বর্তমানে মা-বাবারা যে জিনিসটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেন তা হল তাদের সন্তানের ঠিকঠাক বৃদ্ধি হচ্ছে কি না। প্রতিযোগিতার দৌড়ে পৃথিবীতে কে কতটা সফল হবেন তার মাপকাঠি হিসেবে উচ্চতাকে ধরা হয়। যদিও সফলতার মাপকাঠি, কখনোই শুধু উচ্চতা হতে পারে না। কারণ সুনীল গাভাসকার, শচীন তেন্ডুলকর, মাদার টেরেসাকে লক্ষ করলে দেখা যায় শরীরী উচ্চতায় তারা অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও জনপ্রিয়তার নিরিখে এবং সাফল্যের সুবাদে পৃথিবীর বহু লম্বা মানুষকে তারা পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
তবু উচ্চতা নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক চাহিদা থাকে, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে। উচ্চতা ভালো হলে তাকে ‘সুপুরুষ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক মেয়ের মধ্যেও লম্বা হবার বাসনা থাকে। কিছু কিছু প্রফেশন, বিশেষ করে মডেলিং ও র্যাম্পে হাঁটতে গেলে লম্বা মেয়ের চাহিদা বেশি থাকে।
যখন কোনো বাবা-মা ষোলো কিংবা আঠেরো বা কুড়ি বছরের ছেলেমেয়েকে নিয়ে এন্ডোক্রিনোলজিস্টের কাছে যান, কেন তার সন্তান অন্যদের মতো যথেষ্ট বাড়ছে না, তখন কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার যে, একটা বয়সের পর উচ্চতা আর বাড়ে না। সেই বয়সটা মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছু আগে আসে আর ছেলেদের ক্ষেত্রে আসে কিছুটা পরে। মোটামুটিভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিক শুরুর দু’তিন বছর পর আর বাড়- বৃদ্ধি সেভাবে হয় না। অর্থাৎ সেই বয়সটা চোদ্দ, পনেরো, ষোলো বছর অবধি হতে পারে। ছেলেদের আর একটু বেশি দিন অবধি উচ্চতা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তার কারণ ছেলেদের পিউবার্টি বা বয়ঃসন্ধির সন্ধিক্ষণটা আসে একটু দেরিতে। ছেলেদের ক্ষেত্রেও সাধারণত আঠেরো বছরের পর আর উচ্চতা বাড়ে না। তাই কেউ যদি কুড়ি বছর বয়সে এসে বলে উচ্চতা বাড়ছে না ওষুধ দিন, তা সম্ভব নয় কোনোমতেই।
অনেক সংস্থা এ ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যম বা অন্যান্য মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দিয়ে উচ্চতা বাড়ানোর কথা বলে মানুষকে মিসগাইড করে থাকে। এ ব্যাপারে কিছু হেলথ ড্রিঙ্কসও তাদের প্রোডাক্ট বিক্রি করার জন্যে ভুল বা মিথ্যে তথ্য জনসমক্ষে পরিবেশন করে থাকে। একটা বয়সের পরে হাড়গুলো যেখানে বাড়ে সেই জায়গায় ফিকসন হয়ে যায় তাই হাজার চেষ্টা করলেও ওষুধের মাধ্যমে হোক, কি তাবিজ, কবচ, মাদুলির মাধ্যমে হোক— উচ্চতা বাড়বে না ৷
উচ্চতা বাড়তে পারে একটা পদ্ধতিতে, তা হল সার্জিক্যাল পদ্ধতি। অপারেশন করে লিম্ব লেন্দেনিং করা যায় কিন্তু সেটা কমপ্লিকেটেড মাল্টিপল স্টেজে হয়। সাধারণত এই ধরনের সার্জারি কোনো সার্জেন করেন না।
যাদের ছোটবেলায় কোনো অসুখের কারণে, যেমন পোলিওর কারণে একটা পা হয়তো ছোট, সেই ছোট পা’কে অন্য পায়ের সাথে মিলিয়ে লম্বা করা হয় কখনও কখনও সার্জারির সাহায্যে। তাই লম্বা বা উচ্চতার বিষয়ে সচেতন হতে হলে আগে থেকে হতে হবে।
এটা চট করে ধরা পড়বে যদি আমরা বাচ্চার বড় হবার সাথে সাথে প্রতি বছর বাচ্চার উচ্চতা মেপে দেখি। এই উচ্চতা মাপার ব্যাপারটা কিন্তু স্কুল হেলথ প্রোগ্রামের মধ্যে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক ভালো, নামকরা স্কুলেও এটা ফলো করা হয় না। স্কুলেরই নজর রাখা উচিত এ ব্যাপারে।
এখন প্রশ্ন, কতটা বাড়লে স্বাভাবিক বলা হবে। কারণ সকলেরই তো মনোগত ইচ্ছে থাকে লম্বা হওয়ার, বিশেষ করে “পুরুষদের। সবাই ছ’ফিট হতে চায়। কিন্তু বাড় বৃদ্ধির জন্য আমাদের কিছুটা নির্ভর করতে হয় জেনেটিক ব্যাপারের ওপর। আমার বাবা-মায়ের উচ্চতার ওপর নির্ভর করবে আমার উচ্চতা। সেই কারণে বড় কিছু আশা করে লাভ হয় না ৷
এ ব্যাপারে একটা সহজ ফর্মুলা আছে, তা হল বাবা ও মায়ের উচ্চতা সেমিতে মাপতে হবে। বাবা ও মায়ের উচ্চতা সেমিতে যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ করলে যা ফল বেরোবে তার সাথে ছ’ সেন্টিমিটার যোগ করলে তাতে ছেলের উচ্চতা কত অ্যাসপেক্ট করা যায় তা দেখা যাবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অবশ্য এই ছ’ সেন্টিমিটার বাদ দিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে এগুলো কোনো নিশ্চিত ফিগার হতে পারে না। বায়োলজিক্যালি পাঁচ-ছ’সেন্টিমিটার কম-বেশি হতেই পারে ।
এছাড়া বাচ্চার বাড়ার বয়সে কেমন করে বুঝবেন ঠিক ঠিক ভাবে সে বাড়ছে কি না? মোটামুটিভাবে আমাদের শৈশবের প্রথম দুটো বছরে উচ্চতা অনেক অনেক বেশি বাড়ে। তারপর দু’বছর থেকে পিউবার্টি অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিক্ষণের শুরু অবধি পাঁচ সেমি করে বাড়ে, সে ছেলে হোক বা মেয়ে। সুতরাং যদি দেখা যায় বছরে চার সেমির কম বাড়ছে তাহলে কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে বুঝতে হবে। কিন্তু একথাও ঠিক, এক বছর যদি কেউ একটু কম বাড়ে তাহলে সে নর্মালের নীচে চলে যাবে না। কিন্তু প্রত্যেক বছরের উচ্চতার চার্ট দেখলে ডাক্তারবাবু বুঝতে পারবেন কোথাও কোনোরকম সমস্যা হচ্ছে কি না।
এখন একটা বড় প্রশ্ন, কেন দেখতে হবে উচ্চতার ব্যাপারটা ? এর পেছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমত, দেখতে ভালো লাগা, মন্দ লাগার ব্যাপারটা আছে। দ্বিতীয়ত, বাচ্চা না বাড়ার পিছনে অন্য কোনো রোগ আছে কি না সেটাও জানা জরুরি। এর মধ্যে কিছু জেনেটিক কারণ থাকে বা থাকে ক্রোমোজোমাল ডিফেক্ট। যেমন মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় টার্নার সিনড্রোম।
সাধারণ ক্রোমোজোমাল কনস্টিটিউশনাল মহিলাদের ক্ষেত্রে 46XX, অনেকের একটা X- এর অভাব থাকে জন্মগতভাবে। যে সব মেয়েরা বাড়ছে না তাদের একটা স্টেজে ক্রোমোজোমাল কনস্টিটিউশনালটা পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া দরকার।
ক্রোমোজোমাল ডিফেক্ট ছাড়াও প্রাইমারি স্কেলিটন ডিজঅর্ডার থাকে। যার কারণে হাড়গুলো ঠিকভাবে বাড়ে না। এদের মধ্যে আমরা যাদের বামন বলি তারা পড়ে। এদের হাড়গুলো ডেভেলপ করে না।
এই গ্রুপটা বাদ দিলে মেজর একটা গ্রুপ আছে যেখানে কোনো ক্রনিক রোগের কারণ লুকিয়ে থাকে।
ছোটবেলা থেকে অ্যাজমা আছে, চিকিৎসা ঠিকমতো হয় না। জন্মগত হার্টের অসুখ অর্থাৎ কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ আছে। অথবা ম্যাল অ্যাবসপর্শন সিনড্রোম আছে। যা কিছু খাচ্ছে সেগুলো শরীরে যাচ্ছে না অথবা এমন কোনো অসুখ আছে যার কারণে দীর্ঘদিন স্টেরয়েড নিতে হয়। এছাড়া দেখা গেছে কোনো বাচ্চা যদি সঠিকভাবে সুপরিবেশে বড় না হয় অর্থাৎ যে ‘পরিবারে কোনো শান্তি নেই, বাড়িতে সব সময় বকুনি ও মার খায় শিশু, তার হয়তো খাওয়া- দাওয়া ঠিক আছে, তবু সে ঠিকঠাক বাড়বে না। এটাকে বলে সাইকো সোশ্যাল ডিপ্রাইভেশন। এটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া আছে কিছু হরমোন ডেফিসিয়েন্সি। এবং অতিরিক্ত হরমোনের সমস্যা থেকেও আসতে পারে উচ্চতার সমস্যা। হরমোনাল ডেফিসিয়েন্সির মধ্যে সবথেকে কমন হল থাইরয়েডের ডেফিসিয়েন্সি। এর চিকিৎসা খুব সহজ। এছাড়া আছে গ্রোথ হরমোন যেটা পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে বেরোয়। সেটার চিকিৎসা একটু কমপ্লিকেটেড। রোজ ইঞ্জেকশন নিতে হয় এবং যা অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ। এছাড়া কিছু হরমোনের আধিক্যের জন্যও উচ্চতার ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। গ্লুকো কটিকয়েড স্টেরয়েড শরীরে বেশি তৈরি হতে পারে, যাকে বলে কুশিং সিন্ড্রোম। বাচ্চাদেরও এটা হতে পারে। কর্টিসোল হরমোনের আধিক্যের জন্য স্ট্রেচ হতে পারে।
এইগুলোর কিন্তু চিকিৎসা হতে পারে। পিটুইটারি গ্রন্থিতে কোনো টিউমার থাকলে গ্রোথ হরমোনের ডেফিসিয়েন্সি হতে পারে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র মেডিকেল ট্রিটমেন্টই নয়, কিছু সার্জিক্যাল চিকিৎসারও প্রয়োজন পড়ে।
এরপরেও কিছু কারণ আছে যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে ইডিওপ্যাথি বলে। কিন্তু সেইসব ক্ষেত্রেও যদি একটু আগে থেকে আইডেনটিফাই করে গ্রোথ হরমোন দিয়ে চিকিৎসা করা যায় তাহলে তাদের উচ্চতার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। কিন্তু যার গ্রোথ হরমোন স্বাভাবিক আছে, বাইরে থেকে গ্রোথ হরমোন দিয়ে তাকে বাড়াতে গেলে গ্রোথ হরমোনের মাত্রা অনেক বেশি হবে এবং গ্রোথ হরমোনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সেগুলোও বেড়ে যাবে। ডাক্তারবাবুরা সাধারণত বাবা-মায়ের গ্রোথ হরমোন দেবার ব্যাপারে আগ্রহকে কখনোই উৎসাহ দেন না। তাদের যথেষ্ট বুঝিয়েও যখন নিরস্ত করা যায় না এবং তারা সমস্ত রকম খরচের ব্যাপারে রাজি থাকেন তখন হয়তো এক- দু’জনকে খুব রেয়ার ক্ষেত্রে দেওয়া হয় গ্রোথ হরমোন।
উচ্চতা বাড়াতে কী কী করবেন? মেসেজটা হল যথেষ্ট আগে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হতে হবে কারণগুলো। বছরে বাচ্চার উচ্চতার রেকর্ড রাখতে হবে। কোনো ক্রনিক রোগ থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে। প্রপার নিউট্রিশন দিতে হবে। প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি খাবারে থাকবে। এছাড়া অনুকুল পরিবেশও থাকতে হবে যাতে বাচ্চা ঠিকঠাক বেড়ে উঠতে পারে।