হার্ট অ্যাটাক গ্রিল

একটা নামকরা খাবারের রেস্তোরাঁ, গিনেস বুক অফ দি ওয়ার্ল্ডে যার নাম উঠেছে ভালো উচ্চমানের বার্গার তৈরির জন্য। রেস্তোরাঁর সামনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকে, খেতে খেতে কারো মরে যাবার মতো অবস্থা হলে তাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়বার জন্য। প্রবেশ পথেই ডাক্তারের চেম্বার। ডাক্তার, নার্স কাস্টমার তথা রোগীকে আগে পরীক্ষা করবেন। রোগীর ওজন সাড়ে তিনশো পাউন্ড বা একশো ষাট কিলোগ্রাম কিংবা তারও বেশি হলে তাকে একেবারে বিনামুল্যে বার্গার খাওয়ানো হয়। সঙ্গে মদ। তবে শর্ত হিসেবে মেনুকার্ডের নীচে লেখা আছে বার্গার সবটা খেতে না পারলে নার্সের পোশাক পরা ওয়েট্রেস কাঠের ব্যাট দিয়ে পাছায় সজোরে মারতে মারতে বের করে দেবে। এটা হসপিটাল থিম রেস্টুরেন্ট, নাম ‘হার্ট অ্যাটাক গ্রিল‘। আরিজোনার নেভাদায় লাস ভেগাসে অবস্থিত অ্যামেরিকান হ্যামবার্গার রেস্তোরাঁ। ঠিকানা ৪৫০ ফ্রি মন্ট স্ট্রিট, লাস ভেগাস, এন ভি-৮৯১০১।

htg 1

এই রেস্টুরেন্টে ইচ্ছে করেই অত্যন্ত বেশি ক্যালোরিযুক্ত হ্যামবার্গার বিক্রি করা হয়। ডাক্তাররা, যে কোনো মানুষকে বয়স হলে তেল, ঘি, চর্বি, মাখন, রেড মিট, বিফ, মাটন, দুধ ইত্যাদি খেতে বারণ করেন, যাতে ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা দেখা না দেয়। আর ‘হার্ট অ্যাটাক গ্রিল’ রেস্তোরাঁর খাবারে এই জিনিসগুলোই অত্যন্ত বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। এই ‘হার্ট অ্যাটাক গ্রিল’ রেস্তোরাঁর কর্ণধার জন ব্যাসো বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছেন তিনি একজন সৎ ব্যবসায়ী। কারণ তার বক্তব্য : ‘I am probably the only restaurateur in the entire world who is unapologetically telling you that my food is bad for you, that will kill you and should stay away from it.’ এতেই জন ব্যাসো ক্ষান্ত হননি। তার টেবিলে পলিব্যাগ ভর্তি ছাই রেখে দিয়েছেন, যা তার ‘হার্ট অ্যাটাক গ্রিল’-এর বার্গার খেয়ে মৃত মানুষদের দেহাবশেষ! ব্যাসো বলেছেন তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সৎ ও সত্যবাদী ব্যবসায়ী। তাঁর বক্তব্য : ‘I’m here with the eremeted remains of someone, who died at my restaurant. He died of a Heart Attack at my restaurant and I’m putting the bag clearly on the table.‘I wish that Burger King McDonald and everyone else would do the same thing.’ কি সাংঘাতিক সততার বহর! ডাক্তারদের মতে, এই হার্ট অ্যাটাক গ্রিল রেস্তোরাঁয় বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর জাঙ্কফুড বিক্রি করা হয়।

এহেন যে রেস্তোরাঁ, যার বিজ্ঞাপনে এত সত্যি কথা, সত্যতা প্রমাণ করার জন্য রেস্তোরাঁ মালিকের টেবিলে রেস্টুরেন্টে খেয়ে, মরে যাওয়া মানুষের ভষ্মাবশেষ রাখা থাকে, সেখানে লোকে খেতে যায়? উত্তর হল — হ্যাঁ। সানন্দে যায়। কারণ তেল, ঘি, শূকরের চর্বি দিয়ে এমন রিচ ও মুখরোচক রান্নার নাকি তুলনা হয় না।

এছাড়া এই ‘হসপিটাল থিম রেস্টুরেন্ট’-এর রকম-সকমই সকলের থেকে আলাদা। এখানে খাবার পরিবেশন করে মহিলারা, যাদের নার্সের ছোটখাটো পোশাক পরতে হয়, যার অনেকটাই খোলামেলা – সেক্সি। খেতে আসা ভদ্রলোকদের বলা হয় ‘কাস্টামর’ বা রোগী। মেনুকার্ডের বদলে দেওয়া হয় ‘প্রেসক্রিপশন’। ‘কাস্টমারদের ইনডোরে ভর্তি হওয়া রোগীর মতো গাউন পরে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতে হয়। তার আগে হাইট, ওয়েট, ব্লাডপ্রেসার চেক করা হয়। খাবারের নামও উত্তেজক : Single Bypass Burger, Double Bypass Burger, Tripple Bypass Burger, Quadruple Bypass Burger, Quintiple Bypass Burger, Sixtuple Bypass Burger, Septuple 4 Octuple Bypass Burger.

একটা বিফ হ্যামবার্গারের ওজন আট আউন্স থেকে বত্রিশ আউন্স (২৩০ গ্রাম থেকে ৯১০ গ্রাম) পর্যন্ত হয়। এতে ৮০০০ ক্যালোরি পাওয়া যায়। অন্য খাবারের নাম All You can eat “Flat liner Fries”—যা কিনা শুকরের চর্বিতে ডিপ ফ্রাই করা আলু ইত্যাদি। সফট ডিসে তৈরি হয় আখের রস, আমেরিকান কোকা কোলা ইত্যাদি দিয়ে। হ্যামবার্গার তৈরি করা হয় ন্যূনতম পাঁচ পিস বেকন স্লাইস দিয়ে। সিঙ্গল বার্গ পাঁচ পিস বেকন স্লাইস, ডবল বার্গারে দশ পিস স্লাইস বেকন, ট্রিপল বার্গারে পনেরো পিস স্লাইস বেকন, কোয়াড্রপল বাইপাস বার্গারে কুড়ি পিস স্লাইস বেকন থাকে। বার্গারের সাথে আমেরিকান চিজ, রেড ওয়াইন, টম্যাটো এবং হার্ট অ্যাটাক গ্রিল স্পেশাল সস দেওয়া হয়।

হার্ট অ্যাটাক গ্রিলের অপর জনপ্রিয় খাদ্য হল ‘হাফ পাউন্ড করোনারি ডগ’। এতে একটা বানরুটির ওপর হাফ পাউন্ড হট ডগ, আমেরিকান চিজ, চিলি, পেঁয়াজ ও বেকন স্লাইস থাকে। সঙ্গে গাইড পিস হিসেবে থাকে চর্বিতে ডিপ ফ্রাই করে ভাজা ফ্রেঞ্চ পটাটো ‘ফ্ল্যাট লাইনার ফ্লাইজ’।

হাই ক্যালোরি যুক্ত ‘বাটার ফ্যাট শেক’ আছে ভ্যানিলা, চকলেট, স্ট্রবেরি ফ্লেভারে। ‘ক্যান’ করে সরবরাহ করা হয় বিয়ার ও বেশি চিনি মেশানো সোডা। যাতে অতিরিক্ত ক্যালোরি আছে। আবার স্যালাইন স্ট্যান্ডে ঝোলানো বোতলে পাওয়া যায় ফ্যাট বাস্টার্ড ওয়াইন এবং লিকার। যেন রোগী স্যালাইন খাচ্ছে।

হার্ট অ্যাটাক গ্রিলের বিখ্যাত কাবার কোয়াড্রপল বাইপাস বার্গার থেকে ১৯৮২ ক্যালোরি পাওয়া যায় বলে এটি ‘পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত জাঙ্ক ফুড’ নামে পরিচিত। কারণ এতে আছে ৪.৫ পাউন্ড বিফ প্যাটিস, ২০ স্লাইস বেকন, ৮ স্লাইস আমেরিকান চিজ, টম্যাটো, পেঁয়াজের সঙ্গে চর্বিতে ভাজা বানরুটি।

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড

‘ন্যাশনাল বার্গার ডেজ’ উপলক্ষে হার্ট অ্যাটাক গ্রিল তৈরি করেছিল ২০,০০০ ক্যালরি যুক্ত হ্যামবার্গার। তাতেই গিনেসবুকে হার্ট অ্যাটাক গ্রিলের নাম উঠে যায়। এই বার্গারের দাম ২১.২৪ ডলার এবং অমূল্য জীবনের কিছু বছর। কারণ এই ধরনের বার্গার খেলে অকালমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। হার্ট অ্যাটাক গ্রিলের অক্টপল বাইপাস হ্যামবার্গারে আছে চার পাউন্ড শুকরের মাংস দিয়ে তৈরি আটটি প্যাটিস, চল্লিশ যা শূকরের বেকন, লঙ্কা ও পর্যাপ্ত আমেরিকান চিজ। দেড়ফুট লম্বা বার্গার। তবে এখানেও ওই একই শর্ত। খাব বলে অর্ডার দিয়ে খেতে না পারলে ওয়েট্রেস নার্স কাঠের ব্যাট দিয়ে পাছায় সজোরে মারতে মারতে রেস্তোরাঁ থেকে বার করে দেবে। আর সবটা খেয়ে আধমরা হয়ে গেলে নার্সরা হুইল চেয়ারে বসিয়ে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে।

২০০৫ সালে জন ব্যাসো নামে এক ভদ্রলোক আরিজোনা প্রদেশের টেম্পে অঞ্চলের মানুষদের “Nutritional Pornography food” খাওয়ানোর সংকল্প নিয়ে ‘দি হার্ট অ্যটাক গ্রিল’ রেস্তোরাঁ চালু করেন, যেখানকার খাবার-দাবার হবে “So bad for you it’s shocking”.

এই ধরনের রেস্তোরাঁ খোলার অনুপ্রেরণা এসেছিল “ফিটনেস ট্রেনিং স্টাডি’র মার্কেটিং থিসিস লিখতে বসে। জন ব্যাসোর মনে হয়েছিল এরা ডায়েটিং করাবার নাম করে প্রচুর টাকা নিয়েও কাস্টমারদের না খাইয়ে রেখে টাকা রোজগার করে। তাই তিনি স্থির করলেন লোকে যত খেতে চায় ততটাই খাইয়ো ছাড়বেন, দরকার হলে বিনি পয়সায় ভোজ দেবেন। তিনি তার রেস্তোরাকে ‘হসপিট্যাল থিম স্টেরেন্ট’ নামে তুললেন ডাক্তার, নার্স আর অ্যাম্বুলেন্স রেখে। তবে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া রেস্টুরেন্টে কাজ করা ডাক্তার, নার্স সব ভুয়ো। এই রেস্টুরেন্ট মোটা ওজনদার মানুষের কদর বেশি। গরু-ছাগল ওজন করার এক দাঁড়িপাল্লায় এদের ওজন করা হয়। সাড়ে তিনশো পাউন্ড ওজন হলেই কোয়াড্রপল ‘বাইপাস হ্যামবার্গার ফ্রিতে সার্ভ করা হয়।

হার্ট অ্যাটাক গ্রিলকে কোর্টকেসের ঝামেলা। পড়তেই হয়। স্বল্পবাস পরিহিতা নার্সের পোশাকে ওয়েট্রেসদের ইউনিফর্ম মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট ভালো চোখে দেখেনি। তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিকারক জাঙ্ক ফুড খাদ্য হিসেবে পরিবেশন করাটাও স্বাস্থ্যদপ্তর মেনে নেয়নি। কিন্তু সততার প্রতীক জন ব্যাসো খোলাখুলি ভাবে লিখে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দিয়ে রেখেছে হার্ট অ্যাটাক গ্রিল-এর খাবার ক্ষতিকারক। এই খাবার খেয়ে তোমার মৃত্যুও হতে পারে। এরই টানে রমরম করে ব্যবসা চলছে। এখানে কার্ড চলে না। সব নগদ প্যাসায় লেনদেন হয়।

দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক গ্রিল ২০১১ সালে মেক্সিকোর ডালাসে চালু হলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক গ্রিলের খাবার খেয়ে মৃত মানুষের একটা তালিকাও করা হয়েছে। যেমন ২০১১ সালে মে মাসে ওই রেস্তোরাঁর মুখপাত্র ২৬১ কেজি (৫৭৫ পাউন্ড) ওজনের ব্লেয়ার রিভার মাত্র ২৯ বছর বয়সে মরে যান। 2012 সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রিপল বাইপাস বার্গার খেতে খেতে একজনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের এপ্রিলে ডবল বাইপাস বার্গারের সঙ্গে ড্রিংকিং চকলেট শেক খেতে খেতে এক মহিলা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মৃত্যুর মিছিলেও হার্ট অ্যাটাক গ্রিলের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি। খাদ্যরসিকেরা হার্ট অ্যাটাক গ্রিলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বোঝা যাচ্ছে একদল যেমন না খেয়ে ডায়েটিং করে হাড় জিরজিরে শরীর নিয়ে বাঁচতে চাইছে, অন্যদল চাইছে একদিন তো মরতেই হবে, তাই খেয়ে মরাই ভালো। এ ধরনের মানসিকতার মানুষরাই হার্ট অ্যাটাক গ্রিল বাঁচিয়ে রেখেছে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version