Monday, May 13, 2024
Homeস্বাস্থ্য পরামর্শস্বাস্থ্যসম্পর্কিত খবরহাঁপানি রোগের ওষুধ ও মুক্তির উপায় | Asthma Causes | Asthma Symptoms...

হাঁপানি রোগের ওষুধ ও মুক্তির উপায় | Asthma Causes | Asthma Symptoms | Asthma Treatment

হাঁপানিতে শাসকষ্ট অনুভূত হলেও সর্বক্ষেত্রেই শ্বাসকষ্ট মানে হাঁপানি নয়। হাঁপানি শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ হলেও এই কষ্টের অন্যান্য বহু কারণ আছে। যেমন— ব্রঙ্কাইটিস, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস বা ছত্রাক দ্বারা ফুসফুসের সংক্রমণ (নিউমোনিয়া), শ্বাসনালীতে বাধা সৃষ্টিকারী কোনো টিউমারের উপস্থিতি, ফুসফুসের সিসটিক ফাইব্রোসিস রোগ হত্যাদি। এছাড়াও উচ্চরক্তচাপ, অত্যধিক রক্তাল্পতা, ফরেন বডি (শ্বাসনালীতে ঢুকে যাওয়া কোনো বিজাতীয় বস্তু; যেমন—ছোলা, মুড়ি, পুঁতি, বোতাম ইত্যাদি), হৃদরোগ—এরকম নানা কারণেই শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সুস্থ মানুষ হঠাৎ যদি অত্যধিক উঁচু পাহাড়ে ওঠে, তাহলেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

Table of Contents

হাঁপানির কষ্ট ও অন্য কারণে শ্বাসকষ্টের তফাত

হাঁপানিতে শ্বাসনালী ও ফুসফুসের বায়ুচলাচলের পথে একপ্রকারের অবরোধ সৃষ্টি হয়ে শ্বাসকষ্ট হয়। এই রোগে শ্বাসনালীর ভেতর এলার্জিজনিত  প্রদাহের ফলে তিনটি পরিবর্তন ঘটে : ১) শ্বাসনলীর দেওয়ালের পেশিতন্ত্রের সঙ্কোচন, ২) শ্বাসতন্ত্রের মিউকাস গ্রন্থির স্ফীতি, ৩) মিউকাস গ্রন্থিগুলো থেকে ঘন রস নিঃসরণ।

অন্য রোগের কারণে শুরু হওয়া শ্বাসকষ্টে এইরকম পরিবর্তন না হয়ে অন্য রকমের পরিবর্তন ঘটে ফুসফুসে, শ্বাসনালীতে বা হৃদযন্ত্রে।

রোগের ইতিহাস ভালো করে জানলে- শুনলে সেই শ্বাসকষ্ট হাঁপানিজনিত কিনা বোঝা যায়। কারণ হাঁপানিজনিত শ্বাসকষ্টের ক্ষেত্রে অনেক সময় রোগ শুরু হবার ঠিক আগে অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আসার ইতিহাস থাকে (যেমন— ধুলো, বিশেষ খাদ্য, পশুর লোম, বেশি ঠাণ্ডা, সিগারেটের ধোঁয়া ইত্যাদি), যা অন্য কারণে উদ্ভূত শ্বাসকষ্টে থাকে না। অন্য রোগে সৃষ্ট শ্বাসকষ্টে ইতিহাস নিলে কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস রোগাক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার ঘটনা থাকে। অনেক সময় জ্বরের ইতিহাস পাওয়া যায়। হৃদরোগে শুরু হওয়া শাসকষ্টের ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপ বা বুকে ব্যথার ব্যাপার থকে।

হাঁপানিতে শ্বাস নেওয়ার তুলনায় শ্বাস ছাড়ার সময়সীমা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। শ্বাস ছাড়ার সময় একটা বাঁশির মতো সাঁই সাঁই শব্দ হয় বুকে। তার সঙ্গে অনেক সময় কাশি হয়। বুকে চাপ-চাপ লাগে। অনেক সময় হাঁপানি রোগী শ্বাস নেওয়ার সময় শ্বাসযন্ত্রের অতিরিক্ত সাহায্যকারী পেশিগুলির সাহায্য নেয়।

অন্য রোগের ক্ষেত্রে সাঁই-সাই বা ঘড়ঘড় শব্দটি শ্বাস নেওয়া বা ছাড়া দুই সময়েই শোনা যেতে পারে। আবার শব্দ না হয়ে শুধুই বুকে ব্যথা বোধ হতে পারে। বুক থেকে সাঁই সাঁই শব্দ এবং শুধু পরিশ্রম করার সময় শ্বাসকষ্ট হতে পারে। হাঁপানির শ্বাসকষ্টের বৈশিষ্ট্য হল একই কষ্ট বারবার হওয়া। এটা রোগ চেনার একটা বড় উপায়।

হাঁপানির বাড়তি প্রবণতা

১) জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া কার্যকর করতে গিয়ে সবুজের ধ্বংস, ব্যাপক হারে নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন বারোটা বাজাচ্ছে পরিবেশের। সবুজ গাছপালার কাজ হল বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেওয়া। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি ও কলকারখানার দূষণে বাতাসে সীসা, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন সালফার, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি ভীষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারী ধাতু গাড়ির ধোঁয়ায় মিশে গিয়ে বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। এইসব দূষিত পদার্থ পরিবেশে ক্রমশ আরও বেশি পরিমাণে জমা হচ্ছে। ফলে এই পদার্থগুলো সরাসরি শ্বাসনালীর প্রদাহ ও সঙ্কোচন ঘটায়। 

২) ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি ধোঁয়াশাতে মিশে মানুষের শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করছে। ফলে উত্তরোত্তর হাঁপানির প্রবণতা বাড়ছে।

৩) অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মানুষের মানসিক চাপ, দৈনন্দিন চিন্তা-ভাবনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলি সবই মানুষের মনকে প্রভাবিত করে হাঁপানি রোগীর শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাতাসে ওজোন গ্যাসের মাত্রা বেশি হলে রক্তের শ্বেতকণিকাগুলো শাসনালীর শ্লৈস্নিকঝিল্লিতে গিয়ে অ্যালার্জিজনিত প্রদাহের সৃষ্টি করে। আর তামাকের ধোঁয়া থেকে সাবধান। এটা শ্বাসকষ্টজনিত রোগের একটি প্রধান কারণ।

হাঁপানির জন্য দায়ী

অত্যন্ত ঠান্ডা আবহাওয়া, মানসিক উত্তেজনা, রাসায়নিক পদার্থ, জীবাণু সংক্রামণ, পেশাজনিত কারণ (যেমন— লোহার কাজ, কয়লাখনির কাজ) ইত্যাদি শ্বাসনালীর দেওয়ালে সরাসরি প্রদাহ সৃষ্টি করে, এবং মিউকাস গ্রন্থির স্ফীতি ঘটায় ও রস নিঃসরণ করে। আর তাতে শ্বাসনালীর সঙ্কোচন হয়। ধূমপান ও ঔষধ-পত্রের ক্ষেত্রে শ্বাসনালীর দেওয়ালে অবস্থিত বিশেষ ধরনের কোষের মধ্যে সেই ওষুধ বা তামাকের অ্যান্টিজেনের  সঙ্গে অ্যান্টিবডির সংযোগ ঘটে। তাঁর ফলে ওই কোষ থেকে হিস্টামিন নামক রসের নিঃসরণ ঘটে। এই রস শ্বাসনালীর দেওয়ালে প্রদাহের সৃষ্টি করে এবং শ্বাসনালীর সঙ্কোচন করে হাঁপানির সূত্রপাত করে।

হাঁপানি রোগের লক্ষণ

হাঁপানি দু’রকম : – ১) তাৎক্ষণিক হাঁপানি (অ্যাকিউট ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা) ও ২) দীর্ঘমেয়াদী হাঁপানি (ক্রনিক ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা)। দুই ক্ষেত্রেই থাকে শ্বাসকষ্ট। তাৎক্ষণিক হাঁপানিতে নিঃশ্বাসের কষ্টের সঙ্গে একটা সাঁই সাঁই শব্দ হয়। এটা দিন বা রাতের যে কোনো সময়ে হঠাৎ শুরু হতে পারে। শ্বাস ছাড়ার সময়সীমা দীর্ঘায়িত হয়। রোগী এসময় বসে থাকতে পছন্দ করে এবং শ্বাসকার্য চালানোর জন্য শ্বাসযন্ত্রের অতিরিক্ত সাহায্যকারি পেশিগুলির সাহায্য নেয়। যেমন—নাক, গলা ও বুকের কিছু পেশি এসময় শ্বাস নিতে সাহায্য করে। সাঁই সাঁই শব্দটা সাধারণত শ্বাস ছাড়ার সময় শোনা যায় এবং সঙ্গে অনেক সময় কাশি থাকে। বুক থেকে কোনো কফ ওঠে না। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কম হয়ে গিয়ে ঠোঁটের রঙ, জিভের রঙ নীলাভ হয়ে যেতে পারে। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় সায়ানোসিস। কষ্ট কয়েক ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েক দিন চলে। কাশির সঙ্গে ঘন কফ উঠে আবার হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট প্রশমিত হতে পারে। 

ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী হাঁপানিতে রোগীর সবসময় বুক সাঁই-সাঁই করে এবং একটু পরিশ্রম করলেই নিঃশ্বাসের কষ্ট হয়। কাশির সঙ্গে রোগীর তরল কফ নির্গত হয়। এ রোগীর প্রায়ই শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ লেগে থাকে।

asthma 1 1811110545

তাৎক্ষণিক রেহাইয়ের উপায়

হাঁপানি থেকে রেহাইয়ের তাৎক্ষণিক উপায় হল নিঃশাসের সঙ্গে স্যালবিউটামল জাতীয় ওষুধের ব্যবহার। যা স্পেসার ডিভাইসের ভেতর দিয়ে ইনহেলার অথবা নেবুলাইজারের মাধ্যমে রোগীকে দেওয়া যেতে পারে। তবে এই ওষুধ খুব অল্পক্ষণের জন্য কাজ করে (চার থেকে ছ’ঘন্টা)। অনেক সময় এই দুই যন্ত্রের সাহায্যে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুখ (Budesonide, Beclometasone, Fluticasone) দিয়েও রোগীকে তাৎক্ষণিক আরাম দেওয়া যেতে পারে।

কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?

শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেই শরণাপন্ন হতে হবে ডাক্তারের। আর যেসব হাঁপানি রোগী দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্টের জন্য কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে রয়েছেন তাদের উচিত একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারের পরামর্শমতো তাঁর কাছে যাওয়া, যাতে প্রয়োজন মতো ওষুধ কমানো/বাড়ানো বা রদবদল করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই যদি রোগী অনুভব করে যে সব মেনে চলেও তার কষ্ট ক্রমশ বাড়ছে, তাহলে তাকে ওই সময় অতিক্রান্ত হবার আগেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

হাঁপানির বিভিন্ন অবস্থা।

প্রাথমিক অবস্থা বলতে আলাদা করে কিছু বলা যায় না। বিজ্ঞানসম্মতভাবে হাঁপানি কে বর্তমানে চারটি স্টেজে ভাগ করা হয়

১) মৃদু ও ক্ষণস্থায়ী হাঁপানি

ক) হাঁপানির শ্বাসকষ্ট সপ্তাহে মাত্র দু’বার বা তার কম।

খ) বাড়াবাড়ির অন্তবর্তী সময় রোগীর টান থাকে না এবং লাং ফাংশন টেস্টে স্বাভাবিক পিক এক্সপিরেটরি ফ্লো বজায় থাকে। 

গ) বাড়াবাড়ি খুব বেশি স্থায়ী হয় না ( কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত চলতে পারে), তীব্রতা পরিবর্তিত হতে পারে।

ঘ) রাতে শ্বাসকষ্টের সম্ভাবণ মাসে মাত্র দু’বার বা তার কম।

ঙ) লাং ফাংশন টেস্টে – FEV1 or PEF ≥ 80% of Predicted, PEF variability < 20%.

২) মৃদু স্থায়ী হাঁপানি

ক) শ্বাসকষ্ট সপ্তাহে দু’বারের বেশি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র একবার বা তার কম হয়।

খ) শ্বাসকষ্টের বাড়াবাড়ির ফলে রোগীর কাজকর্ম ও স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়।

গ) রাতে শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা মাসে দু’বারের বেশি।

ঘ) লাং ফাংশন টেস্টে FEV1 or PEF ≥ 80% of Predicted, PEF variability 20-30%.

৩) মধ্যম মানের স্থায়ী হাঁপানি

ক) প্রতিদিনই শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়।

খ) প্রতিদিন রোগীকে তাৎক্ষণিক আরামের ওষুধ ব্যবহার করতে হয়।

গ) বাড়াবাড়ির ফলে রোগীর কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়। বাড়াবাড়ি স্থায়ী হতে পারে বেশ কিছু দিন।

ঘ) রাতে শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা সপ্তাহে একবারের বেশি। 

ঙ) লাং ফাংশন টেস্টে –– FEV1 or PEF> 60% – 80% of Predicted, PEF variability ≥ 30%.

৪) তীব্র এবং স্থায়ী হাঁপানি

ক) শ্বাসকষ্ট চলতেই থাকে। 

খ) শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস পায়।

গ) প্রায়ই বাড়াবাড়ি হয়। 

ঘ) রাতের শ্বাসকষ্ট প্রায়ই হয়ে থাকে।

ঙ) লাং ফাংশন টেস্টে FEV1 or PEF ≤ 60% of Predicted, PEF variability >30%

[ Ref. 1997, NHLBI guidelines EPR-2, 1997 থেকে সংগৃহীত হয়েছে। ]

দীর্ঘদিনের সর্দি কাশি, ধোঁয়া-ধুলোয় কি হাঁপানি হয়?

দীর্ঘদিনের সর্দি-কাশি বা ধোঁয়া ধুলোয় থাকলে ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে। যার পরিণতিতে আসে শ্বাসকষ্ট। কিন্তু দীর্ঘদিনের সর্দি-কাশি ধোঁয়া-ধুলো থেকে যে হাঁপানি হবেই, এমন কোনো কথা নেই।

হাঁপানি নির্ণয় করার উপায়

১) রোগের সম্পূর্ণ ইতিহাস গ্রহণ করে ডাক্তারকে দেখে নিতে হবে কীরকম অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আছে। রোগীর সম্পূর্ণ শারীরিক পরীক্ষা প্রয়োজন।

২) রক্তের সাধারণ পরীক্ষা (TC/DC/Hb%) শ্বেতকণিকার তুলনামূলক গণনা।

৩) রক্তের ইওসিনোফিল কাউন্ট দেখে নিতে হবে।

৪) টোটাল ও স্পেসিফিক আই.জি.ই. এস্টিমেশন।

৫) অ্যালার্জি স্কিন টেস্ট।

৬) মিউকাস মেমব্রেন প্রভোকেশন টেস্ট, ব্রঙ্কিয়াস মিউকাস মেমব্রেন প্রভোকেশন টেস্ট।

৭) পালমোনারি ফাংশন টেস্ট

হাঁপানি রোগের আধুনিক চিকিৎসা

১) হাঁপানির ওষুধ মূলত দুপ্রকারের হয়: প্রতিরোধক। যেমন—Sodium Cromoglycate, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ (যেমন –Beclometasone, Budesonide ও Fluticasone)। তাৎক্ষণিক আরামদায়ক থিওফাইলিন, সালবিউটামল, সালমেট্রল, টারবিউটালিন ইত্যাদি।

আজকাল বেশিরভাগ ওষুধ খাওয়ানোর পরিবর্তে নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিতে বলা হয় ইনহেলার বা রোটাহেলারের মাধ্যমে। তবে হাঁপানির শ্বাসকষ্ট খুব তীব্র হলে শ্বাসনালীর সঙ্কোচন এত বেশি হয় যে, ওইসব ওষুধ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে খাবার বড়ি বা ইঞ্জেকশন দিতে হয়। তবে খাওয়ার ওষুধে রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, ইনহেলারে ততটা থাকে না।

২) অ্যালার্জেন ডিসেন্সিটাইজিং ভ্যাকসিন থেরাপি করে ফুলের রেণু, ধুলো ও ছত্রাকের সংস্পর্শজনিত অ্যালার্জি (হাঁপানি)-র চিকিৎসা করা হয়।

হাঁপানি রোগের প্রতিকার

হাঁপানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে রোগীকে কতকগুলি নিয়মকানুন মেনে চলতেই হয়। যেমন-

১) যেসব জিনিস থেকে হাঁপানি শুরু হয়। যেমন—বিড়াল কুকুরের লোম, ঘরের ধুলো, বিছানার তুলো, খাদ্যসামগ্রী, নেশার জিনিস (তামাক) থেকে দূরে থাকতে হবে।

২) ধূমপান বর্জন। বিশেষত হাঁপানি রোগী যদি গর্ভবতী হন তাহলে তিনি অবশ্যই ধূমপান করবেন না। এবং সিগারেটের ধোঁয়া থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকবেন।

৩) রোমশ বা পালকযুক্ত পশুপাখি বাড়িতে রাখবেন না।

৪) বৃষ্টিতে ভেজা বা ঠান্ডা লাগানো থেকে সাবধান।

৫) বাড়িতে ফরাশ ও কার্পেট রাখা চলবে না। কারণ তাতে ধুলো ও ছত্রাক জমে হাঁপানির সৃষ্টি করতে পারে।

৬) ঘরের জানলা আলো হাওয়া চলাচলের জন্য খুলে রাখতে হবে।

৭) রান্নার ধোঁয়া বা গন্ধ যাতে নাকে না আসে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। কলকারখানার দূষিত ধোঁয়ায় হাঁপানি রোগীর শ্বাসকষ্ট বাড়ে। এটা এড়িয়ে চলা ভালো।

৮) পোকামাকড় মারার স্প্রে রোগীর নাকে যেন না ঢোকে। বাড়িতে চুনকাম রঙ হলে রোগীকে সে সময় দূরে থাকতে হবে।

৯) ডাক্তারের কাছে সময় মতো এবং দরকারমতো চেক-আপের জন্যে যেতে হবে।

১০) পুকুর বা নদীর দুষিত জলে হাঁপানি রোগীর স্নান না করাই ভালো।

১১) নিয়মিত যোগব্যায়াম খুবই ভালো। সহজ প্রাণায়ামও রোগীর পক্ষে উপকারী।

১২) অতিরিক্ত চিন্তা ভাবনা ত্যাগ করতে হবে।

১৩) স্কিন টেস্ট হল সবথেকে কম খরচে সব থেকে প্রয়োজনীয় এবং সঠিক পরীক্ষা। পরীক্ষায় প্রমাণিত অ্যালার্জি-সৃষ্টিকারী জিনিস থেকে দূরে অবশ্যই থাকতে হবে।

১৪) হাঁপানি প্রতিরোধক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। সম্পূর্ণ ডাক্তারি পরামর্শমতো।

নিয়ম পালন করে চললে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চেক-আপ করালে এই রোগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। হাঁপানি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য অসুখ না হলেও নিয়ম মেনে চলা রোগী বেশিরভাগ সময়েই নিজেকে সুস্থ রাখতে পারবেন।

জন্মগত প্রবণতা

যাদের বংশে হাঁপানি, সর্দি হাঁচি, আমবাত, একজিমা ইত্যাদি অ্যালার্জিজনিত রোগের ইতিহাস থাকে তাদের ক্ষেত্রে জন্মগত হাঁপানির সম্ভাবনা বেশি। বংশগতি ও পরিবেশজনিত প্রভাবে সেইসব বাড়ীর মানুষ অত্যন্ত অল্প বয়সেই হাঁপানিতে আক্রান্ত হতে পারেন।

কারা হাঁপানিতে বেশি ভোগেন

১) যাদের বংশে এলার্জিজনিত হাঁপানি, সর্দি-হাঁচি, আমবাত, একজিমা ইত্যাদি রোগ থাকে।

২) যারা পশুর লোমের সংস্পর্শে বা ঘরের জমে থাকা ধুলোর সংস্পর্শে বেশি আসেন, তাদের ক্ষেত্রে হাঁপানির প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

পথ্য-অপথ্য

হাঁপানিতে গগ্য ও অপথ্য বলে কিছু নেই। অ্যালার্জি স্কিন টেস্ট করে যেসব খাদ্যের অ্যালার্জেন পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়, সেইসব খাদ্যগুলো সম্বন্ধে রোগীকে সতর্ক করা হয়। এছাড়া অনেক হাঁপানি রোগীর পেটে গ্যাস, অম্বল হয়েও শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের উচিত সহজপাচ্য খাবার খাওয়া।

বাসস্থান কীরকম হওয়া উচিত?

আলো হাওয়াযুক্ত বাসস্থান (যেখানে হাওয়া চলাচলের জন্য পরস্পর- বিপরীতমুখী দরজা-জানলা থাকে অর্থাৎ ক্রশ ভেন্টিলেশন) হল হাঁপানি রোগীর পক্ষ্যে ভালো। দেওয়াল, মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে না হওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং রোমশ পশুপাখি বাড়ির ভেতরে রাখা উচিত নয়।

স্বাস্থ্যবিধি

১) হাঁপানি রোগীকে অ্যালার্জিজনিত প্রদাহ সৃষ্টিকারী জিনিস যেমন—ধোঁয়া, তুলো, ধূলো, পশুর-লোম ইত্যাদি সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে।

২) মাঝে-মাঝে প্রয়োজন মতো রক্তের সাধারণ পরীক্ষা (TC/DC/Hb%) ও রক্তের ইওসিনোফিলের সংখ্যা নির্ধারণের পরীক্ষা করাতে হবে।

৩) পালমোনারি ফাংশন টেস্টিং করে রোগীর শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ত্রুটি-বিচ্যুতি শনাক্ত করতে হবে।

৪) সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে।

ব্যায়াম: হাঁপানির কষ্ট থেকে রেহাই পাবার জন্য বিভিন্ন ধরনের যোগব্যায়ামের সাহায্য নেওয়া যায়। যেমন—মৎস্যাসন, ধনুরাসন ইত্যাদি। এছাড়া সহজ প্রাণায়ামের সাহায্যেও শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট দূর করা যেতে পারে। নিয়মিত অভ্যাস করলে ফুসফুসের সঙ্কোচন ও প্রসারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়

এছাড়া বেলুন ফোপানো বা শাঁখ বাজানো অভ্যাস করলেও হাঁপানি রোগীর উপকার হয়।

স্নান : শীতের দিনে খুব ঠাণ্ডা জলে স্নান না করে ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করতে হবে। পুকুর বা নদীর দূষিত জলে স্নান না করাই ভালো।

পোশাক: হাঁপানি রোগীর উচিত ঢিলেঢালা পোশাক পরা, যেটা তার বুকে বা পেটে চাপ সৃষ্টি করে শ্বাসকষ্টের মাত্রা না বাড়তে পারে।

হাঁপানি সত্ত্বেও কীভাবে কাজকর্ম করা যাবে?

অ্যালার্জিজনিত হাঁপানি থেকে সম্পূর্ণরূপে ভালো হওয়া কঠিন, তবে হাঁপানি রোগ সহজেই নিয়ন্ত্রণে এনে জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ভালোভাবেই করা যায়। এই নিয়ন্ত্রণ আনা যায় দু’ভাবে : অ্যাভয়ডেবল অ্যালার্জেন, যেমন—খাবার জিনিস, পশুর লোম ইত্যাদি এড়িয়ে চলে। এবং আন-অ্যাভয়ডেবল অ্যালার্জেন, যেমন—ফুলের রেণু, ধুলোর ক্ষেত্রে তিন ডিসেন্সিটাইজেশন থেরাপির সাহায্য নিয়ে। আর ঘরের ধুলো, সিগারেটের ধোঁয়া থেকে পুরোপুরি সরে না থাকতে পারলেও যতদূর সম্ভব সাবধানে থাকতে হবে। এছাড়াও হাঁপানি রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতিরোধক ওষুধপত্র ও তাৎক্ষণিক আরামের ওষুধপত্র ব্যবহার করেও স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব।

হাঁপানির চিকিৎসা

সঠিক চিকিৎসা হাঁপানি নিয়ন্ত্রণের বড় উপায়। তবে হাঁপানির চিকিৎসা সঠিকভাবে করাতে হলে তিনটি স্তরে ভাগ করে নিতে হবে।

১) হাঁপানির সঠিক নির্ণয়, ২) হাঁপানির কারণ নির্ণয়, ৩) উপরোক্ত দুটি স্তরের ওপর ভিত্তি করে হাঁপানির চিকিৎসা—

আকিউট স্টেজের জন্য তৎকালীন চিকিৎসা এবং ক্রনিক স্টেজের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা।

দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ

হাঁপানি চিকিৎসার আদর্শ স্থান হল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখনে একই ছাদের তলায় এই সবকটি স্তরের চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে পালমোনোলজিস্ট, অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞ, প্যাথলজি, রেডিওলজি এবং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-এর সুব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। যাতে কোনো রোগী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সুচিকিৎসা সম্ভব হয়। একবার হাঁপানির কারণ নির্ণয় করা হয়ে গেলে এবং তার কষ্টের তীব্রতা কমে গেলে তার গৃহ-চিকিত্সকই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন।

রাস্তার পোস্টার ও হাঁপানি

বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম বা রাস্তার পোস্টার দেখে হাঁপনি রোগীর ওষুধ নির্বাচন করা একেবারেই উচিত নয়। সবসময় অভিজ্ঞ চিকিৎসকই পারেন সঠিক অবস্থা নির্ধারণ করে সঠিক পরামর্শ দিতে। কারণ হাঁপনিরও প্রকারভেদ আছে এবং সব ধরনের হাঁপানিতে সব ওষুধ সমানভাবে দেওয়া চলে না। সুতরাং হাতুড়ে থেকে সাবধান। এতে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘাটে যাওয়া অসম্ভব নয়।

বাচ্চাদের হাঁপানি কি সর্বদাই জন্মগত?

কিছু কিছু ক্ষেত্রে (বংশগতির কারণে) হাঁপানি জন্মগত হলেও বাচ্চাদের হাঁপানি সর্বদাই জন্মগত হবে এমন নয়। বাচ্চাদের শ্বাসনালী অপেক্ষাকৃত সরু বলে সহজেই ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের সংস্পর্শে এসে প্রদাহ সৃষ্টি হয় ও খুব অল্প আক্রমণেই তাদের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসনালী মোটা হওয়ায় ধীরে ধীরে এই শ্বাসকষ্ট কমে যায়।

জন্মগত হলে কী করণীয়?

জন্মগত হলে পিতা-মাতার প্রথম কাজ হল, শিশুকে কোনো শিশু-বিশেষজ্ঞের কাছে পরীক্ষা করানো। অ্যালার্জিজনিত হাঁপানি বলে চিহ্নিত হলে শিশুকে ধুলো, ধোঁয়া, সিগারেটের ধোঁয়, পশুপাখির লোম—এসব জিনিস থেকে দূরে রাখতে হবে। তুলো-ঠাসা খেলনা দেওয়া যাবে না। কোনো বিশেষ খাদ্যে হাঁপানির কষ্ট অনুভূত হলে, সে খাবার তাকে দেওয়া চলবে না। হাঁপানি-প্রতিরোধক ওষুধ ও তাৎক্ষণিক আরাম দেওয়ার ওষুধপত্র ডাক্তারের পরামর্শমতোই ব্যবহার করতে হবে। একটু বড় হলে অ্যালার্জি স্কিন টেস্ট করে অ্যালার্জির কারণগুলি নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে হবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular