Sunday, June 16, 2024
Homeনবজাতক শিশুর যত্ন ও পরিচর্যাশিশুর বিকলাঙ্গতা দূরীকরণে রাম-বাণ এটি

শিশুর বিকলাঙ্গতা দূরীকরণে রাম-বাণ এটি

কেমন মন খারাপ লাগে না। বিকলাঙ্গ কে শিশুদের দেখলে? ইচ্ছে হয় না, দৌড়ে গিয়ে মিটিয়ে দিই তার সমস্ত বিকলাঙ্গতা। মনে হয় কোনও এক মন্ত্রবলে মিটিয়ে দিই তার লেংচে চলার দুঃখ, গোঁ-গোঁ করে আওয়াজ করার কষ্ট, মুছিয়ে দিই তার মুখনিঃসৃত লালা, আর সোজা করে ফেলি তার বাঁকা হাত-পা।

দূর থেকে দেখে আপনারই যদি এরকম লাগে, তবে কেমন লাগতে পারে শিশুটির বাবা-মা’র, আত্মীয়- স্বজনের? কেমনই বা লাগতে পারে শিশুটির নিজের? সেই বিকলাঙ্গতা দূরীকরণের নিদান কি বেরিয়েছে, যে এত ঘটা করে জানাবার প্রয়োজন পড়ছে?

আছে বৈকি, প্রভূত উৎফুল্ল হওয়ার কারণ ! গল্প হলেও সত্যি, আজ সত্যি সত্যিই সত্যি ! মানে ? মানে, বিজ্ঞানের হাতে আজ এমন অস্ত্র হাজির, যা দিয়ে দূরীকরণ করা যাবে বিকলাঙ্গতার অভিশাপ, বহুলাংশে !

অস্ট্রিয়া ছোট্ট একটি দেশ, সুইজারল্যান্ডের পাদদেশে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসার জন্য। সেই দেশেরই দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত গ্রাজ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর প্রেক্টল্ সেই সত্তর দশক থেকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছিলেন সদ্যোজাত শিশুদের হাত-পা ও শরীর নাড়ানোর প্যাটার্ন।

প্রায় দশক দু’য়েক পর্যবেক্ষণের ফলশ্রুতি হল তাঁর শিশুদের জেনারেল মুভমেন্ট (GM) নিয়ে সফল গবেষণা। তাঁর সেই কীর্তির ভাগীদার, তাঁকে সেই কাজে যিনি সাহায্য করেছিলেন সেই প্রফেসর প্রেক্টলের ছাত্রী প্রফেসর ক্রিস্টা আইনস্পাইলার।

প্রফেসর প্রেক্টলের ছাত্রী ক্রিস্টা আইনস্পাইলার সম্প্রতি আমাদের দিয়ে গেলেন সেই মহার্ঘ্য ট্রেনিং—জি.এম ট্রেনিং।

সারা ভারতবর্ষ থেকে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জমায়েত হয়েছিলেন কলকাতা শহরে, সেই ট্রেনিং নিতে। নয় নয় করে চল্লিশ জন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী সার্টিফায়েড হয়ে উঠলেন প্রেক্টল পদ্ধতি ব্যবহারে

ভারতীয়দের নিষ্ঠা, শেখার সহবৎ ও বুদ্ধিমত্তায় প্রফেসর ক্রিস্টা এতটাই মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ যে আমাদের সাথে বসে পরিকল্পনা করে ফেললেন ২০১৮ সালের। কলকাতার নেতৃত্বে, তিনি আবার আসবেন ভারতবর্ষের ছ’ ছটি শহর জুড়ে এই ট্রেনিংয়ের বন্দোবস্ত করতে।

কী সেই মহার্ঘ্য ট্রেনিং? আর তাতে কিই-বা লাভ আমাদের বিকলাঙ্গ শিশুদের ?

সুশিক্ষিত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা, যাঁরা জি.এম পদ্ধতিতে প্রথাগতভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সার্টিফায়েড, তাঁরা সদ্যোজাত শিশুর হাত-পা সঞ্চালনের দিকে তাকিয়ে, একটা স্পেশালাইজ্‌ড্ চেক আপের মাধ্যমে ৯৮% নিশ্চয়তার সঙ্গে বলে দিতে পারবেন যে, এই নবজাতকটির বিকলাঙ্গতার সম্ভাবনা ভবিষ্যতে আছে না নেই । অর্থাৎ একজন যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সার্টিফায়েড ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী যদি সদ্যোজাত শিশুটির GM Assesment চেক আপ করেন, তাহলে তিনি দেখেই বলে দিতে পারবেন যে এই শিশুটি – ভবিষ্যতে বিকলাঙ্গ হবে কি হবে না !

একেবারে শৈশবেই যদি সম্ভাবনা নিশ্চয় করা যায়, তাহলে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুটিকে বিকলাঙ্গ আর হয়ে উঠতে না দিলেই হল ! অর্থাৎ এক্সপার্ট আর্লি ইন্টারভেনশন চালু করে দিলে আর ক’টা বাচ্চাই বা বিকলাঙ্গতার শিকার হয়ে উঠতে পারবে? নগণ্য বৈ তো নয় !

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, যে যে চিকিৎসক, বিশেষত যাঁরা নবজাতক বিশেষজ্ঞ এবং যাঁরা ইনফ্যান্ট শিশু নিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ করেন, যেমন নার্স, ফিজিও এবং অকুপেশানাল থেরাপিস্ট বা ধাত্রীবিদ (মিডওয়াইফ) ও তৃণমূল স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন ANC, হেল্থ ভিজিটর ইত্যাদি, এঁরা প্রত্যেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন সরাসরি, যদি আপনারা এই বিকলাঙ্গতা দূরীকরণ যজ্ঞে সামিল হওয়ার জন্য প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করতে চান।

দুর্ভাগ্যবশত প্রতিটি শহরেই ট্রেনিং দেওয়া হবে মাত্র চল্লিশ জনকে, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে, ট্রেনিংয়ের গুণগত মান বজায় রাখার তাগিদে। তাই শিশু বিকলাঙ্গতা দূরীকরণের কান্ডারি যাঁরা হতে চান, তাঁদের তৎপর হতে আবেদন জানাচ্ছি।

এই বছর যখন কলকাতা শহরে এই প্রশিক্ষণ আয়োজনের খবর চাউর হয়, বাংলার বাইরের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এতজন হুড়মুড়িয়ে অ্যাপ্লাই করে ফেলেন যে ক্রিস্টাকে বলতে বাধ্য হতে হয় যে অন্তত অর্ধেক সিট যেন বাংলার ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য রিজার্ভ রাখা হয়। খবর বেরোনোর প্রথম দিনই ২০ খানা সিট বাংলার বাইরের (মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লী, নাগপুর ইত্যাদি) ক্যান্ডিডেটরা বুক করে ফেলেন। বাংলার জন্য রাখা সিট ভর্তি হতে লাগে পরবর্তী দুই সপ্তাহ। বাংলার বাইরের ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে ছিলেন ব্যাঙ্গালোরের প্রফেসর ডাক্তার বা বেনারসের সমাজসেবী ইটালিয়ান ডাক্তারও !

কেন না, বিকলাঙ্গতা দূরীকরণে যাঁরাই সদা তৎপর, তাঁরা সবাই প্রফেসর প্রেক্টলের জি.এম পদ্ধতি সম্বন্ধে অবগত। এক কালের মূল সমস্যা ছিল উচ্চ গুণমানসম্পন্ন সার্টিফিকেশনের আন্তর্জাতিক ট্রেনিংয়ের অভাব। কলকাতার ট্রেনিংপ্রাপ্ত দলের মধ্যে থেকে ১০ জনকে বাছা হবে, যাঁদের অ্যাডভান্সড্ জি.এম কোর্স করানো হবে। এছাড়াও এ বছরের মতো নতুন ৪০ জনকে সুযোগ করে দেওয়া হবে এই ট্রেনিংয়ের। আমরা আশায় থাকব যে নিজের রাজ্যেরই ৪০টি মানুষ এবারে সেই তৎপরতা দেখাবেন যাতে ভিন্ন রাজ্যের মানুষদের অন্য সেন্টার থেকেই ট্রেনিং নিতে হয়। দেখতে খারাপ লাগে যে ভিন প্রদেশের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এগিয়ে থাকছেন আমাদের প্রদেশের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে এই কোর্সের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যাপারে তৎপরতায়। যেমন আমরা চাঁইব, এই আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ নিতে এগিয়ে আসবেন রাজ্যের SNCU যত আছে, তাদের মেডিক্যাল অফিসারেরা এবং অন্তত এক বা দু’ জন থেরাপিস্ট। যাতে প্রতিটি SNCU-তেই দুই থেকে তিনজন যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও স্বাস্থকর্মীর দল থাকে শিশু রক্ষার কান্ডারি হিসাবে।

রাজ্যময় GM (Prectle) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী থাকলে লাভটা কী হবে শুনি? 

আজকে যদি কোনও শিশু প্রিম্যাচিওর হয়ে জন্মায়, বা তার জন্মের ওজন আড়াই কিলোর কম হয় বা তার আই.সি.ইউ চিকিৎসা লাগে, অন্ততপক্ষে ৯৮% নিশ্চয়তার সাথে আমাদের রাজ্যের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এরপর বলে দিতে পারবেন (যাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) শিশুটির তিন মাস বয়সের মধ্যেই বিকলাঙ্গতার সম্ভাবনা আছে না নেই। বিশেষ করে সি.পি হওয়ার সম্ভাবনাটি ৯৮% নিশ্চিত করা যাবে।

একটি সদ্যোজাত শিশুর জন্মের তিন মাসের মধ্যেই যদি অতটা স্থির নিশ্চিত করা যায়, যে সে ভবিষ্যতে আজন্মকাল ভোগবার মতো কোনও বিকলাঙ্গতার শিকার হতে চলেছে, তবে আশু চিকিৎসারও যথাযথ বন্দোবস্ত করে ফেলা যাবে তখন। কেননা, বিকলাঙ্গতা শরীর-মনে গেড়ে বসে চোখে দেখে বুঝতে পারার আগেই। সেটাই ভয়ঙ্কর। সেই কারণেই প্রবাহমান কাল থেকে বিকলাঙ্গ হওয়ার পরে দমাদম বুক চাপড়ে আফশোস করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকে না। যিনি নিজে বিকলাঙ্গতায় ভুগছেন, বা যাঁর বাড়িতে কোনো বিকলাঙ্গ শিশু আছে, সেই ভুক্তভোগীই জানেন এর যন্ত্রণা।

বিকলাঙ্গতা সারানোর অস্ত্র হল প্রতিসেধক। অর্থাৎ রোগ মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই তাকে সনাক্ত করা ও প্রতিষেধক মূলক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যেমন পক্স রোগ হওয়ার আগেই পক্সের টিকা দেওয়া। যেহেতু বিকলাঙ্গতা দৃশ্যমান হয়ে উঠলে তা আর সহজ চিকিৎসার গ্রুপে পড়ে না, তাই বিকলাঙ্গতার সম্ভাবনা ধরার মধ্যেই এর মূল সমাধান লুকিয়ে রয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক কারণ হল নিউরাল প্লাস্টিসিটি বা স্নায়ুর মেরামত হওয়ার সীমিত ক্ষমতা।

নিউরাল প্লাস্টিসিটি বিজ্ঞান আমাদের ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তলায় ফটো তুলে তুলে দেখিয়েছে যে স্নায়ুকোষ ড্যামেজ হলে মেরামত করা যায় বটে, তবে সেই সুযোগ সে দেয় সীমিত সময়ের জন্য। সেরিব্রাল পালসি জনিত বিকলাঙ্গতার ক্ষেত্রে সেই সুযোগ থাকে জীবনের প্রথম ১০ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত মাত্র। অর্থাৎ এক বছরের আগে যদি সুচিকিৎসা চালু করা না যায়, তাহলে সেরিব্রাল পালসি হওয়ার প্রকোপ থেকে রক্ষা করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। হয় না তা বলছি না, কিন্তু কাঠখড় পোড়াতে হয় প্রচুর। উল্টো দিকে, এক বছরের আগে থেকেই যদি সুচিকিৎসা চালু করা যায় তাহলে দেখা গেছে শিশুটি হয় সি.পি-র প্রকোপে পড়লই না, নতুবা স্বল্প আক্রান্ত হল মাত্র !

তবে হ্যাঁ, চিকিৎসাটা উচ্চমানের ও যথাযথ হওয়া খুবই জরুরি। ভারতবর্ষ তাই এই মুহূর্তে ভাবী সৌভাগ্যের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমন একটি উচ্চমানের ট্রেনিং ভারতবর্ষের শহরে শহরে আজ হতে চলেছে যে, দেশ যদি যথাযথভাবে ট্রেনিং মাফিক এই দ্রুত সনাক্তকরণ পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলতে পারে, তবে আগামী দু’ তিন বছরের মধ্যেই বিকলাঙ্গতার অভিশাপ বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

অতীতে যথাযথভাবে কিছু করার ব্যাপারে দেশের রেকর্ড খুবই দুঃখজনক ছিল। ফলে আশঙ্কা থেকেই যায়। কিন্তু আশা ছাড়াও তো মহাপাপ ! যদি আচম্বিতে পেরেও যায়, তবে কত লক্ষ লক্ষ শিশু বেরিয়ে আসবে বিকলাঙ্গতার ঘেরাটোপ থেকে তা ভাবলেও শিহরণ জাগে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular