Home স্বাস্থ্য পরামর্শ স্বাস্থ্যসম্পর্কিত খবর বার্ধক্য হোক রোগমুক্ত স্বাস্থ্যকর

বার্ধক্য হোক রোগমুক্ত স্বাস্থ্যকর

বর্ধক্যে সংক্রমণ খুবই সাধারণ সমস্যা। দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনে প্রায়শই আমারা এই সমস্যার সম্মুখীন হই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়সকালে ইনফেকশন বা সংক্রমণ, যেমন নিউমোনিয়া, কিডনি ও মূত্রনালীর সংক্রমণ, পেট বা অন্ত্রের সংক্রমণ, মস্তিষ্কের মেনিনজাইটিস ও সেপটিসেমিয়া মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই এই বিষয়ে আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী বার্ধক্যে সংক্রমণজনিত কারণে মৃত্যুর হার (মর্টালিটি রেট) অল্পবয়স্ক বা মধ্যবয়স্ক রোগীদের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। এছাড়াও বার্ধক্যে রোগের জটিলতা বা রোগভোগের সময় বা স্থায়িত্ব বেড়ে যেতে পারে। বার্ধক্যে বিভিন্ন সংক্রমণের হার, কারণ, ব্যাপ্তি, লক্ষণ, পরিণাম ও চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন হয়ে থাকে।

কেন বার্ধক্যে সংক্রমণের হার ও প্রবণতা বেশি

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যকারিতার পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে সব বয়স্কদের মধ্যে এই পরিবর্তন একরকম হয় না। কিছু কিছু বয়স্ক মানুষ বিভিন্ন কারণে বেশি জরাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যাদের আমরা ‘ফ্রেল এল্ডারলি‘ মানুষ বলে থাকি। এদের মধ্যে সংক্রমণের হার ও প্রভাব বেশি লক্ষ করা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ত্বক, শ্বাসতন্ত্র, খাদ্যনালী, পাচনতন্ত্র, লিভার, কিডনি, হার্ট, মস্তিষ্ক, নার্ভতন্ত্র প্রভৃতির কার্যকারিতার পরিবর্তন হয়ে থাকে।

এছাড়া শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা, যাকে বলা হয় ইমিউনিটি, তার বিশেষ পরিবর্তন হয়ে থাকে। আমাদের শরীরের ইমিউনিটি প্রধানত দু’ রকমের। একটি আমাদের জন্মগত বা ইনেট্ ইমিউনিটি, আর দ্বিতীয়ত যেটা আমরা পরে অর্জন করি অর্থাৎ অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনিটি।

ইমিউনিটির ক্ষেত্রে আমাদের শরীরের গ্রন্থি থাইমাস, রক্তের টি এবং বি, লিম্ফোসাইট, বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবডি, ইমিউনোগ্লোবিউলিন, কমপ্লিমেন্ট, সাইটোকাইন, হরমোন প্রভৃতির পরিমাপ ও কার্যকারিতার পরিবর্তন হয়ে থাকে। এই অবস্থাকে সাধারণভাবে ইমিউনো সেনেসেন্স বলা হয়। এর ফলে বার্ধক্যে বিভিন্ন রকমের সংক্রমণ ও ক্যানসরের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এবং এর ফলে বয়সকালে মানুষের বিভিন্ন ধরনের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কমে যায় এবং অল্পতেই রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

এছাড়াও বার্ধক্যে মানসিক ও আর্থ সামাজিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। দেখা দেয় মানসিক অবসাদ, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, একাকীত্ব প্রভৃতি। এসবের কারণেও বার্ধক্যে সংক্রমণের হার বেশি হতে পারে।

বার্ধক্যে সংক্রমণের আরও একটি অন্যতম কারণ বয়সকালে পুষ্টিজনিত সমস্যা। উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে (বিশেষত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট প্রোটিন, অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট প্রভৃতি) শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। এটি পরীক্ষিত সত্য। সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগেন। এর অবশ্য বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এর ফলে বয়স্ক মানষেরা প্রায়ই সংক্রমণে ভুগতে পারেন।

এছাড়া বিভিন্ন ধরনের কুঅভ্যাস বা নেশা যেমন ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান বা বিভিন্ন ড্রাগ-আসক্তি বয়সকালে সংক্রমণের প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে।

ডায়াবেটিস, ক্যানসার, ক্রনিক লিভার ডিজিজ, কিডনির রোগ এবং বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি, অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন বা পেসমেকার কিংবা অস্থি চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রস্থেটিক মেটিরিয়াল প্রভৃতির প্রভাবে বার্ধক্যে সংক্রমণ বেশি হতে পারে।

অনেক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা আজকাল বৃদ্ধাবাসে থাকেন। এদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। তাই বৃদ্ধাবাসে বয়স্কদের বিশেষ চিকিৎসা বা প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা থাকা উচিত। এছাড়া যেসমস্ত বয়স্ক মানুষ ভ্রমণপিপাসু, সংক্রমণ প্রবণ এলাকায় তাদের বিশেষ সাবধানতা নেওয়া উচিত।

যে সমস্ত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা সর্দি, কাশি, হাঁপানি (সি. ও. পি. ডি. বা অ্যাজমা) প্রভৃতি রোগে ভোগেন, তাদের সংক্রমণের হার বিশেষত নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস প্রভৃতি বেশি হয়।

কী কী ধরনের সংক্রমণ বার্ধক্যে বেশি দেখা যায়

প্রথমে বলে রাখি, সাধারণভাবে অল্পবয়স্ক বা মধ্যবয়স্কদের ক্ষেত্রে যে ধরনের সংক্রমণ হয়ে থাকে বার্ধক্যেও সেসব সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু বার্ধক্যে কিছু কিছু সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব বেশি। যেমন, ফুসফুসের সংক্রমণ— নিউমোনিয়া, মহিলাদের ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন (ইউ.টি.আই), পুরুষদের প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা ও সংক্রমণ। এছাড়া লিভার, পিত্তথলি, অন্ত্রের সংক্রমণ, পেটের ভেতর অ্যাবসেস, ডাইভার্টিকুলাইটিস, মস্তিষ্কের মেনিনজাইটিস প্রভৃতি সংক্রমণ হতে পারে। হার্টের এন্ডোকার্ডাইটিস, কৃত্রিম হার্ট ভালভে সংক্রমণ, অস্থি ও জয়েন্টের অস্টিওমায়েলাইটিস, সেপটিক আর্থাইটিস প্রভৃতি। এছাড়া দাঁত ও মাড়ির সংক্রমণ, আর মাথার সাইনাসঘটিত সংক্রমণ বেশি হয়।

বার্ধক্যে বিভিন্ন ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা হার্পিস জোস্টার অনেকসময় খুব মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এছাড়াও যাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম তাদের কিছু কিছু ফাঙ্গাল ইনফেকশন যেমন ক্যানডিডিয়াসিস, হিস্টোপ্লাজমোসিস প্রভৃতি হতে পারে। বার্ধক্যে কিছু কিছু সংক্রমণের ফলে ব্যাক্টেরিমিয়া বা সেপটিসেমিয়া অনেক সময় মারাত্মক হয়ে যায়। যেমন নিউমোনিয়া, ইউচিই বা কোনো অ্যাবসেস জাতীয় বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে জীবাণু বা টক্সিন শরীরের রক্তের মাধ্যমে বিভিন্ন অর্গানকে আক্রান্ত করতে পারে এবং পরিণামে মাল্টি অর্গান ডিসফাংশনের ফলে মৃত্যুও হতে পারে। 

বার্ধক্যে সংক্রমণের বৈশিষ্ট্য 

আগেই আলোচনা করা হয়েছে বার্ধক্যে শারীরিক, মানসিক ও প্রতিরোধমূলক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে থাকে। এর ফলে রোগের লক্ষণ ও বহিঃপ্রকাশ ঠিকমতো নাও হতে পারে। যেমন ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণে সাধারণত জ্বর হয়ে থাকে। কিন্তু বয়সকালে জ্বর নাও থাকতে পারে বা অল্প জ্বর হতে পারে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে সাধারণভাবে সর্দি, কাশি, জ্বর, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি লক্ষণ থাকে। কিন্তু বার্ধক্যে এসব নাও থাকতে পারে। তবে বয়স্ক মানুষটি ভুল বকতে থাকেন, দৈনন্দিন কাজ করতে পারেন না, হঠাৎ অসুস্থ বা বেহুঁশ হয়ে পড়েন।

বার্ধক্যে বিভিন্ন রোগ একই সঙ্গে থাকতে পারে। যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, সিওপিডি বা অ্যাজমা, অন্ত্রের কোলাইটিস বা ডাইভার্টিকুলাইটিস। এছাড়াও মহিলাদের ক্ষেত্রে পোস্ট মেনোপজাল অস্টিওপোরোসিস ইত্যাদি। বয়স্কদের অন্যতম প্রধান রোগ হল হার্টের করোনারি ডিজিজ, রক্তে কোলেস্টেরলের সমস্যা এবং ক্যানসার। বয়স্করা প্রায়শই স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনসিয়া) রোগে ভোগেন। এর ফলে বয়স্কদের অনেক রকমের ওষুধ খেতে হয় (পলিফার্মেসি)। অনেক সময় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খেতে হয়। পলিফার্মেসির ফলে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সংক্রমণের হার বেড়ে যায় ।

সাধারণভাবে দেখা যায় সংক্রমণ হলে বয়স্করা বিভিন্ন কারণে অনেক সময় দেরি করে চিকিৎসা পান। বৃদ্ধ ও অতি বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ দায়িত্ব নিতে হবে।

বার্ধক্যে কয়েকটি সংক্রমণ

নিউমোনিয়া (ফুসফুসের সংক্রমণ)

pneumonia

বার্ধক্যের একটি গুরুতর সমস্যা। প্রায়শই নানা জটিলতা দেখা যায় এবং হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তির এটাই অন্যতম কারণ। যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে। প্রধানত দু’ রকমের নিউমোনিয়া হয়ে থাকে—এক, কমিউনিটি অ্যাকোয়ার্ড (সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সংক্রামিত) এবং দুই, হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ে (দু’ তিনদিন পরে) নোসোকেমিয়াল নিউমোনিয়া। এই দুই ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু সংক্রমণের কারণ হতে পারে। সাধারণভাবে ব্যাক্টেরিয়াল স্টেপটোকক্কাস নিউমনি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েনজি, মোরাক্সেলা, মাইকোপ্লাজমা, লিজিওনেলা নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে। এছাড়াও স্ট্যাফাইলোকক্কাস, সিউডোমোনাস, ক্লেবসিয়েলা এবং কিছু কিছু ছত্রাক যেমন হিস্টোপ্লাজমা প্রভৃতি মারাত্মক নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে। বিভিন্ন ভাইরাস জাতীয় রোগ যেমন সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা কখনো কখনো সোয়াইন ফ্লু এমনকী এভিয়ান ফ্লু বা এইচ.আই.ভি সংক্রমণজনিত কারণে কিংবা অন্যান্য ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাক ঘটিত রোগে বয়স্কদের নিউমোনিয়া হতে পারে। সর্বোপরি চিন্তার কারণ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স ব্যাক্টেরিয়া যা সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিছু কিছু ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত রোগ যেমন অ্যাসিনেটোব্যাকটোর এম.আর.এস.এ, ই.এস.বি.এল প্রভৃতি চিকিৎসার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় তাতেও ভালো কাজ হয় না। মৃত্যুও হতে পারে। বার্ধক্যে নিউমোনিয়া কেন বেশি হয় তা আগে কিছুটা আলোচনা করেছি। আরও একটি বিশেষ কারণ হল বয়স্কদের গোর্ড (GORD- Gastro Oesophageal Reflux Disease) যেখানে খাদ্যনালী বা গলা থেকে অ্যাসপিরেশনের ফলে ফুসফুসে সংক্রমণ হতে পারে ৷ এছাড়া মদ্যপান ও ধূমপান নিউমোনিয়ার সহায়ক হয়। আমাদের দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব যথেষ্ট বেশি, তাই শ্বাসের মাধ্যম এই রোগের জীবাণু মাইকোব্যাকটেরিয়াল টিউবারকুলোসিস রোগাক্রান্ত মানুষের ফুসফুস থেকে অন্যের ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। রোগের উপসর্গ সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। অনেক সময় অল্প জ্বর, শরীরের দুর্বলতা, ওজন কমে যাওয়া, কাশি বা রক্ত পড়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। এক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে হবে।

টিবি রোগের ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে রক্তের মাধ্যমে সংক্রমণ সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে যাকে বলা হয় মিলিয়ারি টিবি। অনেক সময় টিবি মেনিনজাইটিসে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসা করাতে হবে।

তবে স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার প্রধান ব্যাক্টেরিয়া। শরীরে বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। যেমন কানের ওটাইটিস মিডিয়া, সাইনুসাইিটস, হার্টের চারদিকের পেরিকার্ডাইটিস, চামড়ার ইনফেকশন, কিডনির নেফ্রাইটিস, এমনকী সেপসিস ইত্যাদি। এছাড়াও যাদের সিওপিডি, ঢোক গেলার সমস্যা, অ্যাসিড রিফ্লাক্স আছে এবং স্ট্রোকের পরে যারা প্যারালিসিসে ভোগেন, তারাও এই ধরনের নিউমোনিয়ার সহজ শিকার হতে পারেন।

আগেই বলেছি বার্ধক্যে যেহেতু অনেক সময়ে নিউমোনিয়ার উপসর্গ প্রকাশ নাও পাওয়া যেতে পারে, তাই ব্যয়স্কদের হঠাৎ শরীর খারাপ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে বুকের এক্স-রে ও রক্ত পরীক্ষা প্রভৃতি করে চিকিৎসা করাতে হবে।

মুত্রনালী বা কিডনি (ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন) : 

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূত্রনালীর সংক্রমণ বাড়তে থাকে। বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণের হার প্রায় ৩০ শতাংশ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে শতকরা প্রায় ৪০। যে সমস্ত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হাসপাতালে সেপসিসে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন তাদের মূত্রনালীর সংক্রমণ একটি অন্যতম প্রধান কারণ।

অনেক সময় কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ নাও থাকতে পারে। তবে সাধারণভাবে লক্ষণগুলি হল বারে বারে প্রস্রাব পাওয়া, রাতে বারে বারে ওঠা, প্রস্রাব পেলে ধরে রাখার সমস্যা, প্রস্রাবে জ্বালা, প্রস্রাবে রক্ত পড়া, তলপেট বা কোমরে ব্যথা, কাপুনি দিয়ে জ্বর, দুর্বলতা, পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যায় প্রস্রাব আটকে যাওয়া বা ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব হওয়া। এছাড়া প্রস্রাব সামলাতে না পারার কারণে অজান্তে ঘুমের সময় বিছানা ভিজিয়ে ফেলা প্রভৃতি।

মহিলাদের ক্ষেত্রে রজঃস্রাব বন্ধের পরে (মেনোপজ) শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতির ফলে বা যাদের জরায়ু ও ডিম্বাশয় বাদ দেওয়া হয় তাদের মূত্রনালী ও যোনিপথের শুদ্ধতা বৃদ্ধির কারণে মুত্রনালীর সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়।

সাধারণভাবে ই.কোলাই, ক্লেবসিয়েলা ও সিউডোমোনাস জাতীয় ব্যাক্টেরিয়া বা ক্যানডিড জাতীয় ছত্রাক মূত্রনালীর সংক্রমণের বিশেষ কারণ। এছাড়াও কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বিভিন্ন যৌনরোগ এই সংক্রমণের কারণ হতে পারে।

কিছু কিছু বয়স্ক মানুষের প্রস্রাব করার পরেও ইউরিনারি ব্লাডারে বেশ কিছুটা মূত্র থেকে যায়। অনেক সময় ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো ক্যাথিটার পরাতে হয়। এবং তার ফলে মুত্রনালীর সংক্রমণ হতে পারে। 

তাই বার্ধক্যে ইউ.টি.আই হলে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে। বিশেষত যারা বারে বারে এই সমস্যায় ভুগছেন। ডাক্তারবাবু প্রয়োজন মতো প্রস্রাবের রুটিন ও কালচার জাতীয় পরীক্ষা করান। প্রয়োজনে আলট্রাসনোগ্রাফি ছাড়াও আরও বিশেষ পরীক্ষা করাতে হয়। এক্ষেত্রে ইউরোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে। মহিলাদের মেনোপজ সংক্রান্ত কারণে গাইনোকোলজিষ্টের উপদেশ দরকার হতে পারে।

তবে যে সব মহিলা প্রায়ই এরকম সমস্যায় ভোগেন তাদের স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে। এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও কিছু স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মানতে হবে। অনেক সময় হালকা পেটের ব্যায়াম করতে হতে পারে। ডায়াবেটিস থাকলে চিকিৎস করতে হবে। সাধারণভাবে দিনে ৬ থেকে ৮ মাস পানীয় জল পান করা প্রয়োজন। তবে যাদের হার্ট বা কিডনি কিংবা লিভারের সমস্যা আছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পথ্য বা পানীয় জল গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

বার্ধক্যে ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ : 

বার্ধক্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ খুবই বেশি এবং মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ। বার্ধক্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরের অ্যান্টিবডি কমে যায়। বিভিন্ন প্রজাতির ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। প্রথমে ভাইরাল সংক্রমণের সাধারণ উপসর্গগুলি দেখা যেতে পারে। যেমন, জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, নাক ও চোখ দিয়ে জল পড়া, মাথার যন্ত্রণা, হাত-পায়ের যন্ত্রণা এবং পরে নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় যদি কোনো মারাত্মক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা যেমন সোয়াইন ফ্লু বা বার্ড ফ্লু ইত্যাদি হয়ে থাকে তাহলে বয়স্কদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ এরা সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়া বয়স্করা ভ্যারিসেলা জোস্টার ভাইরাসের শিকার হতে পারেন (প্রায় ০.৮ থেকে ১ শতাংশ)। বয়সকালে এই সংক্রমণের তীব্রতা ও জটিলতা বাড়তে পারে। এই রোগে চিকেন পক্স সংক্রমণের মতো চামড়ায় ফোস্কা জাতীয় র‍্যাশ শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশে এবং নির্দিষ্ট সীমারেখা বরাবর দেখা যায় তার সঙ্গে থাকে নিউরালজিয়ার ব্যথা যা অনেক সময় অসহ্য হয়ে উঠতে পারে। এটি মূলত নার্ভের একটি বিশেষ অংশ (পোস্ট রুট গ্যাংলিয়ন) আক্রমণ করে এবং নার্ভের কার্যকরী অংশের ফোস্কা চামড়ায় ছড়িয়ে যায়। সাধারণভাবে বুকে, হাতে, পায়ে, মুখে বিশেষত চোখ, কানের পাশে, বা কপালে দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে নার্ভের প্যারালিসিস হতে পারে (মুখে বেলস পালসি)। কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে গিয়ে এনকেফেলাইটিস সুষুম্নাকাণ্ডে (স্পাইনাল কর্ড) মায়েলাইটিস হতে পারে। চামড়ার ফোস্কা শুকিয়ে যাবার পরও নার্ভ জনিত ব্যথা অনেকদিন থাকতে পারে এবং ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই অ্যান্টিভাইরাল রোগে ড্রাগ অ্যাসাইক্লোভির জাতীয় ওষুধ খুবই কার্যকরী। প্রতিকারের জন্য ভ্যাকসিনও আছে। অবশ্যই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে হবে।

এছাড়াও চামড়ার অন্যান্য কিছু সংক্রমণ বার্ধক্যে খুবই সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষত যাদের ডায়াবেটিস আছে। যেমন বিভিন্ন ধরনের ঘা, ফোঁড়া, কার্বাঞ্চল, ডায়াবেটিক ফুট বা পায়ের ঘা, আর আছে বেডসোর। বিশেষত যারা একভাবে বেশ কিছুদিন শুয়ে থাকেন প্যারালিসিসের কারণে হাত-পা চালনা করতে পারেন না, সেখানে প্রেসার পয়েন্টে ক্রমাগত চাপের ফলে বেডসোর হয়। এর থেকে শরীরে সংক্রমণ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো চিকিৎসা করাতে হবে। না হলে পরিণাম মারাত্মক হতে পারে।

সংক্রমণের প্রতিকার ও প্রতিরোধ

  • প্রথমই বলি, বার্ধক্যে সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে হবে এবং উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিচর্যাকারী বা পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব নিতে হবে।
  • যারা অতি রুগ্ন এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম তাদের শরীরের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা যায়। যাকে বলা হয় কমপ্রিহেনসিভ জেরিয়াট্রিক অ্যাসেসমেন্ট (CGA)। এক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা বার্ধক্য রোগ বিশেষজ্ঞের (জেরিয়াট্রিশিয়ান) উপদেশ নিলে ভালো হয়। যদি ডায়াবেটিস, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, ক্যানসার, চামড়ার সংক্রমণ, পলিফার্মেসি, মানসিক অবসাদ, ডিমেনসিয়া, লিভার, হার্ট, নার্ভতন্ত্রের রোগ প্রভৃতি বিভিন্ন সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন আর্থসামাজিক বিষয়ের মূল্যায়ন এবং শরীরের পুষ্টি বা বিভিন্ন নেশা বা আসক্তির প্রতিরোধ।
  • চাই শরীরের উপযুক্ত পুষ্টি। সুষম আহার বিশেষত টাটকা সবজি, ফল, ফাইবারযুক্ত খাবার, উপযুক্ত পরিমাণে প্রোটিন, যেমন দুধ, ডাল, সোয়াবিন, মাছ ও মাংস। কিছু কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। যেমন ভিটামিন-সি, বি-কমপ্লেক্স, ভিটামিন-ই, জিঙ্ক, ভিটামিন-ডি, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক লাইকোফেন, আল্‌ফা লিনিয়িক অ্যাসিড। এক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু ও সম্ভব হলে ডায়েটেশিয়ানের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
  • কিছু কিছু কু-অভ্যাস— যেমন ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান, ড্রাগ আসক্তি বা অন্য নেশা থাকলে বর্জন করতে হবে।
  • শরীরচর্চা যেমন হাঁটা বা যোগব্যায়াম ও বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেচিং ও রেজিস্ট্যান্স ব্যায়াম শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে পারে। উপযুক্ত পরিমাণে পানীয় জল গ্রহণ করতে হবে। যাতে শরীরে ডিহাইড্রেশন না হয়। যারা অতিরিক্ত পরিমাণে পানীয় জল খান তারা অবশ্যই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেবেন।
  • যেসব বয়স্ক মানুষ বিভিন্ন রোগে অক্ষম ও নিজের শরীরের যত্ন করতে পারেন না, তাদের পরিচর্যাকারীদের বা পরিবারের সদস্যদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিতে হবে।
  • কিছু কিছু সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য বয়সকালে ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যাদের বেশি ঝুঁকি থাকে যেমন যাদের সি.ও.পি.ডি., অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, কিডনি-লিভার- হার্টের রোগ ইত্যাদি আছে তাদের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন চিকিৎসকের পরামর্শ মতো নিয়ে নেওয়া ভালো। অবশ্য ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কিছুটা কম হতে পারে। যেসব ভ্যাকসিন বয়সকালে দেওয়া হয় তা হল—ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন প্রতি বছরে একবার, নিউমোকক্কাল পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন (PSV) ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে একবার (যাদের গত ৫ বছরের মধ্যে নেওয়া নেই) এবং প্রতি ৫ বছর অন্তর একবার নিলে ভয়ঙ্কর নিউমোনিয়া থেকে কিছুটা রেহাই পওয়া যেতে পারে। তবে এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের মধ্যে একটু ভিন্ন মত আছে। এছাড়া হার্পিস জোস্টার, টিটেনাস বা ডিপথেরিয়ার ভ্যাকসিন কখনো কখনো প্রয়োজন হতে পারে। তবে যেকোনো ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে ডাক্তারবাবু পরামর্শ নিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এছাড়া ভ্রমণপিপাসু বয়স্করা প্রয়োজনমতো কিছু কিছু নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন নিতে পারেন।
  • মনে রাখতে হবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংক্রামক রোগ নিরাময়যোগ্য ও প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
  • ওষুধের দোকান থেকে ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে খাবেন না। এতে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হবে। এবং তখন চিকিৎসা জটিল হয়ে যাবে।

পরিশেষে চাই স্বাস্থ্য সচেতনতা। কিছু কিছু স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। শরীর পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। তার সঙ্গে চাই যথাসম্ভব মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন। আর যারা নিজেরা পারবেন না, তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version