Home মানসিক স্বাস্থ্য সামান্য মাথার চোটেও হতে পারে ভয়ানক পরিণতি

সামান্য মাথার চোটেও হতে পারে ভয়ানক পরিণতি

অনেক সময় পড়ে গিয়ে কিংবা দরজায় লেগে মাথায় আঘাত লাগে। এই বিষয়টাকে অনেকেই অত গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু এর থেকে যে রোগটি হয় তাকে সাবডুরাল হিমাটোমা বলে। আমাদের মাথার মধ্যেটা যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যাবে খুলির মধ্যে বা মস্তিষ্কের মধ্যে কতকগুলো পর্দার মতো স্ট্রাকচার আছে সেগুলিকে বলে মেনিনজিস।

মেনিনজিস ডুরা ম্যাটারের (Duramater) সব থেকে বাইরে থাকে। তার তলায় থাকে অ্যারাকনয়েড ম্যাটার (Arachnoid mater)। আরও নীচে থাকে পায়াম্যাটার ( Piamater)। পায়াম্যাটার মস্তিষ্কের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। ডুরা ম্যাটার এবং অ্যারাকনয়েড ম্যাটারের মাঝখানে যে জায়গাটা আছে সেখানে যখন রক্তক্ষরণ হয় তখন তাকে বলে সাবডুরাল হিমাটোমা ৷

সাবডুরাল হিমাটোমার রকমফের

সাবডুরাল হিমাটোমা দু’ রকমের দেখা যায়— আকিউট সাবডুরাল হিমাটোমা ও ক্রনিক সাবডুরাল হিমাটোমা।

অ্যাকিউট সাবডুরাল হিমাটোমা

অ্যাকিউট সাবডুরাল হিমাটোমায় চোটের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রক্তক্ষরণ হয় এবং চোটের গুরুত্ব অনুযায়ী রোগীর উপসর্গ দেখা যায়। কখনো কখনো দেখা যায় রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য চোট থাকতে পারে, আবার কখনো কখনো দেখা যায় রোগীর প্রথম দিকে জ্ঞান থাকে, থাকে একটু মাথা ব্যথাও, তারপর অজ্ঞান হয়ে যায়। সাধারণত ওই জায়গায় রক্তক্ষরণ হয়ে মস্তিষ্কের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করায় রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

অ্যাকিউট সাবডুরাল হিমাটোমায় খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করা দরকার। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগেই অপারেশনটা করে নিতে পারলে রেজাল্ট খুব ভালো পাওয়া যায়। ডিপ-কোমাতে গেলে খুব স্বাভাবিকভাবে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। হয়তো জীবন বাঁচানো যায় কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ পরবর্তী জীবনে ব্যাহত – হতে পারে।

অ্যাকিউট সাবরাল হিমাটোমা অনেক সময় খুব বয়স্ক মানুষ, যারা অ্যাসপিরিন, ক্লোপিডোজেল, ওয়াটারিম অ্যাকিট্রন খান তাদের রক্ত তরল হয়ে চট করে জমাট বাঁধে না। সেক্ষেত্রে রক্তক্ষরণটা বেশি হয়। যেমন সামান্য একটু পড়ে গেলেও বিরাট বড় একটা হেমারেজ হতে পারে। সেক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার ব্যবস্থা করেই অপারেশন করতে হয়। প্লাজমা দিয়ে হোক বা প্লেটলেট কনসেনট্রেট দিয়ে হোক, যেকোনো ভাবে তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে পারলে বেশিরভাগ সময় ভালো ফল পাওয়া যায়। যদি না মস্তিষ্কে অন্য কোনো গুরুতর চোট থাকে। যদি মস্তিষ্কে, ব্রেনে চোট থাকে তাহলে অপারেশন করলেও সেরে উঠতে খুব দেরি হয়। তবে মস্তিষ্কের চোট যত ধরনের হয় তার মধ্যে সাবডুরাল হিমাটোমার রেজাল্ট কিন্তু সবচেয়ে খারাপ। অনেক সময় অল্প বয়সীদের ব্রেনেও খুব বেশিরকম আঘাত লাগে। এই রক্তক্ষরণ সাধারণত মস্তিষ্কের যে শিরাগুলি ছিঁড়ে যায় তার থেকেই হয়। কখনো কখনো মস্তিষ্কের ওপর যে ধমনী আছে সেই ধমনী ছিঁড়েও রক্তপাত হতে পারে।

subdural hemorrhage 01

অপারেশন করার সময় হাড়টা খুব বড় করে ও ডুরা ম্যাটারটা কেটে ভিতরে ঢুকে ক্লট বার করতে হয়। এরপর ভালো করে ওয়াশ করে দেখতে হয় যে কোথায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই রক্তক্ষরণ দেখা যায়। এরপর রক্তক্ষরণ বন্ধ করে পরিষ্কার করে ডুরার ওপর মেমব্রেন লাগিয়ে দিতে হবে, যাতে ব্রেনটা ফুললে আরও ফোলার জায়গা পেতে পারে, হাড়টা বসানো যেতে পারে। কখনো কখনো হাড় না বসিয়ে পেটের মধ্যে চর্বির নীচে পকেট বানিয়ে রেখে দেওয়া হয় এবং মাথার চামড়াটা বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে ব্রেনটা যদি ফোলে তাহলে বাইরের দিকটা ফুলবে। ভিতরে ফুলে চাপ সৃষ্টি করবে না। এরপর ব্রেন যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে কয়েক মাস বাদে অপারেশন করে হাড়ের টুকরোটা বসিয়ে দেওয়া হয় যাতে মাথার আকৃতি আবার আগের মতো হয়ে যায়। হাড় থাকার জন্য আমাদের মস্তিষ্কের যে সুরক্ষাটা আছে সেই সুরক্ষাটা দেওয়া যেতে পারে।

মাথায় চোট লাগার ফলে যত রক্তক্ষরণ হয় তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হয় কিন্তু অ্যাকিউট সাবডুরাল হিমাটোমার কারণে। ভলিউম এবং পরিমাণের ওপর নির্ভর করে রোগীর অবস্থা এবং ভবিষ্যত ফলাফল। অবশ্য মস্তিষ্কের যে চোট, তার ওপরও নির্ভর করে রোগীর অবস্থা।

আগেই বলা হয়েছে, পূর্বে উল্লেখিত ওষুধগুলি যারা খান তাদের কিন্তু একবার নয়, বারেবারেই এইরকম হতে পারে। আর একটা কথাও বলা দরকার, অ্যাকিউট সাবডুরাল হিমাটোমা সব বয়সেই হতে পারে। 

ক্রনিক সাবডুরাল হিমাটোমা

অ্যাকিউট সাবডুরাল হিমাটোমার থেকে কনিক সাবডুরাল হিমাটোমার চিকিৎসার ফল অত্যন্ত সন্তোষজনক। এটি সাধারণত বয়স্কদেরই বেশি হয়। কেননা বয়স্ক লোকেদের ব্রেনটা ছোট হয়ে যায়। ফলে ডুরা এবং ব্রেনের মধ্যে অনেকটা জায়গা হয়ে যাওয়ায় ব্রেনের যে শিরাগুলো থাকে সেগুলো খানিকটা টানে থাকে। এর ফলে ছোটখাটো চোট লাগলে কিংবা মাথায় ঝাঁকুনি লাগলে ছোট ছোট শিরাগুলি ছিঁড়ে যায় এবং রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ওখানে যেহেতু ব্রেন এবং ডুরার মধ্যে অনেকটাই জায়গা থাকে সেজন্য সামান্য রক্তক্ষরণ হয়তো কোনো চাপের সৃষ্টি করে না এবং রোগী জানতেও পারে না যে ভেতরে কোনো ক্লট বেঁধে আছে। ছোটখাটো ক্লট বেঁধে থাকার ফলে ক্লটের চারপাশে মেমব্রেন তৈরি হয় এবং মেমব্রেনের মধ্যে ফ্লুইড জমতে থাকে। ফলে ওটা বেড়ে যায় এবং বাড়তে বাড়তে একটা বিরাট আকার ধারণ করে। তখন মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং রোগীর শরীরে নানান উপসর্গের সৃষ্টি হয়।

যেমন হতে পারে পক্ষাঘাতের মতো একদিকে প্যারালিসিস। অথবা প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা। কিংবা রোগী হাঁটতে পারে না বা ঝিমিয়ে যায়, ভুলভাল কথা বলে, দেখে মনে হয় রোগীর কোনো মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে বা স্ট্রোক হয়েছে। সেক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা সিটি স্ক্যান বা এম.আর.আই করে চিকিৎসা পদ্ধতি স্থির করেন।

ক্রনিক সাবডুরাল হিমাটোমা অপারেশন করলে সাধারণত ভালো ফল পাওয়া যায় এবং খুব তাড়াতাড়ি রিকভারি হয়। এমন রোগীও আসে যাদের প্যারালিসিস ছিল, অপারেশনের পর হাত-পা নাড়াতে পারছে, পরের দিকে হাঁটা- চলাও করছে। যাদের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তারা দু’একদিনের মধ্যে ভালোভাবে কথা বলতে পারছে।

ক্রনিক সাবডুরাল হিমাটোমা অল্প বয়সেও হতে পারে। বিশেষত যারা খুব মদ্যপান করে তাদের ব্রেনটা ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে। এর ফলে ডুরা আর ব্রেনের মধ্যে অনেকটা জায়গা হতে থাকে। সেখানে মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে গিয়ে অল্প অল্প রক্তক্ষরণ হতে থাকে। নিয়মিত অ্যাসপিরিন যারা খান তাদেরও কিন্তু ক্রনিক সাবডুরাল হিমাটোমা হতে পারে। আবার মামুলি চোটে শিরা ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত বন্ধ না হলে রক্তটা জমে জমে ক্রনিক সাবডুরাল হিমাটোমা হতে পারে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতি দশ জনের মধ্যে একজনের দ্বিতীয়বার অপারেশনের দরকার হতে পারে যাদের অনেক দেরিতে চিকিৎসা শুরু হয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে মাস দুয়েক আগে হয়তো রিক্সা থেকে পড়ে গিয়েছিল। কিংবা যে ওষুধগুলোর কথা আগে বলা হয়েছে সেগুলো যারা ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে ওষুধগুলো বন্ধ করে অপারেশনটা করতে হয়, তবে বেশিদিন ওষুধগুলো বন্ধ করা যায় না। কারণ এই ওষুধগুলো অত্যন্ত সিরিয়াস কন্ডিশনের রোগীদেরই দেওয়া হয়। যেমন ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের জন্য অ্যাসপিরিন বা ক্লোপিডোগ্রেল দিতে হয়। ওই ওষুধ না খেলে তাদের হার্টের সমস্যা মারাত্মক হতে পারে। যাতে রোগী কোনোভাবে বিপদে না পড়ে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হয়।

যদি ক্রনিক সাবডুরাল হিমাটোমার পাশপাশি অন্য কোনো সমস্যা না থাকে অর্থাৎ ডায়াবেটিসের সমস্যা, অন্য কোনো ওষুধ গ্রহণ, প্লাজমা না দিতে হয়— তাহলে এই রোগের চিকিৎসা সাধারণভাবে ৪০-৫০ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যায়। অবশ্যই যদি অন্য কোনো জটিলতা না থাকে তবেই। অবশ্য সরকারি হাসপাতালে এই খরচ অনেক কম। এছাড়া সবকিছু নির্ভর করে রোগীর অবস্থা, চোট- আঘাতের ওপর। কারণ অনেক সময় রোগীকে আই.সি.ইউ-তে রাখতে হতে পারে অথবা ভেন্টিলেশনে দিতে হতে পারে। তাই সঠিকভাবে টাকার অঙ্ক বলা খুব মুশকিল।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, যত দ্রুত সম্ভব মস্তিষ্কের চোট আঘাত সারিয়ে ফেলার জন্য ডাক্তার বাবুকে দেখিয়ে নেবেন যাতে পরবর্তীকালে বড় কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে না হয়।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version