Sunday, May 12, 2024
Homeমানসিক স্বাস্থ্যNeonatal Care: নবজাতকের পরিচর্যা

Neonatal Care: নবজাতকের পরিচর্যা

প্রত্যেক পরিবারের কাছে নবজাত শিশুই তার বর্তমানের আনন্দ, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। প্রত্যেক মা-বাবাই নবজাতককে তাদের অস্তিত্বের নিদর্শন হিসেবে রেখে যেতে চান। তাই সংসারে যে নতুন অতিথির আগমন ঘটল তাকে নিয়ে মা-বাবার আনন্দের যেমন শেষ থাকে না, তেমনি দুশ্চিন্তারও শেষ নেই। তাকে কী করে ভালো রাখা যায়, তাই নিয়েই মা-বাবা ব্যস্ত থাকেন। এখনকার দিনে চিন্তা আরো বেশি, কারণ এখন বড় জোর একটি বা দুটি বাচ্চা নেওয়া হয়। তাই অনভিজ্ঞ মা-বাবা বুঝতে পারেন না কীভাবে শিশুর যত্ন নেওয়া উচিত। অজ্ঞতার কারণে বা প্রতিবেশি সাবেকি দাই বা বয়স্কদের কথামতো এমন কিছু কাজ করা হয়, যা করা উচিত নয়। যেমন স্নান করানো। অনেক পরিবারে শিশু জন্মানোর সাথে সাথে তাকে স্নান করিয়ে দেওয়া হয়। এটা একদম উচিত নয়। 

আসুন, যুক্তির এবং বিজ্ঞানের আলোকে দেখি নবজাতকের পরিচর্যা ৷

প্রাণ ভরে দাও আরো প্রাণ,
দাও আরো মুক্ত শুদ্ধ বায়ু
আলো, আরো আলো দাও,
দাও মোরে অক্ষয় পরমায়ু

এটাই শিশুর কচি কণ্ঠের কাতর আবেদন তার ভূমিষ্ট হবার ক্ষণে। শিশুর ভূমিষ্ঠ হবার ক্ষণটি তার নিজের এবং পরিবারের কাছে সারা জীবন মনে রাখার মতো ঘটনা। পরিবারের সবাই সেই ক্ষণে শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে শিশুকে স্বাগত জানায় ৷ সেই মুহূর্তে আকাশে-বাতাসে আলোড়ন ওঠে, সে এসেছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছে খবর ছোটে। আর আকাশে সেই সময় যত সব গ্রহ-নক্ষত্র থাকে তারা শিশুর ভাগ্যলিপি লিখতে বসে যায়। কোন রাশি, কোন লগ্ন, বৃহস্পতির দশা কী; শুক্র কোথায়, শনির প্রকোপ কেমন হবে ইত্যাদি। সবাই শিশুকে তার নিজের মতো করে গ্রহণ করে নেয়।

কিন্তু যে এল, সে কীভাবে এল? কোথায় এল? তার কাছে পৃথিবী কেমন? কোথা থেকে এল? কোন পরিবেশে এল? আসুন, দেখে নিই নবজাতকের পরিচর্যা।

এতদিন শিশু মায়ের জঠরে ছিল মায়েরই একটি অংশ হয়ে। এই প্রথম শিশু তার নিজের অস্তিত্বে ফিরে এল। একদিকে তাকে খেতে হবে, শ্বাস নিতে হবে, বাঁচতে হবে। অথচ করার কিছু নেই। ধরে খাবার ক্ষমতা নেই। কীভাবে খেতে হবে জানে না। কাউকে কিছু বলে বোঝাতে পারে না। চাইতে পারে না। এমনকী কম ওজনের ছোট শিশুর খাওয়ার ক্ষমতাও থাকে না।

যেখান থেকে এল, সেখানকার তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রায়। আর এসে পড়ল কোথায়? শীতের দিনে ১০ বা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, গরমে ২৫-৩০ ডিগ্রিতে। অর্থাৎ হঠাৎ তাপমাত্রা কমে গেল ৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি। কেউ কি দেখেছেন, এমন হলে কেমন লাগে? আমাদের হঠাৎ করে বরফের ঘরে ঢুকিয়ে দিলে যেমন লাগবে, প্রায় সেরকমই। ঠান্ডা অথচ ঠান্ডা লাগলেও বলার উপায় নেই। কিছুই বলতে পারে না সে। তার উপর যদি ঠাকুমা, দিদিমারা তাকে স্নান করায়, তবে ?

এ তো পরের ব্যাপার। তার আগে আরো আছে। আমরা জানি অক্সিজেন না হলে মানুষ এক দন্ড বাঁচে না। আমাদের শ্বাস নেবার সময় বাতাসের অক্সিজেন ফুসফুসের মধ্যে দিয়ে রক্তে ঢোকে। রক্তের হিমোগ্লোবিন তাকে ধরে নিয়ে কোষে কোষে পৌঁছে দেয়। গর্ভাবস্থায় এই অক্সিজেন ধারণ করার কাজটি করে দিত মা ৷ মায়ের রক্ত থেকে হিমোগ্লোবিন যেত ভ্রূণের রক্তে। কিন্তু জন্মাবার পর মুহূর্তে? নাড়ি কাটার সাথে সাথে মায়ের কাছ থেকে অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ হল। নবজাতক নিজে জন্মাল তার ফুসফুস ভর্তি জল নিয়ে। সেখানে কোনো হাওয়া নেই। জন্মাবার পদ্ধতির বিভিন্ন ধাপে এদিক-সেদিক চাপ খেয়ে কিছুটা জল বেরিয়ে গেল। কিছুটা থাকল ফুসফুসে ভর্তি হয়ে।

কিন্তু শিশুকে বাচতে হবে। অক্সিজেন চাই- ‘ই চাই। ঠান্ডায় কাপলে চলবে না। আগে বাঁচা, তারপর অন্য সব। হাওয়া চাই, অক্সিজেন চাই। আর এই পরিস্থিতিতেই সে নিজের বাঁচার জন্যই চিৎকার করে শ্বাস নেবার চেষ্টা করল। বাইরের লোক শুনল, ম্যা ম্যা, প্যা প্যাঁ। শাঁখ বাজল, উলুধ্বনি শুরু হল। দিকে দিকে বার্তা রটে গেল। ডাক্তার নিশ্চিন্ত হল, দাই নিশ্চিত্ত হল। বাচ্চা কেঁদেছে।

কিন্তু কোনও কারণে, শারীরিক অক্ষমতার জন্যে বা অপুষ্টির জন্যে যদি সে শ্বাস নিতে না পারে? তখন? তখন তার শরীর নীল হতে শুরু করে। আরো নীল। নেতিয়ে যায় একেবারে। এবং আশেপাশে থাকা ডাক্তার-বদ্যি-সিস্টার মিলে তাকে কাঁদাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে। শুধু একবার কাঁদুক। একবার শ্বাস নিক। অক্সিজেন আসে, যন্ত্রপাতি আসে। তা সত্ত্বেও কাজ না হলে নবজাতকের মস্তিষ্কের কোষ মরতে শুরু করে। আর মস্তিষ্কের কোষ মরে গেলে আর জন্মায় না, সারা জীবনের জন্য সেই কোষ অকেজো হয়ে যায়। ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘সেরিব্রাল এনোক্সিয়া ‘। ফল, বাচ্চার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় না। না মানসিক, না শারীরিক। সে চলতে পারে না, বলতে পারে -না। মা-বাবার সারা জীবনের দুঃখ ও বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ রোগের ডাক্তারি নাম ‘সেরিব্রাল পলসি‘। কম ওজনের শিশুদের বা আগে জন্মানো শিশুদের এই রোগ বেশি হয়। কাজেই শিশু গর্ভাবস্থায় যাতে ঠিক বাড়ে, পুষ্ট হয়, তা নিশ্চিত করতে মায়ের গর্ভাধান হবার পর থেকেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সব আয়োজন সত্ত্বেও কিছু নবজাতককে শ্বাস নেওয়ানো যায় না। সেখানেই তার পরমায় শেষ। যে অসীম থেকে সে এসেছিল, সেখানেই সে ফিরে যায়। যারা শ্বাস নিল অর্থাৎ অক্সিজেন ধরতে পারল, তাদের রক্তের কাজ হল সেই অক্সিজেনকে বিভিন্ন কোষেও পৌঁছে দেওয়া। আর এই রক্ত চালানোর পাম্পের কাজ করে হৃদযন্ত্র। শিশুর হৃদযন্ত্র গর্ভাধানের ছ’-আট সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শুরু করে। কাজেই কাজটা তার কাছে নতুন নয়। কিন্তু গর্ভাবস্থায় তাকে মায়ের রক্ত নিয়ে চলতে হত, মা সেটি শোধন করে দিত। এখন সে নিজেই এসব করছে। কাজেই হৃদযন্ত্রের কাজ কিছু এদিক-ওদিক করতে হয়, হৃদযন্ত্রের অনেক ফুটো বন্ধ করে দিতে হয়। সারা শরীরবৃত্তীয় কাজে একটা আমুল বোঝাপড়া করে নিতে হয়। অক্সিজেন সহজে পেলে এই কাজগুলো সহজে হয়। অক্সিজেন না পেলে এখানেও গোলমালের সম্ভাবনা থাকে। জন্ম থেকেই হৃদযন্ত্র অস্বাভাবিক থেকে যায়।

এবার আগের কথায় আসি। সেই তাপমাত্রার কথাটা। দেখি, যার জন্যে এতসব আয়োজন, এত কোলাহল, সে এল যেখান থেকে সেটা কেমন জায়গা। কোথায় ছিল সে এতদিন?

neonetal care

চল্লিশ সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে সে শরীরের আকার পেয়েছে। শুরু করেছিল একটি কোষের থেকে, যা তার মায়ের শরীরেরই একটি অংশ ছিল। তারপর সেটা নিবিত্ত হল। পিতার শুক্রাণুতে। শুরু হল কোষ বিভাজন। একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি। তারপরে অনেক, অসংখ্য। তৈরি হল ভ্রূণ। ভ্রূণের হাত-পা গজাল, মুখ তৈরি হল, অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হতে থাকল।

এ যেন নরম একতাল মাটি। তার উপর বিধাতা নিজের হাতের পালকের হালকা ছোঁয়ায় একটু একটু করে এঁকে দিচ্ছেন তার সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর বস্তুটিকে। একটুও চাপ না লাগে। লাগলে গলে যাবে বা বেঁকে যাবে। তাকে রাখতে হবে এমন জায়গায়, যেখানে কোনো আঘাত লাগবে না। তাই জঠরে শিশুর চারদিক ঘিরে রাখে জলের মতো অ্যামনিওটিক ফ্লুইড। শিশু জলে ভাসতে থাকে।

তাকে রাখতে হবে এমন তাপমাত্রায়, যেখানে ঠান্ডা-গরমের ভয় নেই। তাপমাত্রা সব সময় মায়ের শরীরের সমান। বিধাতা তার জন্যে সব কিছুই করে রেখেছেন। কারণ একটু এদিক ওদিক হলেই বিকৃত হবে তার শিল্পকর্ম, বিকৃত হবে নবজাতক, বিকৃত হবে মানুষের উত্তরসূরি। তা কোনো মতেই হতে দেওয়া যাবে না। তাই তার স্থান হল মাতৃজঠরে। ডাক্তারি পরিভাষায় ইউটেরাসের মধ্যে।

জঠর বা ইউটেরাস কেমন? 

baby position in womb

এর তুলনা চলে ফুটবলের সাথে। হাওয়ার বদলে যদি ফুটবলের ব্লাডারে জল ভরা হয়, তবে যেমন হত অনেকটা সেরকমই। বাইরে মাংসল শক্ত আবরণ। তার মধ্যে রাবারের মতোঁ অ্যামনিওটিক ক্যাভিটি। তার মধ্যে জল। সেই জলের মধ্যে আলতো ভাবে শুয়ে থাকে মানব সন্তান।

সেখানে ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, গরম নেই, ঠান্ডা নেই। সবসময় তাপমাত্রা ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। মায়ের রক্তের বা শরীরের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা। একমাত্র মায়ের সাথেই তার সম্পর্ক। কোনো কারণে মায়ের শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামা করলে তবেই সেখানকার তাপমাত্রার পরিবর্তন হবে কিন্তু সেখানেও বিপদ। বেশি ওঠা-নামা সে সইতে পারে না। এ যেন সেই জগন্নাথের মূর্তি তৈরি। বিধাতা কারিগর অন্ধকার জঠরে বসে তৈরি করছেন মানব শিশু। শর্ত দিয়েছেন, কোনোরকম তাপ, চাপ, আঘাত এলেই সে ত্যাগ করে যাবে, অপূর্ণ রেখে যাবে তার সৃষ্টি। নিক্ষেপ করে দেবে জঠরের বাইরে। আর তখনই অপূর্ণ অবস্থায় বেরিয়ে আসবে মানবের উত্তরসুরি – প্রাণ -অবস্থায়। বাইরে থেকে আমরা বলব মিসক্যারেজ। সাদা বাংলায় গর্ভপাত।

সেইজন্য গর্ভবতী মায়েদের রাখতে হয় আলতো করে। তাদের শরীরের ওপর নজর দিতে হয় সব সময়। গর্ভবতী মায়েদের জ্বর বেশি হলে সমস্যা। সমস্যা পায়খানা-বমি হয়ে গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলে। তেমনি যে কোনো আঘাত থেকেও তাকে থাকতে হবে দূরে, যাতে বিধাতার শর্ত না ভাঙে।
তাপমাত্রার থার্মোস্ট্যাট রয়েছে মাথার মধ্যে হাইপোথ্যালামাসে। সে নিয়ন্ত্রণ করছে শরীরের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের দিনে বাইরের তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি হলেও তাপমাত্রার তফাৎ হল ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। কাজেই যে শিশু নতুন আলো দেখবে বলে এল, সে প্রথমেই এল বরফের দেশে। তার শ্বাস নেবার ক্ষমতা জন্মায়নি, চোখে তখনও আবছা দেখে, কথা বলতে পারে না। হাত-পা বের করেই বুঝল বরফের দেশে এসেছে। সে তাপমাত্রা বাড়াতে চেষ্টা করল, কাঁপতে শুরু করল, হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল যাতে পেশির সংকোচন-প্রসারণের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়। তখন তার দরকার উষ্ণ অভ্যর্থনা। গরম ঘরে, গরম কাপড়ে, গরম হাতে। সেই জন্মমুহূর্তে বাড়ির লোকের বা মায়ের কিছু করণীয় নেই। হাসপাতালের ডাক্তার বদ্যিরা তা করেন। কিন্তু তারপরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাকেই তার কোলের মধ্যে শিশুকে জড়িয়ে নিয়ে থাকতে হবে। মায়ের শরীরের গরমেই সে গরম থাকবে। মায়ের গায়ের গন্ধ, দুধের গন্ধের মধ্যে সে ধীরে ধীরে নিশ্চিন্তে বড় হয়ে উঠবে। চোখ মেলে সে মাকেই আগে দেখবে। তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয় স্থল তার মা। আর আমরা স্লোগান তুলব ‘মায়ে ছায়ে গায়ে গায়ে’। না, কোনো আলাদা গদি নয়, হিটার নয়, মা-ই তার সবকিছু। সব শিশুর জন্মমুহূর্ত তাই শুধু পরিবারের কাছে নয়, তার নিজের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ বাঁচা-মরার লড়াই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular