শিশুদের ফিজিওথেরাপি করার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে বিবেচিত বিষয় হল তার আশপাশের পরিবেশ। মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন ধরনের খেলনা এবং খেলা বয়সোপযোগীভাবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুকে পুরস্কৃত করেও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। কিছু পরিচিত অথচ অজানা শব্দ যেমন—
- ডিফেক্ট— গঠনগত এবং শারীরবৃত্তীয় অস্বাভাবিকতা।
- ডিসএবিলিটি— নির্দিষ্ট কোনো কার্যসিদ্ধিতে পিছিয়ে পড়া অথবা সঠিকভাবে না করতে পারা
- হ্যান্ডিক্যাপড— এমন কিছু অবস্থা বা অবস্থাসমূহ যা তাকে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে বাধাদান করে।
- কনজেনিটাল অ্যাবনর্মালিটি – জন্মগত সমস্যা যেমন— ডাউন সিনড্রোম, টেলিপাস (পায়ের গোড়ালির সমস্যা), মাসকুলার ডিসট্রফি (মাংসপেশি শুকিয়ে যাওয়া), সেরিব্রাল পালসি, কানের এবং চোখের জন্মগত অসুবিধা ।
- অ্যাকোয়ার্ড কন্ডিশন (অর্জিত সমস্যা)— এনসেফেলাইটিস, মেনিনজাইটিস, জুভেনাইল ক্রনিক আর্থাইটিস, ডার্মাটোমায়োলাইটিস, পোলিও মায়োলাইটিস, মস্তিষ্কে আঘাত, বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা, স্টার্নোমাসটয়েড টিউমার, বেলস্ পালসি (মুখের একদিকে প্যারালাইসিস)।
Table of Contents
শিশুদের ফিজিওথেরাপির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রঙিন বল, ছবি আঁকা, কখনো কখনো ছোট ছোট জিনিস বয়ে নিয়ে আসার কাজগুলো করাতে হয় খেলার ছলে। কখনোই একনাগাড়ে শিশুদের ফিজিওথেরাপি করা উচিত নয়। বিভিন্ন ধরনের চেয়ার যেমন—পুশ চেয়ার, ফিডিং চেয়ার, বেবি ওয়াকার প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। স্প্যাস্টিক বা শক্ত হয়ে ওঠা অথবা ফ্লপি বা একদম নরম প্রকৃতির শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের বসানো, দাঁড়ানো এমনভাবে করা উচিত যাতে তার শিরদাঁড়া বেঁকে না যায়। কাপড়ের দোলনা টাঙিয়ে অথবা এক্সারসাইজ বল ব্যবহার করে স্প্যাস্টিক শিশুদের ব্যায়াম করানো হয়। প্যারালাল বারের মতো দুটো শক্ত হাতল করে অথবা দুটো মোটা দড়িকে টান-টান করে বেঁধে শিশুটিকে মাঝখানে রেখে হাঁটানো অভ্যাস করা যেতে পারে। শিশুটিকে স্প্রিংয়ের সাহায্যে ওপর থেকে সুরক্ষিতভাবে ঝুলিয়ে তার ভারসাম্য রক্ষা শেখানো হয়। বিভিন্ন ধরনের জুতো, স্প্লিন্টস, ক্যালিপার্স এবং স্পাইনাল ব্রাসেস ব্যবহারের মাধ্যমে শিরদাঁড়াকে সোজা করা হয়ে থাকে।
- Bobath পদ্ধতি : সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুদের বাবা-মা অথবা তার পরিচর্চাকারীকে শেখানো হয় কীভাবে শিশুটিকে বহন করবে, পরিধেয় পরাবে এবং খাওয়ানোর মতো প্রাত্যহিক কাজকর্ম করতে হবে।
- Peto পদ্ধতি : এই পদ্ধতিতে সেরিব্রাল পালসি শিশুদের ভয়েস এবং রিদিমিক্যাল ইনটেনশন দিয়ে তাকে অভ্যাস করানো হয় বিভিন্ন ধরনের নড়াচড়ায়। মূলত এটা অনেক শিশুকে একসঙ্গে করানো হয়ে থাকে।
- Domarn-Delacato পদ্ধতি : এটা শিশুকে জীবের অভিব্যক্তির বিভিন্ন ধাপ অনুযায়ী যেমন সরীসৃপের চলা, উভচর প্রাণীর বুক পিছলে চলা, অতঃপর স্তন্যপায়ী প্রাণীর হামা দিয়ে চলা অনুযায়ী ক্রমশ শিশুকে দাঁড় করানোর একটা ‘পদ্ধতি।
শিশুদের কিছু ব্যায়াম পদ্ধতি (বিশেষত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন)
- শিশুর ঘাড় শক্ত করার পদ্ধতি : শিশুটিকে কোলের মধ্যে উপুড় করে শোয়ান। আস্তে আস্তে ঘাড়টিকে ওপরে তুলে ধরে কিছুক্ষণ ধরে রাখুন । তারপর ধীরে ধীরে ডান দিকে এবং বাঁদিকে ঘাড় ঘোরান। শিশুটি যদি একদম ঘাড় তুলতে না পারে, তবে কোলে উপুড় করে রেখে ঘাড়ের ঠিক পিছনে মৃদু চাপ দিন এবং দুদিকের কাঁধকে হালকা করে মাঝের দিকে টেনে ধরুন। এতে সামনের দিকে ঘাড় তুলতে শিশুটির সুবিধা হবে। আবার উপুড় করে রেখে সামনের দিকে রঙিন, আওয়াজ যুক্ত খেলনা দেখান ও ধীরে ধীরে ডানদিকে বা বামদিকে নিয়ে যান। যাতে শিশুটি বাম এবং ডান দিকে তাকাতে চেষ্টা করে। অন্য এক পদ্ধতিতে, শিশুটিকে কোনো টেবিলের ধারের দিকে উপুড় করে শুইয়ে আপনার বাঁ হাতটি শিশুর নিতম্বের ওপর চাপ দিয়ে ধরুন এবং আপনার ডান হাত দিয়ে শিশুটির বুকটা তুলে রাখুন। তারপর ডান হাতটি আস্তে আস্তে নরম করলে শিশুটি ঘাড় তুলতে ধীরে ধীরে সমর্থ হবে। এবার শিশুটিকে চিৎ করে শুইয়ে দু’ হাত সামনের দিকে টেনে তুলে ধীরে ধীরে শিশুটিকে বসাবার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে একহাতে ঘাড়টা ধরে নিন। আবার ধীরে ধীরে বসা অবস্থা থেকে শিশুকে শুইয়ে দিন। একটি মোটা শক্ত পাশ বালিশের ওপর শিশুকে কখনো উপুড় করে আবার কখনো সোজা করে শুইয়ে বালিশটিকে ঘোরাতে পারেন। মায়ের কোলে বাচ্চাকে রেখে মায়ের একটা পা মেঝের সঙ্গে অপর পা দিয়ে পিঠের দিকে বাচ্চাকে সাপোর্ট দিয়ে খাড়া করে বসান এবং পিঠের দিকে দেওয়া পা-টিকে কখনো খাড়া করে, আবার কখনো নীচু করে দোল দিয়ে বাচ্চাকে তার শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখান।
বাচ্চাকে স্তন পান করাবার সময় ধীরে ধীরে মুখ থেকে স্তনের পিছনের দিকে নিয়ে যান, যাতে শিশুটি স্তন পানের তাগিদে ঘাড় তুলতে সচেষ্ট হয়।
মাটিতে পাতা ৪ ইঞ্চির মতো মোটা বিছানার প্রান্তে নিয়ে গিয়ে শিশুটিকে উপুড় করে শুইয়ে শিশুর হাত দুটিকে মাটিতে রাখুন, যাতে হাতের ওপর ভর দিয়ে শিশুটি মাথা তুলতে সচেষ্ট হয়।
- শিশুকে উপুড় হতে শেখানো : শিশুটির মাংসপেশি খুব শক্ত হলে ব্যায়ামের মাধ্যমে মাংসপেশি এবং সন্ধিস্থল নরম করানোর চেষ্টা করতে হবে। শিশুটির সামনে কোনো ঝুমঝুমি বা খেলনা রেখে তার মনোসংযোগ তৈরি করে খেলনাটিকে একপাশে ধীরে ধীরে ঘোরাতে হবে যাতে শিশুটি তার মাথা এবং ঘাড় সেই দিকে কাত করে। এভাবে ধীরে ধীরে খেলনাটি অনেক দূরে সরালে শিশুটিও ওল্টাতে চেষ্টা করে।
শিশুটিকে একটি মোটা তোয়ালের ওপর চিৎ করে শুইয়ে দু’জনে মিলে তোয়ালের দুদিকের প্রান্ত ধরে মাটি থেকে সামান্য তুলে একদিকে সামান্য কাত করতে হবে, যাতে শিশুটি তোয়ালের ভিতরে ধীরে ধীরে ওল্টাতে সমর্থ হয়। কোনো মজবুত, অথচ নরম বিছানার একপ্রান্তে শিশুটিকে শুইয়ে সেই প্রান্তটিকে ধীরে ধীরে ওপরে তুলতে হবে যাতে শিশুটি ধীরে ধীরে ওপর থেকে নীচে গড়িয়ে পড়তে পারে। মাথায় রাখবেন, শিশুটি যেন কোনোভাবে আঘাত না পায়।
শিশুটিকে বিছানায় সোজা করে শুইয়ে একদিকের হাঁটু ভাঁজ করে কোমর স্পর্শ করাতে হবে যাতে শিশু নিজে থেকে ওল্টাতে সচেষ্ট হয়।
- শিশুটিকে বুক-পিছলে হামা দিতে শেখানো : শিশুটি যখন তার ঘাড় তুলতে সক্ষম হবে, তখন শিশুটিকে উপুড় করে শুইয়ে তার সামনের দিকে কোনো খেলনা বা খাবার রেখে সেটাকে ধীরে ধীরে সরালে শিশুটি তা ধরবার জন্য এগিয়ে যেতে সচেষ্ট হবে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রথম শিশুর কোমরটিকে একটু তুলে ধরলে শিশুর বুক পিছলোতে সুবিধা হয় ৷
- শিশুকে বাঘা হামা দিতে শেখানো : শিশুকে উপুড় করে শুইয়ে বুকের কাছে এবং কোমরের কাছে তলা থেকে সাপোর্ট দিয়ে তুলে ধরুন যাতে শিশুটি তার হাঁটু এবং হাতের ওপর ভর করে ভারসাম্য রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। শিশুকে উপুড় করে শুইয়ে পেটের তলা দিয়ে কোনো মোটা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে শিশুকে সামান্য ওপরে তুলে ধরুন। (যেমনভাবে বাচ্চাদের জলের মধ্যে সুইমিং পুলে সাঁতার শেখানো হয়)।
আবার শিশুটিকে উপুড় করে শুইয়ে একদিকের হাঁটুকে ভাঁজ করে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে দিন যাতে সে অন্য পা-টা নিজে থেকে পেটের কাছে টেনে নিয়ে হামা দিতে সচেষ্ট হয় । শিশুটি একবার হামা দিতে শিখলে কখনো নরম বিছানায় বা কখনো শক্ত মেঝেতে হামা দিতে উৎসাহিত করুন।
- শিশুকে বসতে শেখানো : শিশুটিকে কনুই এবং কবজির ওপর ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে বসানোর চেষ্টা করুন। বসানোর সময় শিশুর কোমরকে সোজা রাখার চেষ্টা করুন। আপনার হাঁটুর ওপর শিশুটিকে বসিয়ে হাঁটুকে ওপর-নীচে তুলে বসা অবস্থায় শিশুকে ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখান। বসানোর পর শিশুটির যেকোনো একদিকে খেলনা জাতীয় জিনিস দিয়ে শিশুটিকে এদিক-ওদিকে ঘুরতে উৎসাহিত করুন। শিশুটিকে বসিয়ে সামনে, পিছনে বা উভয় পাশে হেলিয়ে দুলিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখান।
কখনো কখনো মা মেঝেতে বসে পাদুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে শিশুটিকে আড়াআড়িভাবে পায়ের ওপর উপুড় করে শোওয়ান, তারপর এক হাতে শিশুটির হাঁটুর কাছে চাপ দিয়ে এবং অন্য হাতে বুকের দিকে সাপোর্ট দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে শেখান। শিশুটিকে চিৎ করে শুইয়ে হাত দুটিকে হালকা করে টেনে বসাতে চেষ্টা করুন। হাঁটু যদি ভাঁজ হয়ে যায়, তবে হাঁটুর ওপর চাপ দিয়ে হাঁটু সোজা রাখার চেষ্টা করুন।
হাতলযুক্ত চেয়ারে শিশুটিকে বসিয়ে প্রয়োজনে বালিশে ঠেস দিয়ে শিশুটিকে খাওয়াতে পারেন। বেবি ওয়াকারে দু দিকে পা দিয়ে বসিয়ে বসতে বা চলতে শেখানো যেতে পারে।
- শিশুকে দাঁড়াতে শেখানো : প্রথমে হাঁটুর ওপর ভর করে খেলার ছলে দাঁড়াতে শেখান। প্রয়োজনে কোমর এবং ঊর্ধ্বাঙ্গে শিশুটিকে সাপোর্ট দিতে পারেন। ধীরে ধীরে এই সাপোর্ট সরিয়ে নিলে একটা নীচু টুল বা চেয়ারে ভর দিয়েও দাঁড় করাতে পারেন। এই অবস্থায় শিশুকে কিছুক্ষণ রাখতে গেলে তাকে খেলার মধ্যে ভুলিয়ে রাখুন।
শোওয়া অবস্থা থেকে হাত ধরে টেনে ধীরে ধীরে বসাতে এবং তারপর দাঁড় করাতে উৎসাহিত করুন। ছোট টুল বা চেয়ারে দু’ হাতের সাহায্যে শিশুটিকে হাঁটুর ওপর ভর করে প্রথমে দাঁড় করান, তারপর ধীরে ধীরে একদিকের হাঁটু সোজা করে এক পায়ের ওপর চাপ দিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করুন এবং একইভাবে উল্টোদিকের পা-কেও ওইভাবেই সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করুন। এই সময়ে শিশুটির সামনে কোনো খেলনা রেখে বা টিভি চালিয়ে শিশুটিকে মনের আনন্দে রাখুন ৷
দেওয়াল বা ঘরের কোনো আসবাবপত্রকে ধরেও দাঁড় করানো শেখাতে পারেন। এই অবস্থায় প্রথমে দু’হাত দেওয়ালে ধরে তারপর এক হাত ধরে ও এক হাত ছেড়ে দাঁড় করাতে শেখান, এইভাবে যখন শিশুটি দাঁড়াতে শিখবে তখন প্রথমে দু’ হাত দেওয়ালে অথবা পাশাপাশি টান দেওয়া দুটি কোনো শক্ত দড়ি ধরেও চলতে শেখানো যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে দু’হাত ধরে এবং ধীরে ধীরে এক হাত ধরে ও শেষে না ধরে চলতে শেখান।