গলার সংক্রমণ খুব সাধারণও হতে পারে, আবার খুব মারাত্মকও হতে পারে। তাই গলার সম্বন্ধে একটু জেনে রাখা দরকার। গলার পিছনের দিকের দেয়ালটাকে বলে ফ্যারিংস, ফ্যারিংসেরই দু’পাশে থাকে দুটো টনসিল। আর ফ্যারিংসের দেওয়ালে ছোট ছোট অনেক লিম্ফনোড থেকে সেগুলোও এক ধরনের টনসিল।
এছাড়া নাকের পিছনের দিকে যে দেওয়াল সেটাও ফ্যারিংসের একটা অংশ। তাকে বলে ন্যাসো ফ্যারিংস। সেখানেও কিছু লিম্ফনোড থাকে। টনসিলাইটিস বলতে আমরা প্রাথমিকভাবে টনসিলের মধ্যে অবস্থিত একগুচ্ছ লিম্ফ ফলিকলসের সংক্রমণ বুঝি। কিন্তু সংক্রমণ হলে দেখা যায় টনসিল, ফ্যারিংস ও ন্যাসো ফ্যারিংস লিম্ফ ফলিকলসগুলো একসাথে আক্রান্ত হয়। আবার গলার সাথে কান এবং নাকের যোগাযোগ থাকায় এই সংক্রমণ গলা থেকে কান ও নাকে ছড়িয়ে যেতে পারে।
অনেকেই হয়তো জানেন না যে, গলাতে কতকগুলো জীবাণু থাকে, সেই জীবাণুগুলো এমনিতে কিন্তু কোনো রোগের প্রকাশ করে না। এগুলোকে কমেনসাস বলে। এই ধরনের জীবাণুর মধ্যে আছে স্টেপ্টোকক্কাস ব্যাক্টেরয়েডস, স্টেপ্টোকক্কাস নিউমনি। কোনো কারণে মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন কমে যায় তখন এই কমেনসাসগুলোই তাদের চরিত্র পরিবর্তন করে । এবং গলাকে রোগাক্রান্ত করে তোলে।
সাধারণভাবে অত্যধিক পরিশ্রম, গরম থেকে ঠান্ডা বা ঠান্ডা থেকে গরমে গেলে অর্থাৎ ঘরে বাইরের তাপমাত্রার মধ্যে বেশি পরিবর্তন হলে – কিংবা বৃষ্টিতে ভিজলে, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকলে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে । তাছাড়া যারা দীর্ঘদিন কোনো রোগ ভোগ করছেন, যেমন—হয়তো ডায়াবেটিসে ভুগছেন অথবা এইডসে আক্রান্ত, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। সেক্ষেত্রে সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এই সংক্রমণ আবার বাচ্চা ও বয়স্কদের মধ্যে চট করে হবার সম্ভাবনা থাকে। কারণ তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্কুলে যাবার আগের বাচ্চাদের মধ্যে শতকরা তিরিশ জন বছরে ছয় থেকে আটবার গলার সংক্রমণে ভুগে থাকে । বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই জাতীয় সংক্রমণে ভোগার জন্য প্রচুর কাজের দিন নষ্ট হয় এবং যে সব বাচ্চা স্কুলে যায় বলাই বাহুল্য তাদের স্কুল কামাই হয়।
Table of Contents
সংক্রমণ ক’ধরনের হয়
গলার সংক্রমণ প্রধানত তিন ধরনের হয়, যেমন—
- ভাইরাস জনিত।
- জীবাণুজনিত।
- ছত্রাকজনিত।
ভাইরাস জনিত সংক্রমণ
যে সমস্ত ভাইরাস সাধারণত এই সংক্রমণের জন্য দায়ী সেগুলো হল সাইটোমেগালো, এডেনো, ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ এবং বি. কক্সাকি আর করোনা ভাইরাস।
এছাড়া বর্তমানে এইচ-ওয়ান, এন-ওয়ান বা সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণও দেখা যাচ্ছে। এই সমস্ত ভাইরাসের সংক্রমণ জনিত উপসর্গ একইরকম।
রোগ-লক্ষণ ও চিকিৎসা: সাধারণত ঠান্ডা লাগা, নাক দিয়ে জল পড়া, কাশি, গা-হাত-পা ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব দেখা যায়। সোয়াইন ফ্লুর ক্ষেত্রে এর সাথে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে ।
তবে ভাইরাস সংক্রমণে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয় না। প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, প্রচুর জল ও ফলের রস খাওয়া এবং বিশ্রামের দিকে লক্ষ রাখতে হয় । ভাইরাস সংক্রমণের পরে কারো কারো কিন্তু জীবাণুজনিত সংক্রমণ হতে পারে। বিশেষত, বাচ্চা এবং বয়স্কদের, ডায়াবেটিস বা এইডস রোগী অথবা যাদের ক্রনিক চেস্ট ইনফেকশন বা কিডনির সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
সোয়াইন ফ্লু সন্দেহ হলে, গলার লালা পরীক্ষা করে যদি ভাইরাস পাওয়া যায় তবে নার্সিং হোম কিংবা হসপিটালে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হবে।
![গলার সংক্রমণ : খুব হালকা ভাবে নেবেন না, হতে পারে বড়ো বিপদের ইঙ্গিত | Throat Infection | 2024 1 Throat Infection](http://banglaobangali.in/wp-content/uploads/2023/10/Throat-Infection-1024x768.jpg)
জীবাণু জনিত সংক্রমণ
জীবাণুজনিত কারণে গলার যে সংক্রমণ হয় তার জন্য দায়ী স্ট্রেপ্টোকক্কাস, স্ট্যাফাইলো- কক্কাস, নিউমোকক্কাস, নাইসেরিয়া, এইচ. ইনফ্লুয়েঞ্জি প্রভৃতি জীবাণু।
রোগ-লক্ষণ ও চিকিৎসা : এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা দরকার। দোকান থেকে কিনে অথবা নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। কেননা তাতে এই সব জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে ফেলে এবং ভবিষ্যতে এই সংক্রমণ ক্রনিক হয়ে যায়। যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের এই সংক্রমণের সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে বছরে তিন-চারবার অবধি সংক্রমণ হতে পারে। টনসিলের সংক্রমণ যদি ক্রনিক হয় সেক্ষেত্রে টনসিলাইটিস থেকে হার্টের বা কিডনির সমস্যাও দেখা দিতে পারে ।
বর্তমানে টনসিল অপারেশন বেশি করা হয় না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে টনসিল অপারেশন করা জরুরি হয়ে পড়ে। যেমন, যেসব ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করতে চায় না ৷ প্ৰতি মাসে যদি কারো একবার করে গলাব্যথা, জ্বর অথবা টনসিলে যদি ফোঁড়া বা অ্যাবসেস হয় । অথবা যদি টনসিল থেকে হার্ট বা কিডনির সমস্যা হয় তাহলে টনসিল অপারেশন করতেই হয় । অনেকেরই একটা ভয় থাকে, তবে টনসিল অপারেশন করলে গলার স্বর খারাপ হয় না । এখন যেভাবে টনসিল অপারেশন হয় তাতে গলার স্বর বসে যাবার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না।
ফ্যারিঞ্জাইটিসেও যথাযথ চিকিৎসার পর কতকগুলো সাবধানতা মেনে চলার দরকার হয় । যেমন অতিরিক্ত গরম-ঠান্ডা না করা, রোদ থেকে এসেই অতিরিক্ত ঠান্ডা জল না খাওয়া, বৃষ্টিতে না ভেজা ইত্যাদি।.
ছত্রাক জনিত সংক্রমণ
ছত্রাকজনিত সংক্রমণের মধ্যে খুব সাধারণ সংক্রমণ হল ক্যানডিডা সংক্রমণ। সাধারণভাবে বৃদ্ধ, যারা খুব অসুস্থ, যারা অনেকদিন ধরে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন অথবা যারা স্টেরয়েড নিচ্ছেন, দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ও ইনহেলার ব্যবহার করছেন, ডায়াবেটিস অথবা এইডসের রোগী, তাদের এই ধরনের ছত্রাকজনিত সংক্রমণ দেখা যায়।
রোগ-লক্ষণ ও চিকিৎসা : ছত্রাকজনিত সংক্রমণ থেকেই অনেকসময় এইডস হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। অর্থাৎ এইডসের প্রাথমিক লক্ষণ এটা হতে পারে। ছত্রাকজনিত সংক্রমণ হলে এইডসের সম্ভাবনা মাথায় রাখেন ডাক্তাররা। এবং তার জন্য যথোপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। মুখের ভিতরে সাদা সাদা দাগ উঁচু হয়ে থাকতে দেখা যায়। মুখের ভেতরে উপরের দিকের তালুতেও এই দাগ দেখা যায়। হালকা সাদা একটা লেয়ারের মতো পড়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে এগুলোর লাল ভাবও দেখা যায়। এই লাল ভাব যেখানে থাকে সেখানে এইচ.আই.ভি বা এইডসের কথাটা মাথায় রাখতে হয়। এই লাল ধরনের আলসার তালুতে না হয়ে গালের দু’পাশে জিভে বেশি দেখা যায়। এখানে কিন্তু আলসার থেকে রোগটা খারাপ দিকে যেতে পারে। অর্থাৎ এই ‘ধরনের লক্ষণ ক্যানসারের দিকে ইঙ্গিত দেয়। সেই হিসেবে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ কিন্তু খুব দক্ষতার সাথে চিকিৎসা করা দরকার। নিজের ইচ্ছেমতো দোকান থেকে মলম কিনে লাগাবেন না। দোকান থেকে নিজের ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাবার প্রবণতা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকে। এগুলোতে কিন্তু বিপদ আরো মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়।