মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল হৃদযন্ত্র। হৃদযন্ত্রের জটিলতার জন্য সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান। হৃদযন্ত্রের দুর্বলতাজনিত অসুখগুলিকে বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসকেরা ‘কার্ডিও ভাসকুলার ডিজিজ’বা ‘সিডি’নামে অভিহিত করে থাকেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দারা বিশেষত ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশের শহরের মানুষদের জীবনযাত্রার মধ্যে গত কুড়ি বছরে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন রকম বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম আমাদের হাতের নাগালে এসে আমাদের জীবনযাত্রা অনেকাংশেই যান্ত্রিক করে তুলেছে। বিভিন্ন রকম ফাস্ট ফুড আমাদের খাদ্য তালিকায় ঢুকে পড়ে আমাদের দেহে স্নেহ জাতীয় পদার্থের পরিমাণ অনেকাংশেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানব শরীরের ধমনীতে যদি স্নেহ জাতীয় পদার্থ ক্রমশ জমতে শুরু করে তাহলে ধমনীর ভিতরের দেওয়ালের চারপাশ ক্রমশ সরু হয়ে আসে এবং তার ফলে বিভিন্ন রকম জটিলতা দেখা দেয়।
ধমনীর দেওয়াল সরু হয়ে রক্ত চলাচলের পথ রুদ্ধ হলে সেই অবস্থাকে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস বলা হয়। ফলে হৃদযন্ত্রে রক্ত পৌঁছতে গেলে ধমনীর ওপর চাপ পড়ে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় ৷ এতে হৃদযন্ত্রের ওপরে চাপ পড়ে। যার থেকে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে বা হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। আজকাল বিভিন্ন রকম ফাস্ট ফুডের মধ্যে কোলেস্টেরল জাতীয় স্নেহ পদার্থের পরিমাণ অত্যধিক রকমের বেশি থাকার জন্য মধ্য বয়সিদের মধ্যেও প্রায়শই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হার্ট অ্যাটাকের কথা শোনা যায় ৷
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমাদের জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস কার্ডিও ভাসকুলার ডিজিজের অন্যতম প্রধান কারণ। এই রোগের পিছনে তৃতীয় প্রধান কারণটি জিন বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি খুঁজে পেয়েছেন। জিন বিজ্ঞানীরা ভারতীয়দের দেহের কোষের মধ্যে এমন কয়েকটি জিনের পরিবর্তন দেখেছেন যেগুলোর সাথে হৃদযন্ত্রের কার্যকারণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
হৃদযন্ত্রের সম্বন্ধে সম্যকভাবে জানতে গেলে রোগীর পারিবারিক ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। আগে তার পরিবারের কেউ হৃদযন্ত্রের দুর্বলতার শিকার হয়েছিলেন কি না সেটা জানা অত্যন্ত জরুরি। তারপর সেই রোগীর রক্ত থেকে সবরকম স্নেহ জাতীয় পদার্থের শনাক্তকরণ করা হয়। যেমন কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইড, VLDL, LOL, HDL ইত্যাদি। এর পরে রোগীর রক্ত থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে ডি.এন.এ-কে আলাদা করে নেওয়া হয়। এই ডি.এন.এ অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে একে খুব কম তাপমাত্রায় – ২০° সেন্টিগ্রেডে ফ্রিজে রাখতে হয়। রোগীর এই ডি.এন.এ থেকে প্রথম যে জিনটি পরীক্ষা করা হয় তার নাম এ.সি.ই (ACE)।
এই উৎসেচকটি রক্তের অ্যাঞ্জিওটেনসিন- ১ কে অ্যাঞ্জিওটেনসিন-২ তে পরিণত করতে মধ্যস্থতা করে। A-II আবার ব্র্যাডিকাইনিন নামক এক পদার্থকে রক্ত দেয় যা ধমনী ও শিরার সংকোচনে সাহায্য করে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে কোনো কারণে ACE-র পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্তচাপ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায় ও হাইপারটেনশনের লক্ষণ দেখা দেয়। যা থেকে হৃদযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক ডেকে আনতে পারে। মাবনদেহে ACE-র তিন ধরনের বহুরূপতা বা পলিমরফিজম দেখা যায়। এর কারণ জিনের মধ্যে ডি.এন.এ-র পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জিনের দৈর্ঘ বৃদ্ধি পায় ও অপর ক্ষেত্রে পায় না। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যে জিনের দৈর্ঘ কম তাদের ক্ষেত্রে ACE-র পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও হাইপারটেনশনের আশঙ্কা থাকে।
জীবকোষের ১৭নং ক্রোমোজোমে উপস্থিত ACE ও ১৯নং-এ APOE জিনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
- ACE দৈর্ঘ ব্র্যাডিকাইনিন বেশি পরিমাণ ফলে সুস্থ শিরা ও ধমনীর সংকোচন।
- মধ্যম দৈর্ঘ্য বা বলা যেতে পারে আমাদের প্রতিটি কোষে একজোড়া ক্রোমোজোমে যে কোনো একটির দৈর্ঘ্য ছোট। স্বাভাবিক পরিমাণে ব্র্যাডিকাইনিন প্রস্তুত না হবার ফলে রক্তচাপের অস্বাভাবিকতা দেখা যায় ।
- দুটি ক্রোমোজোমে ACE জিনের দৈর্ঘ ছোট, ফলে ব্র্যাডিকাইনিনের পরিমাণ কম থাকায় শিরার রক্ত চাপ বৃদ্ধি পায় ।
অপর একটি জিনের নাম অ্যাপোলিপো-প্রোটিন। এই প্রোটিনকে ও রক্ত থেকে কোলেস্টেরল G সাইক্লোমিক্রন (Chlylomicron) জাতীয় স্নেহ পদার্থকে বর্জ্য হিসাবে বের করে দেয়। এই জিনেরও চার ধরনের বহুরূপতা দেখা যায়। এদের যথাক্রমে ১, ২, ৩, ৪ নাম দেওয়া হয়েছে। রক্তের মধ্যে APOE ২, ৩, ৪-এর পরিমাণ বেড়ে গেলে এই প্রোটিনটি আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। তার ফলে রক্তের মধ্যে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গবেষণাগারে রোগীর রক্ত থেকে এই দুটি জিনের বহুরূপতায় সঠিক রোগটি নিশ্চিতভাবে চিহ্নিতকরণ করা হয়। তার ফলে কোন বহুরূপতার সাথে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি তা ৫-৮ বছর আগেই আন্দাজ পাওয়া যায়। রোগীর পারিবারিক ইতিহাস, রক্তের গ্রুপ ও অন্যান্য স্নেহজাতীয় পদার্থের পরিমাণ হৃদরোগের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। এইভাবে আধুনিক জিন বিজ্ঞানের সাহায্যে হৃদরোগের প্রকৃতি ও কারণ নির্ণয় করতে পারবেন। এছাড়া হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে এর বিরুদ্ধে সঠিক ক্লিনিক্যাল ইন্টারভেনশন করে জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে হৃদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা আশা রাখি যে এই আধুনিক পরীক্ষা ভারতীয় জনগণের মধ্যে হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশেই নির্মূল করতে সক্ষম হবে।
ACE জিনটি আমাদের শরীরের দৈহিক ক্ষমতা ও ক্রিয়ার জন্য দায়ী। বিদেশে দেখা গেছে যে সকল ব্যক্তির ACE জিনের দৈর্ঘ বেশি তারা খেলাধুলা, পর্বত আরোহণ, সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে উপযুক্ত বলে গণ্য হয়েছে।
আবার প্রচন্ড মানসিক চাপ যা আমাদের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় তা সহজেই দ্রুত স্বাভাবিক করে দেয় লম্বা দৈর্ঘ্যের জিন। যার ফলে লম্বা দৈর্ঘ্যের জিন যুক্ত মানুষ অধিক মানসিক চাপ বহন করতে সক্ষম। অর্থাৎ বলা যেতে পারে ACE-এর ‘+’ ‘+’ এবং APOE-এর ‘2/3’ বা তার কম ‘3/3’ অধিক ক্ষমতা বা জীবনীশক্তি বেশি।