Friday, September 13, 2024
Homeপারম্পরিক ঔষধিকোষ থেকে জিন অবধি ক্যান্সার চিকিৎসার বিবর্তন

কোষ থেকে জিন অবধি ক্যান্সার চিকিৎসার বিবর্তন

‘ক্যান্সার’ ছোট শব্দ, কিন্তু এর আতঙ্ক সঞ্চারের ক্ষমতা অপরিসীম। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামনে এক জ্বলন্ত প্রশ্ন। এই রোগ উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের নানাবিধ অনুমান থাকলেও রোগটির প্রতিকার এখনও অধরা। অভূতপূর্ব অগ্রগতি সত্ত্বেও বিজ্ঞান পরাভূত, এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

প্রাচীনকালেও এই রোগের যে প্রাদুর্ভাব ছিল তা জানতে পারা যায় সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদ গ্রন্থগুলি থেকে। যথা ‘চরক, সুশ্রুত, সংহিতাদি থেকে। প্রাচীন আয়ুর্বেদে বর্তমানে যাকে ক্যান্সার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা ছিল কর্কট রোগ। আয়ুর্বেদাচার্যগণ কর্কট রোগ-সহ যাবতীয় রোগের কারণ এবং প্রতিকারও সূক্ষ্মভাবে নির্দেশ করে গেছেন। তাঁদের ত্রিধাতু তত্ত্ব রোগ-উৎপত্তির হেতু রূপে চিহ্নিত। 

বিসর্গা দান বিক্ষে পৈঃ সোম সূর্যানি লো যথা।
ধারয়ান্তি জাগ দ্রেহং কক্ষ পিত্তানিল স্তথা ৷৷

(-সুশ্ৰুত ২১/৮)

সোম সূর্য অনিল অর্থাৎ বরুণ, অগ্নি, বায়ু— এই ত্রিদেবতা যেমন বিশ্ব সৃষ্টি এবং বিশ্বের রক্ষণ ও পোষণ করছেন, তেমনি আবার এই ত্রিদেবতাই দেহ বিশ্বকেও পালন ও পক্ষণ করছেন। দেহস্থ এই ত্রিদেবতার নামই আয়ুর্বেদ মতে বায়ু, পিত্ত, কফ। 

আয়ুর্বেদ মতে বায়ু, পিত্ত, কফ ত্রিদোষ বা ত্রিধাতু নামে অভিহিত। দেহস্থ এই তিন ধাতু পারস্পরিক সাম্যাবস্থায় কোনও রোগোৎপত্তি হতে পারে না। ত্রিধাতুর যে কোনও একটি ধাতু বিকৃত বা নষ্ট হলে অর্থাৎ ধাতু বিপর্যয় ঘটলে রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। সহজ করে বলতে গেলে এই ত্রিধাতুর যতদিন সাম্যভাব বজায় থাকে, তত দিন বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ রোগ বীজ দেহের কোনও অনিষ্ট করতে পারে না।

সুস্থ, সবল দেহের মধ্যেও সকল প্রকার রোগ বীজাণু বিদ্যমান থাকে। দেহ দোষ যুক্ত না হলে রোগ বীজ দেহে বর্ধিত হতে পারে না এবং বহিরাগত রোগ জীবাণু দেহে সংক্রমিত হয়ে দেহের কোনও অনিষ্ট সাধন করতে পারে না। শরীরে রক্ত অত্যধিক অম্লধর্মী হয়ে রক্ত দূষিত হলে শরীরের কোনও স্থানে এক প্রকার ফাইব্রয়েড বা সূত্রবৎ বিষাক্ত বীজাণু জমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর দ্বারা ক্রমশ লিম্ফোটিক ভেসেল বা রক্তবাহী টিস্যু আক্রান্ত হয়ে এক প্রকার Tumor সৃষ্টি করে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতেও এই টিউমারকেই ক্যান্সার রোগ বলা হয়। ওই টিউমার ক্রমশ ক্ষতরূপে পরিণত হয়। ক্ষতস্থান থেকে ক্যান্সার তন্তু নির্গত হয়ে রক্তের মধ্যে ভেসে বেড়াতে থাকে। এই তন্তু কোনও জায়গায় আবদ্ধ হয়ে ওই স্থানে নতুন ক্ষত সৃষ্টি করে। এগুলোই হল ক্যান্সার কলোনি। এইভাবে শরীরের এক অঙ্গের ক্যান্সার অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধারাতেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই বর্তমান সময় অবধি ক্যান্সার রোগ তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে। প্রাচীনকালে জনজীবনে এই রোগটির প্রকোপ ও প্রভাব স্বল্প মাত্রায় হলেও বর্তমানের কর্মব্যস্ত জীবনে অতি ব্যাপক।

cancer treatement revolution

বর্তমানের যান্ত্রিক যুগে মানুষের জীবনধারাও যন্ত্রবৎ আবর্তিত হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গ-বিচ্যুত এই জীবনে এবং পরিবেশগত সর্বব্যাপক দূষণ প্রক্রিয়ার প্রভাবে স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়ে মানুষ অতি সহজেই ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে পতিত হচ্ছে। বিশেষভাবে ক্যান্সার রোগের কুপ্রভাব সমাজ থেকে দূরীকরণের উদ্দেশ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণারত। রোগটির উৎস, গতিপ্রকৃতি এবং রোগ প্রতিকার নয়, রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়েই গবেষণা এখনও পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রয়েছে। বলা বাহুল্য, ক্যান্সার বা কর্কট রোগ, কলেরা, টাইফয়েড, যক্ষ্মাদি অন্যান্য রোগের থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন। আধুনিক বিজ্ঞান মতে, ক্যান্সার হল একটি শরীরের বিপাক জনিত ত্রুটির ফল বা মেটাবলিক ডিসঅর্ডার। এই রোগে শরীরের কোষের নিউক্লিয়াসের DNA গঠনগত ও ক্রিয়াগত পরিবর্তন ঘটার ফলে শরীরের কোষের সমস্ত স্বাভাবিক বিপাক ক্রিয়া নষ্ট হয়ে এদের সাম্যভাব বিনষ্ট হয়। এই কোষটি হল ক্যান্সার কোষ। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে যাকে কর্কটঘটিত অর্বুদ বা টিউমার বলা হয়েছে। এই ক্যান্সার কোষটি ক্ষতরূপে পরিণত হয়ে আগে ক্যান্সার কোষ তৈরি করে। এইভাবে ক্যান্সার কলোনি বা ম্যালিগন্যান্ট টিউমার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যেহেতু ক্যান্সার কোষের স্বাভাবিক ক্রিয়া বিনষ্ট হয়, তাই মানুষের শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্মও বিনষ্ট হয়। পরিণামে শরীরের অঙ্গগুলি বিকল হয়ে ক্রমশ শরীরকে মৃত্যুমুখে এগিয়ে দেয়।

ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা বিরামহীন। গবেষণা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা পদ্ধতিরও দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটছে। মৃত্যুর হারও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেতে দেখা যাচ্ছে। এক সময়ে যা ছিল দুরারোগ্য, সেই ব্রেস্ট ক্যান্সার গ্রেড-থ্রি পর্যন্ত বর্তমানে সম্পূর্ণ সেরে যায়। ওভারি, থ্রোট, স্টমাক ইত্যাদি ক্ষেত্রেও শল্যচিকিৎসা বেশ কার্যকরী হতে দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে যদিও চিকিৎসার ফলাফল বিশেষ আশাপ্রদ নয়। রক্তের ক্যান্সার বা ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও চিকিৎসার ফলাফল সন্তোষজনক বলা চলে। ক্যান্সার রোগে যে মেটাবলিক ডিসঅর্ডার দেখা দেয়, তার বিকৃত প্রোটিনকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনতে ইমাটনিক ওষুধ কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।

ক্রনিক লিম্ফোয়েড লিউকোমিয়া সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রেই হতে দেখা যায়। বর্তমানে এই রোগের অত্যন্ত ফলপ্রদ ওষুধ আবিষ্কৃত হওয়ায় মৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। যদিও অ্যাকিউট মায়োলয়েড লিউকোমিয়া (AML)-এর ফল শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ আশানুরূপ নয়। এক্ষেত্রে বরস্কদের ওরাল কেমোথেরাপির সাহায্য নিয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল থাকতে দেখা যায়।

প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে যে ধরনের ‘রে’ চিকিৎসা করা হত, তাতে ক্যান্সার আক্রান্ত স্থান ছাড়াও সংলগ্ন অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হত। এই প্রক্রিয়ার উন্নত পর্যায়ে বর্তমানে ব্রাকি থেরাপি, লিনিয়ার অ্যাক্সেলেটর, সাইবার নাইফ ইত্যাদি প্রচলন হওয়ায় এই চিকিৎসার ধারায় বহুতর উন্নতি ঘটেছে বলা যায়। এর ফলে ক্যান্সার আক্রান্ত নির্দিষ্ট অঞ্চলটিতেই কেবলমাত্র ‘রে’ প্রয়োগ করা হয়, শরীরের সংলগ্ন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কেমোথেরাপি ব্যবহারের পদ্ধতিও যথেষ্ট পরিমাণে উন্নতি ঘটেছে। পূর্বে কেমোথেরাপি প্রয়োগে ক্যান্সার কোষগুলি যেমন নষ্ট হত, সেই সঙ্গে অনেক ভালো কোষও বিনষ্ট হত। এই অসুবিধার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন টার্গেট থেরাপি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলি প্রয়োগে কেবল ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলি ছাড়াও কোষের উৎস বিকৃত প্রোটিনটিকেও নষ্ট করবে। ফলে জিন লেভেল (DNA) জিনটাকে ব্লক করে তার উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, এর ফলাফল আশাপ্রদ।

মানব জীবনে ক্যান্সার এক অভিশাপ বিশেষ। বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জনজীবন থেকে এই অভিশাপের প্রভাব ক্রমশ অপসৃত হবে। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণা আমাদের সেই আশ্বাস প্রদান করছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতেই রোগাক্রান্ত আশাহত মানুষের মুখে শান্তি ও আনন্দের হাসি ফুটে উঠতে দেখা যাবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular