানুষ তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। সেই স্মৃতি হারানোর ঘটনাও খুবই দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে। যোগা মেডিটেশন, শব্দছক, পাজল প্রভৃতি ব্রেন ওয়ার্ক মেমরিকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে। তাই ব্রেনকে কিছু না কিছু কাজের মধ্যে রাখুন।

মেমরি লস কত ধরনের হয়

সেদিন রনিতা বলছিল, ‘আজকাল কী যে হচ্ছে আমার, সব খালি ভুলে যাচ্ছি। রিয়ার মা রিয়াকে পড়াতে বসে রোজ চিৎকার করেন ‘মেয়েটার মাথায় যদি কিছু ঢোকে! কোনো কথাই মনে রাখতে পারে না।’ ‘সুমনের দাদুকে নিয়ে সবাই চিন্তিত। রাস্তায় বেরিয়ে হামেশাই বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেন। কোনদিন যে একটা অঘটন ঘটবে।’ আসলে এ সবই কিন্তু মেমরি লসের কারসাজি। মেমরি লস দু’-তিন টাইপের হয়।

  • অতি সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে যাওয়া। অর্থাৎ সকালে জলখাবারে কী খাওয়া হয়েছে, বিকেলে কী খাওয়া হয়েছে এই ধরনের ঘটনাগুলো ভুলে যাওয়া। খাওয়া ছাড়া অন্য ঘটনাও ভুলে যেতে পারে। যেমন সকালে বাড়িতে কেউ এসেছিল কি না বা কোনো কথা মনে না পড়া— এটাকে বলে রিসেন্ট মেমরি লস।
  • শর্ট টার্ম মেমরি লসের মতো ঘটনাও ঘটে। যেমন সাত- দশদিন আগেকার কোনো ঘটনা ভুলে যাওয়া। এবং এ ব্যাপারে যিনি ভুলে যান তিনি ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে চান না ফলে নানা ঝামেলাও হয় এসব নিয়ে। কিছুতেই কয়েকদিন আগে দেখা হওয়া কোনো মানুষের নাম মনে না আসাটাও এক ধরনের শর্ট টার্ম মেমরি লস।
  • লং টার্ম মেমরি লসের ক্ষেত্রে দেখা যায় ছোটবেলার স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা সব ভুলে যায় মানুষ

মেমরি লসের তিন কারণ

আগে জানা দরকার মেমরিটা কোথায় থাকে ৷ মেমরি আমাদের ব্রেনের একদম ভেতরে কানের ওপরে একটা জায়গায় গচ্ছিত থাকে তার নাম লিম্বিক লোব। লিম্বিক লোবের কী কাজ এখনও অবধি বিস্তারিতভাবে কেউ জানে না। তবে তার প্রধান কাজ হচ্ছে মেমরি ধরে রাখা। শরীর বা ব্রেন যা শোনে সেটা সঙ্গে সঙ্গে লিম্বিক লোবে চলে যায়। লিম্বিক লোব একটা লাইব্রেরির মতো। এখানে ঘরে ঘরে মেমরির মণিকুলগুলো গচ্ছিত থাকে। ঠিক লাইব্রেরিতে যেমন বই সাজিয়ে রাখা হয় তেমন।

ব্রেন যখন নতুন কোনো তথ্য পেল বা নতুন কিছু শিখল তার একটা ইনপুট ব্রেন লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে দেয়। লাইব্রেরি তখন দেখে নেয় আগের কোনো ঘটনার সঙ্গে বর্তমান ঘটনা বা কথার মিল আছে কি না। বা কোনো মানুষের সাথে দেখা হয়েছে কি না।

যদি কথা বা দেখা হয় তখন লাইব্রেরি থেকে ইনফর্মেশন বা তথ্যগুলো নেয়, এবার ব্রেনের যে অংশটা রেসপন্স করে সেই অংশকে মডিফাই করে অর্থাৎ যদি পূর্ব পরিচিত হয় তাহলে হাই, হ্যালো, বসতে বলা বা কথা চালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় সম্মতি দেয়। 

যদি লাইব্রেরি তথ্য খুঁজে না পায় তখন লাইব্রেরিতে এটা নতুন তথ্য হিসেবে মেমরিতে স্টোর হয়ে যায়। এইভাবে ছোটবেলা থেকে বড়বেলা অবধি যা শিখেছি তা স্টোর হয়। অর্থাৎ জমা করা থাকে লাইব্রেরিতে রাখা ‘বইয়ের মতো থাকে থাকে। দরকার মতো আমরা ব্যবহার করি।

মেমরি লস কাদের হয়

ছোটদের মেমরি লস : মেমরি লাইব্রেরিটাই তৈরি হয় না। লাইব্রেরির জায়গায় কোনো গোলমাল থাকে। জন্মগত গোলমাল, যেমন ব্রেনে জল জমা, ব্রেনের মাঝখানে লিম্বিক লোব বা টেম্পোরাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যাদের অত্যধিক খিঁচুনি হয় বা মৃগির আক্রমণ ঘটে, তাদের ওই সময় ব্রেনে অক্সিজেন কম যায় ফলে লিম্বিক লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লাইব্রেরিটা তাদের তৈরিই হয় না।

এদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই মেমরি স্টোর করার জায়গাটা থাকে না। ইনফরমেশন যা আসে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এদের ক্ষেত্রেও অবশ্য চিকিৎসা করা সম্ভব। এদের নানা ধরনের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। যেমন বিহেভিয়ারাল থেরাপি, লার্নিং থেরাপির মাধ্যমে ধীরে ধীরে মেমরি ভান্ডারটাকে গড়ে তুলতে হয়। এইভাবে সাত-আট বছর বয়স অবধি মেমরি ভান্ডার গড়ে ওঠার পর আবার তারা মেমরি রিগেইন করতে পারে। যে সব বাচ্চাদের দু’-তিন বছর বয়সে খুব মেমরি কম দেখা যায় তাদের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে মেমরি ডেভেলপ করা হয়। সাত-আট বছর বয়সে কিছুটা মেমরি ফিরে আসে।

বড়দের মেমরি লস : কোনো কারণে ব্রেনের মধ্যে যে নার্ভ বা কেমিক্যাল আছে সেই কেমিক্যাল বা নার্ভের গোলমালে সিগনাল আসা-যাওয়া করে না ফলে কোনোরকম ইনফরমেশন লাইব্রেরিতে আসে না বা লাইব্রেরি থেকে ইনফরমেশন বাইরে যায় না, সে জন্য মেমরি লস হয়।

মেমরি লসের পিছনে কাজ করে বয়সজনিত কারণে ব্রেন শুকিয়ে যাওয়া, যাকে অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ বলে। এখানে ব্রেনটা শুকিয়ে যায় বলে ব্রেনের লাইব্রেরিটাও শুকিয়ে যায়। ফলে মেমরিগুলোকে জাগিয়ে তোলার মতো কিছু থাকে না ।

ব্রেনের কিছু কিছু অসুখ, যেমন— এন.পি.এইচ, যেকোনো রকমের স্ট্রোক, পার্কিনসন ডিজিজ—এসব রোগে সিগন্যাল চলাচলের গোলমালের জন্য মেমরি বা স্মৃতি ফেড হয়ে যায়। এইগুলো কিন্তু বেশিরভাগ সময় ঠিক করা যায় না। এদের রি-ট্রেনিং করা গেলেও পুরোপুরি ঠিক হতে চায় না। বৃদ্ধ বয়সে ব্রেনও শিখতে চায় না ফলে মেমরি লসও ঠিক হয় না।

মেমরি বা স্মৃতিশক্তিকে ভালো রাখার উপায়

1258 1
  • মেমরি বা স্মৃতিকে ভালো রাখার উপায় হল সংগঠিত করা। একটা লাইব্রেরিতে যদি ইনফর্মেশন বা তথ্য ঠিকমতো সুন্দর করে সাজানো থাকে তাহলে তাকে খুঁজে তাড়াতাড়ি বার করা যাবে। যে বাচ্চারা পড়াশোনায় ভালো তারা মন দিয়ে পড়ে। এবং তাদের মেমরিগুলো লাইব্রেরিতে থরে থরে এমনভাবে গচ্ছিত থাকে যাতে ওরা খুব তাড়াতাড়ি মনে করতে পারে। কিন্তু যারা অমনোযোগী, মন দিয়ে পড়াশোনা করে না, তাদের মেমরির মলিকুলটাই তৈরি হয় না। মেমরি মলিকুল তৈরি না হওয়ায় কোনো তথ্য পাওয়ার জন্য লাইব্রেরিতে হাতড়াতে হয়। কিন্তু হাতড়ালেও সেভাবে মেমরি সাড়া দেয় না।
  • মেমরি ভালো করার উপায় হল কনসেনট্রেশন বাড়ানো। সেটা যোগার মাধ্যমে হতে পারে, মেডিটেশনের মাধ্যমে হতে পারে কিংবা কিছু লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন করে হতে পারে। অর্থাৎ ডিসিপ্লিনড হতে হবে। এছাড়া ব্রেনকে বিশ্রাম দিতে হবে। সেটা ঘুমের মধ্যে দিয়ে হতে পারে। যারা সারা রাত জেগে কাজ করেন, কিংবা যাদের ঘুমে ডিস্টার্ব থাকে, পরিপূর্ণ ঘুম হয় না, তাদের ব্রেন কোনো সময় পায় না মলিকুলগুলো তৈরি করার। লাইব্রেরিটা ঠিকমতো সাজানো থাকে না ফলে মেমরিটা বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে।

তাই আমরা যদি একটা নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলি তাহলে মেমরিটাকে ভালো রাখতে পারব। যত বেশি মেমরি জমাতে পারব তত বেশি করে আমরা সবকিছু মনে রাখতে পারব। যাদের বয়স বেশি হয়েছে তাদের মেমরিটাকে ঠিক রাখার জন্য ব্রেনটাকে সচল রাখতে হবে।

রিটায়ারমেন্টের পর অনেকে কাজ না করে বাড়িতে বসে যান । এটা ঠিক নয়। ব্রেনকে কাজ না করালে ব্রেন কিন্তু বসে যাবে। ব্রেনের লাইব্রেরিতে যে মেমরি মলিকুল জমানোর অভ্যাস সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই চাকরি থেকে অবসর নেওয়া মানুষদের ব্রেনের কিছু কিছু কাজ অবশ্যই করা উচিত। যেমন টাকা-পয়সার হিসেব রাখা, ব্যাঙ্কের কাজগুলো করা, নিয়মিত শব্দছক করা কিংবা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পড়ানো। এসব নিয়মিত করলে মেমরি লাইব্রেরিটা অনেকদিন পর্যন্ত সচল থাকে, ফলে ভুলে যাওয়া ব্যাপারটা সহজে ঘটে না।

  • মেমরি বাড়াতে কোনোরকম অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ নেই। কোনো অ্যালোপ্যাথিক ওষুধেই মেমরি বাড়ানো যায় না। ব্রেনের বিশ্রাম অবশ্যই প্রয়োজন। তার মানে ঘুমটা ঠিকঠাক হওয়া প্রয়োজন আর মেমরি যাতে বসে না যায় তার জন্য নিয়মিত কিছু ব্রেন ওয়ার্ক করা দরকার। চোট-আঘাত থেকে অনেক সময় ব্রেন ড্যামেজ হয়ে মেমরি লস হয়, তবে বিভিন্ন থেরাপির সাহায্যে মেমরি কিছুটা উন্নত করা সম্ভব।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular