সাপের থেকেও বড়ো বিপদ | 2024

গ্রামের বাড়ির ঘরের বারান্দাতে আবার সাপ! কোথা থেকে এল কে জানে। উঁচু পাঁচিল চারদিকে। উঠোন সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। আশপাশে ঝোপঝাড় কিছুই নেই। ঝকঝকে তকতকে চারদিক। অথচ সেখানে সাপ! ছোট গোখরো সাপের বাচ্চা। গাঁয়েগঞ্জে এই সাপের উপদ্রব তেমন তাজ্জব কোনো ব্যাপার নয়। বিশেষ করে বর্ষার শুরুতে, শীতের শেষে আকছার এদের ঘোরাফেরা চোখে পড়ে। কিন্তু সে তো সাপের কথা। আজ সাপের কথা বলতে বসিনি। কিন্তু সাপের দাঁতের দুটো দাগ নিয়ে ফারুক নানা সেদিন সকালে এসে হাজির। খামার বাড়িতে মাঠের পথে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করতে করতে হঠাৎ পায়ে জ্বালা। গ্রাহ্য না করে বনের পথে চলে যেতে যেতে খেয়াল হল জায়গাটা বেশ জ্বালা করছে। ঘরে এসে জল দিয়ে পা ধুয়ে দাঁতের দুটো দাগ দেখে তার আক্কেল গুড়ুম। কেননা বিষধর সাপের বিষদাঁতের জোড়া দাগ ঠিক এরকমই। সর্প বিশেষজ্ঞরা ওইরকম দাঁতের দাগ দেখেই বিষক্রিয়ার তদন্ত করেন।

কিন্তু অন্য কারোর কামড় হলে। যাদের কামড়ে কেশ নগরে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়েছিল কবি ঈশ্বর গুপ্তকে। দেশান্তরী করেই ছেড়েছিল কেশ নগরের মশা। আমরা সাপ-খোঁক, ইঁদুর-ছুঁচোর জ্বালায় গাঁয়েগঞ্জে জেরবার। মশাতে আমাদের অত মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু না! ব্যাপারটা এত সহজ আর নেই। এই ছোট্ট এক দু’ডানার পতঙ্গ বিশ্ব কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অথচ দরজা জানালার ফাঁকফোকর সাপের উপদ্রবে সামলাতে আমরা যতনা ব্যস্ত, এই ছোট ছোট পোকামাকড়ের জন্যে ততটা নই। আর বিপদ এখানেই। আসুন এই ছোট্ট পতঙ্গ সাপের থেকেও বিপজ্জনক কেন, তাই আজ বোঝানোর চেষ্টা করব।

বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের প্রাণী জগতকে বিজ্ঞানীরা নানান ভাগে ভাগ করেছেন। এদের বিজ্ঞানগত ভাবে বলা হয় ফাইলাম (Phylum)। খালি চোখে দেখা যায় না এমন হাড়গোড়হীন প্রাণী থেকে মেরুদন্ডী মানুষ পর্যন্ত—নানান ফাইলাম। উদাহরণস্বরূপ— প্রোটোজায়া, কৃমি, হেলমিন্থ, শম্বুক বা মোলাস্কাম, সন্ধিপদী বা আর্থ্রোপড এবং কর্ডাটা— এরকম নানান ফাইলাম। কর্ডাটার মধ্যে মৎস্য, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী আর স্তন্যপায়ী প্রাণী, এরকম সহজ ভাগ আমরা স্কুলে পড়েছি। সবার কথা থাক। সন্ধিপদী বা আর্থ্রোপড ফাইলাম আমাদের গন্তব্য। কাঁকড়া, বিছে, কেন্নো, মাকড়সা আর পতঙ্গ বা ইনসেক্ট নিয়ে সন্ধিপদীর সংসার। এই ফাইলাম আর্থোপডার আবার উপবিভাগ আছে। মশা, মাছিকে খুঁজে পেতে আমাদের সেই উপবিভাগে ঢুকতেই হবে। আর্থোপডার একটি শ্ৰেণী বা ক্লাস হল হেক্সাপোডা। এক কথায় এদেরই আমরা পতঙ্গ বলে থাকি। অর্থাৎ ইনসেক্টস্। পতঙ্গকে কোনোদিনই তেমন ভালো চোখে দেখা হয়নি। যুগে যুগে কত অঘটনের কারণ হয়েছে, কত যুদ্ধে ধরাশায়ীর অন্যতম কারণ হয়েছে তা ইতিহাস আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। নানারকম পতঙ্গের নানান শ্রেণী বিভাগে বিভ্রান্ত না করে সরাসরি তাদের নামগুলো আগে বলে নিই। পতঙ্গের মধ্যে আসবে ফড়িং, ঘাস ফড়িং, ঝিঝিপোকা, আরশোলা, উইপোকা, উকুন, ছারপোকা, প্রজাপতি, মথ, মাছি, ফ্লি, পিঁপড়ে, মৌমাছি এবং মশা। কীসব সাংঘাতিক এবং মারাত্মক রোগের কারণ ওই তুচ্ছ পতঙ্গরা জানলে আর সাপের পিছনে দৌড়াবেন না। পাহারা বসান ওই ষট্‌পদী প্রাণীদের ওপর, যেন জানালা গলে ঘরে না ঢুকতে পারে ।

সন্ধিপদী প্রাণীদের দ্বারা যে সমস্ত রোগ আমাদের আক্রমণ করে সেই সম্পর্কে প্রথমে সংক্ষেপে আলোচনা করি নিই।

ম্যালেরিয়া : 

পরজীবী সংক্রমণ এই রোগের কারণ। পরজীবী দেহে প্রবেশ করার মোটামুটি সাত দিনের মাথায় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আর সাধারণ সর্দিকাশির মতো উপসর্গ দেখা দেয়। পরজীবী প্রায় পাঁচ প্রকারের প্লাসমোডিয়াম গণ বা জিনাসের অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেকের প্রজাতি বা স্পেসিস হিসাবে নাম রাখা হয়েছে। এই পাঁচ প্রজাতির মধ্যে অন্যতম হল প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স আর প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম। প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম থেকেই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া ও সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার উৎপত্তি। এই ম্যালেরিয়ার সাথে সাথে নানান জটিলতা জুড়ে বসে এবং বেশ গুরুতর অবস্থা ও মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। এই যে প্লাসমোডিয়াম নামে আনুবীক্ষণিক পরজীবী, এরা দেহে ঢোকে কীভাবে? এরা রক্তের কোষে ঢুকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর লোহিত রক্তকণিকা হল এদের বাসস্থান। রক্তে থাকা এই পরজীবী মশার কামড়ে রক্তের সাথে মশার দেহে যায়। সেখান থেকে এই মশা দ্বিতীয় কোনও সুস্থ মানুষের দেহে ছড়িয়ে দেয় বাহক হিসাবে। সুতরাং মশা বাহিত এই রোগ প্রায়শ মহামারির আকার ধারণ করে। 

Leishmaniasis

ডেঙ্গু : 

এটির কারণ ডেঙ্গু ভাইরাস। চার রকমের ভাইরাস আমরা জানি। তাদের নাম ডেন-ওয়ান, ডেন-টু, ডেন-থ্রি আর ডেন-ফোর (DEN- 1, DEN-2, DEN-3, DEN-4)155 তাপমাত্রা, মাথার যন্ত্রণা, হাড়গোড় ভাঙা দেহের ব্যথা, বমি ইত্যাদি হল প্রধান উপসর্গ। যেকোনো সময় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। প্লেটলেট দারুণভাবে কমে যায়। আর দেহে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। রক্তে থাকা জল রক্তবাহী নালিকা থেকে সহজেই বেরিয়ে যায়। এভাবে রক্তের আয়তন মারাত্মকভাবে কমে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। এই ভাইরাস দেহে ঢুকতে মশার দরকার। মশা একবার রক্ত চুষে কোটি কোটি ভাইরাস নিজের দেহে বহন করে। যতদিন বাঁচে আর যাকে কামড়ায় তার দেহে সংক্রমণ ঘটায়।

চিকুনগুনিয়া :

কম মারাত্মক, কিন্তু দারুণ ভোগান্তিকারী অসুখ। জ্বর ছাড়াও প্রচন্ড জয়েন্ট পেন বা সন্ধিস্থলের হাড়ের ব্যথা, খুব সাধারণ উপসর্গ। বাতের মতো এই সন্ধিস্থলের বেদন বেশ কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস, এমনকী বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। চামড়াতে ঘামাচির মতো ফুসকুড়ি বেরোতে পারে। তবে এই রোগ সাধারণত সরলসিধা, ভোগান্তি দিয়েই চলে যায়। প্রাণঘাতী কোনো জটিলতা ঘটে না। এই ভাইরাস আমাদের দেহে প্রবেশ করে কোনো না কোনো মশার কামড়ে। আমাদের দেশে ইডিস গণের মশাই এই রোগ ছড়ায় ।

এনকেফেলাইটিস : 

মারাত্মক এই এনকেফেলাইটিস আমাদের অনেকের সংসারে মহা বিপদ ডেকে এনেছে। বিশেষ করে শিশু ও অতি বৃদ্ধদের ভোগান্তি মারাত্মক। এই ভাইরাস মশার (কিউলেক্স) দ্বারা আমাদের দেহে ঢোকে। মশার দেহে এই ভাইরাস কোথা থেকে আসে? না অন্য মানুষের দেহ থেকে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর মতো মশার দেহে এই ভাইরাস ঢুকতে পারে না। মানুষের রক্তে ভাইরাসের ঘনত্ব খুবই কম থাকে। শূকর ও কিছু পাখি হল এই ভাইরাসের আঁতুড়ঘর। বিশেষ মরশুমে জন্তুর দেহ থেকে এই মশা ভাইরাস আক্রান্ত হয় আর পশুঘর ছেড়ে নিকটবর্তী জনবসতিতে গিয়ে মানুষকে কামড়ায়। কিউলেক্স মশাই এর বাহক।

গোদ বা ফাইলেরিয়া : 

যদিও জ্বর হল এর প্রধান উপসর্গ। দেহের লিম্ফ প্রবাহতন্ত্ৰ বা লিম্ফাটিক্সের আক্রমণ ঘটে ওই পরজীবী বা প্যারাসাইট দ্বারা। সুতোর মতো দেখতে কৃমি জাতীয় এই পরজীবী মশার কামড়েই দেহে ঢোকে রোগ। পা ফুলে কলাগাছ বা এলিফ্যন্টিয়াসিস হাইড্রোসিল এই রোগের বহুল দৃষ্ট উপসর্গ

কালাজ্বর বা লিসম্যানিয়াসিস : 

স্যান্ডফ্লাই এর পরজীবীকে মানুষের দেহে প্রবেশ করায়। পরজীবীর নাম লিসম্যানিয়া ডোনোভানি। এই রোগের প্রধান উপসর্গ জ্বর। মীহা বেড়ে যাওয়া, রক্তহীনতা ও ক্রমে ক্রমে ভুগে মৃত্যুমুখে পড়া।

অঙ্কোসারসিয়াসিস : 

এই রোগের কারণ এক পরজীবী। নাম অঙ্কোসারকা ভালভিউলাস। চামড়ার চুলকানি, লিম্ফনোড বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। এই পরজীবী বাহিত হয় একরকম মাছি দ্বারা যার নাম সিমুলিয়া।

লাইম ডিজিজ : 

একটি ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ জনিত রোগ। জ্বর ও সঙ্গে গায়ে হাতে- মাথায় ব্যথা । চামড়ায় র‍্যাশ আর গাঁটে গাঁটে ব্যথা হল প্রধান উপসর্গ। গাঁটে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই ব্যাক্টেরিয়া মানুষের দেহে ঢোকে টিক নামক আর্থোপড়ের কামড়ে। হরিণ থেকে শুরু করে ইঁদুর-ছুঁচোর মধ্যে এই ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ঘটতে পারে। একের থেকে অন্যের দেহে রোগ ছড়াতে থাকে এই টিক। তবে টিক অন্যান্য আরও অনেক রোগ ছড়াতে পারে। আমাদের দেশে সে সব রোগ তেমন ঘটে না।

ট্রিপানোসোমিয়াসিস : 

ভাঙা বসতবাড়ির ফাটলে, গর্তে একরকম পোকা-পতঙ্গ বসবাস করে। যাদের বলে বাগ। ছারপোকা যেমন। এদের পায়খানার সাথে সংক্রামিত এক পরজীবীর নাম হল টিপানোসোম। এই ট্রিপানোসোম বেশ কয়েক প্রজাতির। রোগের ভিন্নতাও মহাদেশ ও প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল। আফ্রিকাতে ঘুম রোগ বা স্লিপিং সিকনেস-এর কারণ এই পরজীবী। আবার আমেরিকাতে অন্য প্রজাতি। রোগের নাম শাগাজ ডিজিজ। জ্বর, গা-হাত ব্যথা, কুঁচকি ওঠা থেকে শুরু করে রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়, স্নায়ুতন্ত্রকে শেষ পর্যন্ত আঘাত করে এবং মৃত্যু ঘটে। বাগের কামড় থেকে সংক্রমণ ঘটে না। খেতে বসে এরা যে চামড়ার ওপর মলত্যাগ করে তার মাধ্যমেই কোটি কোটি পরজীবী চামড়া ভেদ করে রক্তে প্রবেশ করে। তাই বাঘ নয়, বাগ থেকে সাবধান। তবে আমাদের দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব নেই।

ইয়োলো ফিভার, জিকা ফিভার, ইস্টার্ন ইকুইন এনকেফেলাইটিস (ই.ই.এন), ওয়েস্টার্ন ইকুইন ভাইরাস (ডব্লু.ই.এন) রোগগুলিও ভাইরাস সংক্রামিত রোগ। আমাদের দেশে হয় না। ভাইরাস মশা দ্বারা সংক্রামিত হয়। তবে সাবধানতা দরকার। বিশ্বে কখন কোথায় কে আক্রান্ত হবে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।

কলেরা, ওলাওঠা, আমাশা, আন্ত্রিক, টাইফয়েড কতকগুলো রোগ আমরা খুব চিনি । কলেরা ব্যাক্টেরিয়া জনিত রোগ। টাইফয়েডও তাই। আমাশা, আন্ত্রিক পরজীবী দ্বারা সংক্রামিত রোগ। এইসব রোগ উল্লেখ করছি এই কারণে যে, এসব রোগ ছড়ানোর অন্যতম কারিগর মাছি—সেই পতঙ্গ। কীভাবে জীবাণু এক খাদ্য থেকে অন্য খাদ্যে ছড়িয়ে দিয়ে মহামারি করে সেটা মাছির বর্ণনার সময় বলব।

রোগের কথা অনেক হল। এবার একটু বিস্তারে এই পতঙ্গ কুলের বিবরণ দেব। কীভাবে তারা রোগ ছড়ানোর অপকীর্তিটুকু করে থাকে ।

পড়ুন : দৈনিক মদ্যপানে লিভার ড্যামেজের ঝুঁকি কতটা ?

মশা

ক্লাস বা শ্রেণী হল ইনসেক্ট। যা ফাইলাম আর্থোপডা অন্তর্গত। অর্ডার হল ডিপটেরা। এরপর পরিবার বা ফ্যামিলি। এই পরিবারে অনেক গণের বা জিনাসের মধ্যে কয়েকটি হল ইডিস, অ্যানোফিলিস, কিউলেক্স, লুটিজিয়া, মালায়া ইত্যাদি। দুনিয়াতে তিন হাজার প্রজাতির মশা বর্তমান। এদের মধ্যে অ্যানোফিলিস, কিউলেক্স আর ইডিস এই তিনটিই হল মানুষের মশাবাহিত রোগের তিন হাতিয়ার। সাপ মারাত্মক প্রাণী সন্দেহ নেই, বিশেষত নানান ধরনের বিষধর সাপ। কিন্তু জাপানের সবচেয়ে ভয়ানক প্রাণঘাতী প্রাণী হল মশা। ইতিহাস কী বলে জানি না, তবে মহামতি আলেকজান্ডার খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৩-তে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে কথিত আছে। মশার কতকগুলি কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য নীচে দিলাম :

  • মশাদের কোনো দাঁত নেই। তবে স্ত্রী মশাদের মুখে লম্বা শুঁড় মতো অঙ্গ থাকে যাকে প্রোবোসিস বলে। প্রোবোসিসের সাথে দুটি নালিকা বা টিউবস। একটা দিয়ে মশা রক্ত চোষণ বা শোষণ করে, অন্যটা দিয়ে লালার সাথে মিশিয়ে কিছু বেদনানাশক রাসায়নিক ও রক্ত যাতে জমাট না বাঁধতে পরে এমন রাসায়নিক অর্থাৎ অ্যান্টি কোঅ্যাগুলেন্ট শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। চামড়ার ওপর এই রাসায়নিক কারো কারো দেহে বিরূপ অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে সামান্য একটু চুলকানি দিয়েই শেষ। অন্যান্যদের আমবাতের মতো জোরদার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এই অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হওয়ার মূল কারণ মশা নিঃসৃত লালার সাথে থাকা ওইসব রাসায়নিক।
  • পুষ্টির জন্য খাদ্য হিসাবে সব মশাই গাছপাতা ফলমূলের রস পান করেই শক্তি জোগাড় করে। কিন্তু শুধুমাত্র স্ত্রী মশাদের ডিমের পরিণতির জন্যে মানুষের রক্তের প্রোটিন অবশ্যই চাই। ডিম পাড়ার আগে স্ত্রী মশা রক্ত পান করবেই, নইলে বংশ রক্ষা হবে না ।
  • মশা জীবনের প্রথম ১০ দিন জলে কাটায় । লার্ভা পিউপা দশাতে জলের জৈব উপাদান খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। সময় হলে রূপান্তরিত ডানাওয়ালা পরী ঘুড়ি মশাতে পরিণত হয়। ঘণ্টায় দেড় মাইল দৌড় দিতে পারে। যদিও কয়েক ফুটের মধ্যে তারা ওড়াউড়ি করে। দরকারে ১ থেকে ৩ মাইল, এমনকী ৪০ মাইল পর্যন্ত যেতে পারে।
  • মশারা মানুষের নিঃশ্বাসের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্ধারণ করতে পারে। তাদের শুঁড় বা অ্যান্টেনাতে বিশেষ রাসায়নিক গ্রাহক বা রিসেপ্টার থাকে। এই কার্বন ডাই অক্সাইড ধরে কাছাকাছি কার্বন ডাই অক্সাইড প্রশ্বাসে ছাড়ছে এমন প্রাণীর সন্ধান পায় মশারা। তাছাড়া আমাদের দেহে ঘামের সাথে যেসব রাসায়নিক পদার্থ বেরোয় তাতে গন্ধ উৎপাদনকারী প্রায় সাড়ে তিনশো উপাদান থাকে। এইসব গন্ধ ধরার ক্ষমতা আছে মশাদের। ঘামের কোলেস্টেরল, ফলিক অ্যাসিড এবং ঘামের অক্টেনল নামক রাসায়নিক সহজে নির্ধারণ করে নিয়ে খাবার তোড়জোড় শুরু করে দেয়।
  • মশার দেহে তাপ অনুভব করারও যন্ত্র রয়েছে। মুখের আশপাশে নানান প্যাজেট লাগানো আছে। তাতে মানবদেহের তাপ সেন্স করে আর গরম রক্ত থাকা ক্যাপিলারিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে প্রোবোসিস ঢুকিয়ে দিয়ে কাজ সারে।
  • দিনে রাতে প্রজাতি অনুসারে মশার রক্তচোষার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণভাবে ইডিস দিনের বেলা বেশি পছন্দ করে। অন্যদিকে কিউলেক্স আলো-আঁধারি তথা গোধূলি বা ভোরকে বেশি পছন্দ করে। তবে তাদের এই চরিত্র ইদানিং কলুষিত হয়েছে। যখন তখন রক্ত খাওয়ার প্রবণতা ধরা পড়ছে।
  • মশা তার জীবনকালে সাধারণত তিনবার ডিম পাড়ে। আর প্রতিবারই তার রক্ত চাই-ই। একেকবার মাত্র শ’ তিনেক (৩০০) ডিম পাড়ে একটি স্ত্রী মশা। মশা একবারে তার দেহের তিনগুণ ওজনের রক্ত পান করতে পারে।
  • মশার আয়ুষ্কাল গড়পড়তা ২ মাসের কম। পুরুষ মশা ১০ দিনের বেশি বাঁচে না। আর স্ত্রী মশা সাধারণত ৬ সপ্তাহ থেকে ৮ সপ্তাহ বাঁচে। তবে ঠান্ডাতে মশারাও শীতঘুমে যায় এবং সেক্ষেত্রে ৬ মাস পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।

মশার মাধ্যমে পরজীবী ও ভাইরাস, এক দেহ থেকে বা উৎসস্থল থেকে সংবাহিত হয়ে সংক্রমণ ঘটায় দু’ভাবে। এক, খাদ্যনালীতে বেড়ে ওঠা পরজীবীর বমি বা খাদ্যের উদ্‌গীরণের সাথে দেহে ঢুকে শিরার মধ্যে ঢুকে যায়। যেমন ম্যালেরিয়া। আর দুই, ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেমন ডেঙ্গু বা পীতজ্বর মশার লালার সাথে বেরিয়ে এসে রক্তে মেশে। এসব অবশ্য গবেষকরা বলছেন। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটে ঈশ্বরই জানেন।

এই অবসরে বিভিন্ন প্রজাতির মশার পছন্দের জায়গা এবং ডিম পাড়ার ভিন্নতা নিয়ে দু’ কথা- বলে নিই। মশা যেকোনো পরিবেশেই মানিয়ে নেয়, একমাত্র চরম ঠান্ডা আবহাওয়া ছাড়া। বনজঙ্গল, জলা জায়গা, লম্বা ঘাসের বন, ঝোপ- ঝাড় এবং খোলা ভিজে মাঠ— এসব জায়গাতেই মশা বংশবিস্তার করে। তবে জল অত্যাবশ্যক। বছরের কিছু সময় অন্তত জলে থাকতেই হবে। মোটামুটিভাবে আমাদের তিন প্রকার বিপজ্জনক মশার মধ্যে অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স স্থায় স্থির স্বচ্ছ জলাশয়ের জলই পছন্দ করে। আর অন্যদিকে ইডিস প্রজাতি জমা জল, নোংরা, গলি- গুপচির জল, টায়ারের জল, ছাদের কোটরের জল ডিম পাড়ার জন্য বেছে নেয়। মশা দমন করতে এ ব্যাপারগুলো মাথায় রাখতে হবে, মশার কাহিনী শেষ করব আবারো মশা দ্বারা ছড়ানো রোগের নাম দিয়ে।

  • পরজীবী বহন করে রোগ ছড়ায় : ম্যালেরিয়া—অ্যানোফিলিস দ্বারা।
  • মাছির ডিম দ্বারা মায়াসিস : যেকোনো মশা দ্বারা।
  • কৃমি জাতীয় পরজীবী— ফাইলেরিয়াসিস— কিউলেক্স মশা দ্বারা ।
  • ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে — ডেঙ্গু, পীত জ্বর, —ইডিস মশা দ্বারা।

পড়ুন : দুশ্চিন্তা থেকে হার্টের অসুখ

মাছি

আর্থ্রোপড বা সন্ধিপদী প্রাণীর (ফাইলাম) ইনসেক্ট শ্রেণীর অন্তর্গত মিউসিডা, গণের নাম মুস্কা। পুরো নাম মুস্কা ডমেস্টিকা বা হাউস ফ্লাই বা সাধারণ মাছি। আমরা রাতে মশা, দিনে মাছি এই নিয়েই কিন্তু আছি। মাছি নিয়ে ভাবি কই । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মাছি প্রায় ৬৫ রকমের রোগ মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। স্ত্রী মাছি একেকবার শ’ খানেক ডিম পাড়তে পারে। পচনশীল খাদ্যাংশের ওপর বা বর্জ্য পদার্থে। মাছি পূর্ণতা প্রাপ্তির পর বড়জোর দুই থেকে চার সপ্তাহ বাঁচে। মশার মতো মাছি কিন্তু কামড়ায় না বা রক্তও খায় না। এর কোনো চোয়াল বা দাঁত নেই । খাদ্য দেখলে ওদের লালাযুক্ত উৎসেচক খাবারের ওপর উগরে দেয়। তরল ছাড়া কোনো খাদ্যই মাছি খেতে পারে না। লালা দিয়ে খাদ্য কিছুটা জারিত হয়ে তরলে পরিণত হলে ‘গলাধঃকরণ’ করে। প্রত্যক্ষভাবে এরা রোগ ছড়াতে পারে না । পরোক্ষভাবে নোংরা জায়গার রোগবীজকে যান্ত্রিকভাবে বহন করে এনে আমাদের খাদ্যে মিশিয়ে দেয়। খাদ্য বাহিত যেসব রোগে আমরা ভুগে থাকি তার প্রধান স্থপতি হল মাছি। এমনকী জীবাণুর টক্সিনকেও বহন করে নিয়ে যায়। মাছির দ্বারা কলেরা, টাইফয়েড, ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি, আমাশা, আন্ত্রিক এই নানান ধরনের ডায়রিয়া ঘটতে পারে।

স্যান্ডফ্লাই : 

তিন মিলিমিটার আকারের এই ছোট্ট মাছি ট্রপিকাল এবং টেম্পারেট দু’ রকম আবহাওয়াতেই থাকে। এরা রক্ত পান না করলে ডিম দিতে পারে না মশার মতোই। গাছের কোটরে, গুহায়, ফাটলে, বাথরুমে, বাড়ির ঝোপে অপেক্ষাকৃত স্যাঁতসেঁতে ও ঠান্ডা জায়গা এরা পছন্দ করে। পাখি, সরীসৃপ ছাড়াও অন্য স্তন্যপায়ী : প্রাণীর রক্ত এরা খায়। এরাই কালাজ্বরের রোগের প্যারাসাইট (লিসম্যানিয়া) রোগীর দেহ থেকে নিয়ে সুস্থ রোগীর দেহে সংক্রমণ ঘটায়। লিসম্যানিয়া প্রজাতি কালাজ্বর ছাড়াও চামড়ার নানান জটিল রোগ ও ঘায়ের কারণ। সুতরাং স্যান্ডফ্লাইও মারাত্মক সময়বিশেষে।

ফ্লি : 

মাছি নয়, এরা ডানাহীন জীব। ছোট। প্রাণীর লোমের মাঝে লুকিয়ে থাকে। দেহ চ্যাপ্টা। শক্ত আকড়া গুলা পায়ে প্রাণীর দেহে চেপে বসে থাকে আর খাদ্য হিসাবে রক্ত খায়। ফ্লি নিয়ে বর্তমানে অত চিন্তা নেই। ইঁদুরের গায়ে থাকা ফ্লির নাম জেনোপসিলা চিওপিস। আর প্লেগ রোগের জীবাণুর নাম পাস্টুরেলা পেস্টিস, এটি একটি ব্যাক্টেরিয়া। ইঁদুর আক্রান্ত হলে তার দেহ থেকে ফ্লি রক্ত খেয়ে সেই রক্তের মাধ্যমে রোগ সংক্রামিত হয় এবং বাহক হিসাবে মানুষকে কামড়ালে শত কোটি ব্যাক্টেরিয়া মানুষের দেহে প্রবেশ করে আর প্লেগ রোগের উদ্ভব হয়। মারাত্মক প্লেগের বহু গল্প ও কাহিনী আছে।

টিক, মাইট এরা ডানাহীন। আমাদের দেশে রোগ সৃষ্টিকারী কোনো জীবাণুর বাহক এরা হয় না। টাইফাস, রিকেটসিয়াল ফিভার, টিক প্যারালিসিস ইত্যাদি রোগ আমাদের দেশে নেই। ব্ল্যাক ফ্লাই স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহে থাকে ও রক্ত খায়। এদের মধ্যে সিমুলিয়া স্পিসিসের কথা আগে একবার উল্লেখ করেছি। অঙ্কোসারসিয়াসিস রোগের বাহক।

তাই বলছিলাম সাপকে দেখে তেড়ে মেড়ে যেমন ডান্ডা মারতে চান, এইসব ছোট ছোট পোকা, মাছি, মাকড়ের কথা তেমন করে ভাবেনই না। তাই তো ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এমন করে সর্বনাশ ডেকে আনছে। লাঠি নিয়ে আর সাপের পিছনে না দৌড়ে সবচেয়ে মারণ বীজ বহনকারী মশা শায়েস্তার কথা ভাবুন।

বাঁচার উপায়

একমাত্র আপনি সাবধানে থাকলেন, পাড়া সমাজ পড়ে রইল অজ্ঞতাতে, তাহলে কাজের কাজটি হবে না। আমি ভাবনার খেই ধরিয়ে দিলাম। ভাবুন সবাই মিলে, কার্যকরী করুন। 

  • মাথায় রাখুন, সামান্য, মশা-মাছি-কীট খেয়ে ভোগান্তি এবং মৃত্যুর কারণ সর্বোচ্চ। নিজেরা জানুন স্বাস্থ্যবিধি। ছড়িয়ে দিন সমগ্র পরিবারের সদস্যদের। নজর রাখুন পাড়ার প্রতিবেশীদের। জন জাগরণের পথে আপনাকে অংশীদার হতে হবে।
  • পরিকল্পনামাফিক বাড়িঘর তৈরি করতে হবে। এমনকী গাঁয়েগঞ্জের বাড়ি-ঘর নির্মাণেও । সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকবে। স্বচ্ছতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। জলাশয়, ময়লা ফেলার ভাগাড়, পচা এঁদো পুকুর-ডোবা যাতে মশা-মাছির ঘর না হয় তা দেখা দরকার । 
  • খাদ্য পানীয়র স্বাস্থ্যবিধি : ছোটবেলা থেকে স্বাস্থ্য বইয়ে কতরকম জ্ঞান দেওয়া হয়। হাত ধুয়ে খেতে বসা, খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা, টাটকা পরিষ্কার ফলমূল, শাকসবজির ব্যবহার। খাদ্য সংরক্ষণ করার নানান স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি নেওয়া দরকার। বিশেষ করে মাছি জাতীয় পতঙ্গ জল ও খাবারকে দুষিত, বিষাক্ত ও রোগের আস্তানা করে দিতে পারে। রান্নাঘর ও খাবার ঘরে স্বাস্থ্যবিধি আমাদের অনেক রোগ আটকে দেবে।
  • পোশাক-পরিচ্ছদ প্রয়োজন হলে ফুল হাতা জামা, হালকা রঙের জামা। দেখা গেছে হালকা রঙ মাশাকে বেশি আকর্ষণ করতে পারে না। স্যান্ডফ্লাইয়ের কামড় থেকে বাঁচতে পা-ঢাকা পোশাক পরলে কালাজ্বর থেকে রেহাই পেতে পারেন। এছাড়া আজকাল রাসায়নিক লাগানো .(পারমিথ্রিন) পরিচ্ছন্ন পোশাক বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায়। একবার তৈরি করা এমন পোশাক এমনকী সত্তরবার ধোলাই করলেও কার্যকারিতা বজায় থাকে।
  • বাড়ির ভিতর ও বাহিরে দাওয়াই স্প্রে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত মশানাশক রাসায়নিক স্প্রে করা হয়। এক কালে ডিডিটি স্প্রে দারুণ সুফল দিয়েছে। মাঝে নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে এর ব্যবহার সাময়িক বন্ধ থাকলেও এখন নিয়ম মেনে স্প্রে করা চলছে।  তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাইরেথ্রয়েড রাসায়নিক পদার্থ এখন প্রচলিত।
  • গোয়াল ঘর, টয়লেট, আশপাশের গুমটি, ছোট্ট গুদাম ঘরেও স্প্রে করা জরুরি। বাড়ির ভিতর নানারককম মশা মাছি বিতাড়িত করতে কয়েল বা কাগজ বা রাসায়নিক ব্যবহার করা যেতে পারে। বহুল ব্যবহারে সামান্য মতভেদ থাকলেও স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিনিয়ম মেনে তৈরি করা জিনিস নির্ভাবনায় ব্যবহার করবেন। রিপিলেন্ট এয়ারোসোল ব্যবহার করলে গায়ের পোকা মারা পড়ে।
  • মশা, মাছি, লার্ভা জন্মানোর জলাশয়ে যাতে এসব না জন্মাতে পারে তার জন্য স্প্রে ছাড়াও লার্ভা খেয়ে ফেলে এমন মাছ চাষ করা যেতে পারে। কিছু শেওলা জাতীয় গাছ জলের ওপর জালের মতো আবরণ তৈরি করে লার্ভাকে ভাসতে ও অক্সিজেন নিতে দেয় না।
  • মশার বংশ ধ্বংস করতে নানান রকম জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং চলছে যাতে মশার প্রজনন ক্ষমতা চলে যায় ।
  • মশারি, জানালা বা দরজায় জাল ব্যবহার করতেই হবে যেখানে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু খুব চলছে। কেমিক্যাল লাগানো নেটও পাওয়া যায় এবং নিরাপদ।

কবে কবি ঈশ্বরগুপ্ত আমাদের সতর্ক করেছেন। দুশো বছরেও আমাদের বোধোদয় হল না। তাই সূর্যাস্তের সাথে পোঁ পোঁ সুরে আজও মশা গান করে আর মাছি বাজনা বাজায়। কবি কেশনগর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আর আজ আমরা ওই ডানাযুক্ত সন্ধিপদী ষট্‌পদীর মোকাবিলায় না নামলে কেশনগর নয়, বিশ্বটাই ছাড়তে হবে অকালে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version