নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অধিকাংশ মানুষের জীবনে জরায়ুর মধ্যে থাকা প্রথম ৩৮ সপ্তাহ তার পরবর্তী জীবনের ৩৮ বছরের থেকেও বেশি ঘটনাবহুল, বেশি বিপদসংকুল ও দুর্ঘটনা পূর্ণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় প্রয়োজন গর্ভবতীর বিশেষ যত্ন, বিশেষ পরিচর্যা। এই পরিচর্যা যে দেশে যত উন্নত, সেই দেশে গর্ভজনিত কারণে মা ও শিশুর মৃত্যুর সংখ্যা কম, উন্নতশীল দেশে, গর্ভজনিত কারণে মায়েদের মৃত্যুর সংখ্যা পশ্চিমের উন্নত দেশের তুলনায় প্রায় ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি।
গর্ভধারণ কোন রোগ নয়। এটি একটি শারীরবৃত্তি আবস্থা মাত্র। প্রথম গর্ভের জন্য সর্বাপেক্ষা ভালো বয়স হল ২৩ বছর। তবে, মা হওয়ার পূর্বে তার শরীর মা হওয়ার উপযুক্ত কিনা তা অবশ্যই পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। কোন রকম অসুখ, যা মা হওয়ার জন্য বেশি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তা গর্ভসঞ্চারের আগেই সতর্কতার, সাথে সারিয়ে নেওয়া ভালো।
Table of Contents
গর্ভাবস্থায় শারীরিক সমস্যা ও সমাধান
বমিভাব বা বমি করা :- বিশেষত, সকালবেলা, বিছানা থেকে ওঠার পরে এরকম হয়, প্রথম গর্ভাবস্থায় সাধারণত এটা বেশি হয়। ঋতুবন্ধের মাস থেকে অথবা, তার পরের মাস থেকে শুরু হয় এবং গর্ভের প্রায় একশো দিন পরে এই উপসর্গ দূর হয়। এই বমি ভাবের কারণ সঠিক জানা যায়নি। সম্ভবত, এইচ. সি.জি. হরমোনের প্রভাবে অথবা মানসিক বা আবেগজনিত কারণে হয়ে থাকে বলে অনুমান করা হয়। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গর্ভবতীকে আশ্বস্ত করা হয়। সকালে বিছানা থেকে উঠে একটু হাত-পা নাড়া, পায়চারি করা ভালো, বিছানা থেকে নেমেই, বা বিছানায় বসে, শুকনো টোস্ট, বিস্কুট খেতে খেতে পায়চারি করলে গা-বমি ভাব কমে যায়। খালিপেটে চর্বিজাতীয় খাবার বা তরল পদার্থ না খেলে ভালো। তবে বমি বেশি হলে| প্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে হয়, গ্লুকোজও সাহায্য করে বমি বন্ধ করতে।
ঘন ঘন প্রস্রাব :- গর্ভাবস্থায় সচরাচর ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। বিকাশমান জরায়ু, প্রস্রাবের থলিতে চাপ দেওয়ার জন্য অথবা প্রস্রাব থলিতে রক্ত চলাচলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার জন্য এটা হয়। তবে, প্রস্রাবের সঙ্গে জ্বালা থাকলে প্রস্রাবের সংক্রমণ হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। এর জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য :- গর্ভাবস্থায় শারীরিক পরিবর্তন পাচন ক্রিয়া কে প্রভাবিত করে। ফলে, কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। এর জন্য বেশি পরিমাণ জল-দিনে ৬ থেকে ৮ গ্লাস, জলীয় আহার, ফল, শাকসবজি খেতে হবে। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর না হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ মত ক্রেমাফিন, মিল্ক অফ ম্যাগনেসিয়া, ইসবগুলের ভুসি খেলে উপকার পাওয়া যায়।
বুকজ্বালা/অম্বল :- গর্ভাবস্থায় বুকজ্বালা বা অম্বল অতিসাধারণ ঘটনা। বৃদ্ধি জ্বালা বা অম্বল অতি সাধারণ ঘটনা। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জরায়ু পাকস্থলিকে ওপরের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য এটা হয়। এছারা, হরমোনের জন্যও এটা হতে পারে। অম্বল, বুকজ্বালা এড়ানোর জন্য হালকা খাবার প্রতিদিন এক সময় খাওয়া অভ্যাস করতে হবে, প্রচুর জল খাওয়া দরকার। তাতে শরীরে এই সব অসুবিধা থাকবে না।
সংক্রমণ :- এই সময়ে যাতে সংক্রমণ না হয় তার সাবধানতা নিতে হবে সবসময়। ছোটোখাটো সমস্যা, সর্দিকাশি, কানে ব্যথা ইত্যাদি হলে তা তাড়াতাড়ি সারাতে হবে। এই সময়ে বিকাশমান শিশু ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জরায়ু পেটের ভিতর বেশি জায়গা দখল করে নেয় বলে শ্বাস চলাচলে বাধা আসে। শিশু জন্মের পর ওই কষ্ট চলে যায়, তবে বেশি শ্বাসকষ্ট অনবরত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পিঠে ও কোমরে ব্যথা :- গর্ভ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহভঙ্গিমায় পরিবর্তন ঘটে। জরায়ুর আকার ক্রমশ বেড়ে ওঠা ও শ্রেণীর হাড়ের সংযোগস্থলের শিথিলতার জন্য পিঠে বা কোমরে ব্যথা হয়। সাধারণত, গর্ভাবস্থার শেষদিকে কোমরে ব্যথা হয়। হরমোন জনিত কারণে, ত্রুটিপূর্ণ ভঙ্গির ফলে পেশিতে টান পড়ার জন্য, প্রস্রাবের সংক্রমণের জন্য অথবা, কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য সাধারণত কোমরে ব্যথা হয়। সঠিকভাবে হাঁটাচলা ও শক্ত বিছানায় বিশ্রাম করলে উক্ত সমস্যা দূর করা সম্ভব হয়। এছাড়াও, ব্যথা কমার ওষুধ, পিঠ ও কোমরের পেশি মালিশ ও বিশ্রাম পেশির টান জনিত ব্যথা দূর করতে পারে।
পায়ে খিল ধরা গর্ভাবস্থায় এটাও একটা সাধারণ সমস্যা। রক্ত ধর্মনীর ওপর স্ফীত জরায়ুর চাপের জন্য এটা হয়। রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমের জন্য অথবা ফসফরাসের পরিমাণ বেশির জন্য হয়। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ক্যালশিয়াম, ম্যাগনোশিয়াম, ভিটামিন-বি, প্রত্যহ খেলে ভালো হয়।
ভেরিকোজভেন্স :- এ সময়ে এ ধরণের সমস্যা বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়। ভেরিকোজ ভেন্স হল শিরার স্ফীতি, যা সাধারণত পায়ের নীচের অংশে হয় এবং যা ওপরের দিকেও এগিয়ে আসতে পারে। বর্ধিত জরায়ু যখন পেটের ভিতর শিরায় চাপ দেয়, তখন পা থেকে রক্ত ফেরার বাধার সৃষ্টি হয়। হরমোজনিত শিথিলতা তার জন্য এই সমস্যা হতে পারে। বিশ্রামের সময় পা দুটি বালিশের ওপর রাখলে উপকার পাওয়া যায়। গর্ভাবস্থায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও উচিতনয়। গর্ভাবস্থায় পা ফোলা থাকতে পারে। তার জন্য কম নুন, বেশি প্রোটিন যুক্ত খাবার খেলে এবং পর্যাপ্ত পরিশ্রম করলে, এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়। গর্ভাবস্থায় চামড়ার প্রসার হয়, ফলে চামড়ার কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে। তবে, স্তনে, পেটে অলিভ অয়েল, এলোভেরা ইত্যাদি তেল মালিশ করলে চামড়ায় দাগ কমাতে সাহায্য করে।
সাদাস্রাব :-গর্ভাবস্থায় যোনি নিঃসৃত স্রাব এর পরিমাণ আপনা থেকেই বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবাকে আশ্বস্তকরা হয় এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে উপদেশ দেওয়া হয়। তবে স্রাবের রঙ হলুদ বা দুর্গন্ধময় হলে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকার সবচেয়ে প্রধান শর্ত হল গর্ভবতীর মানসিক স্থিরতা। সামাজিক ও বাস্তব পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। শুধু শুধু টেনশন করে নিজের ক্ষতি না করাই ভালো। গর্ভাবস্থায় টুকটাক ছোটখাটো কাজ, ভাল বই পড়া গানবাজনা, গল্প, অল্প-স্বল্প বেড়ানো-ইত্যাদির মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে অবশ্যই ভালো থাকবেন।