Home স্বাস্থ্য পরামর্শ কিভাবে এড়াবেন আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক- জেনে রাখুন বিশদে | Prevent Sudden Heart...

কিভাবে এড়াবেন আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক- জেনে রাখুন বিশদে | Prevent Sudden Heart Attack | 2024

আর পাঁচটা দিনের মতোই অফিসে যাওয়ার আগে সকাল বেলা বাজার করে ফিরলেন তাপস বাবু। হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসলেন। সকালের খাবার খেয়ে অফিসে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হবেন।  কিন্তু হটাৎ সেখানেই এলিয়ে পড়লেন। এসব ক্ষেত্রে রোগীকে মৃত ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না ডাক্তারবাবুদের কাছে। আসলে ঐ ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাকের তোড়জোড় চলছিল আগে থেকেই, কিন্তু তার কোনো বহির্লক্ষণ ছিল না। তাই কেউ কিছু বোঝার আগেই ঊনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। অসুখটা তাহলে কী ? হ্যাঁ, হার্ট অ্যাটাক। এধরনের হার্ট অ্যাটাকই সবথেকে বিপজ্জনক। নাম— সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক।

সাধারণত যে সব ব্যক্তি ডায়াবেটিসে ভুগছেন মূলত তাঁরাই সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়েন। হার্ট অ্যাটাক হলে যে সমস্ত ধমনীগুলো হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ করছে তাদের একটির বা কখনও একাধিকের গতিপথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বুকে ব্যথা হয়। কিন্তু যাঁরা ডায়াবেটিসে ভোগেন তাঁরা বুকে ব্যথা অনুভব করেন না। আসলে হৃৎপিণ্ড থেকে যে সমস্ত স্নায়ুগুলো মস্তিষ্কে যাচ্ছে সেই সমস্ত স্নায়ুগুলো ডায়াবেটিসের ফলে অকেজো হয়ে যায়। ফলে রোগী বুকে কোনোও বাথা অনুভব করেন না। তাই কখন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে যে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে তা জানা যায় না।

আর একধরনের হার্ট অ্যাটাক আছে। নাম—ওভার্ট হার্ট অ্যাটাক। ক্ল্যাসিক্যাল হার্ট অ্যাটাক যার ডাক্তারি নাম। সাধারণভাবে হার্ট অ্যাটাক বলতে আমরা যা বুঝি সেই ধরনের হার্ট অ্যাটাক। এই ধরনের অ্যাটাক অবশ্য সবাইকে জানান দিয়েই হয়। বুকের ঠিক মাঝখানে একটা চাপ ধরা ব্যথা। মনে হয় যেন কেউ পাথর বসিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ঘাম, কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট হলেই ধরে নিতে হবে একটা ক্ল্যাসিক্যাল হার্ট অ্যাটাক হল। এই ধরনের অ্যাটাকে অনেকে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। লক্ষণ স্পষ্ট থাকায় এই ধরনের হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে আগে থেকে সতর্ক থাকা যায়।

হার্ট অ্যাটাক আসলে কী?

সাধারণভাবে হার্ট অ্যাটিক বলতে বোঝায় হৃৎপিণ্ডের রক্তচলাচল কোনো কারণে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা হয় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন। হঠাৎ হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে যদি হৃৎপিণ্ডের কোষসমষ্টির মৃত্যু হয় তখনই তাকে হার্ট অ্যাটাক বলা চলে।

হৃৎপিণ্ডে রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে গেলে হৃৎপিণ্ডে অবস্থিত তিনটি ধমনী দিয়েই যে একসঙ্গে রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যাবে এমন নয়। সাধারণত একবার অ্যাটাকের পর একটি ধমনী দিয়ে রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শরীরের বা হৃৎপিণ্ডের বিশেষ কোনো অংশে রক্ত পৌঁছয় না। আর এভাবেই হয় হার্ট অ্যাটাক।

কিভাবে বুঝবেন হার্ট অ্যাটাক না অন্বলের ব্যথা?

অনেক সময়ই একটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় যে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে না অম্বলের ব্যথা—তা বুঝব কী করে। হজমের গোলমালের জন্য অনেক সময় বুকে ব্যথা হয় এবং তা হজমের ওষুধ খেলে কমেও যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতাই থাকে যাবতীয় বুকের ব্যথাকে অম্বলের ব্যথা হিসেবে চালানোর। সাধ করে কে-ই বা আর নিজেই হার্ট অ্যাটাকের কথা আগাম ভাবতে চায়। ফলে হয় কি হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা হলেও অনেকে লাগাতার হজমের ওষুধ খান। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের মতো বুকে পাথর চাপা অসহ্য ব্যথা কিন্তু অম্বলের ক্ষেত্রে কখনোই থাকে না। আর অম্বলের ব্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কখনোই ঘেমে যান না। হার্ট অ্যাটাকের ব্যথায় ধাম হবেই। ঠিক সময়ে রোগ ধরতে পারলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।

হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কাদের বেশি ?

যাঁদের হার্টের অসুখ থাকে, যাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, যাঁদের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, যাঁদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি বা যাঁদের পরিবারে বিশেষ করে ভাই-বোনের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে, তাঁদের সবারই হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। যাঁরা অতিরিক্ত ধূমপান করেন, যাঁরা সবসময় বসে বসে কাজ করেন একটুও ব্যায়াম করেন না তাঁদেরও হার্ট অ্যাটাক হবার সম্ভাবনা আছে। একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে মোটা মানুষদের হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বেশি আর রোগাদের কম— না, এমন ধারণার কিন্তু কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে সেন্ট্রাল ওবিসিটি অর্থাৎ বাঙালিদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট নেয়াপাতি ভুঁড়ির কারণে কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে। বলা যেতে পারে ভুঁড়ির সাথে হৃৎপিণ্ডের যোগাযোগ গভীর।

কাদের সম্ভাবনা বেশি-পুরুষ না মহিলা?

সাধারণভাবে দেখা যায়, মহিলাদের থেকে পুরুষদের হার্ট অ্যাটাক হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ৪৫ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং মহিলাদের হার্ট অ্যাটাক হবার অনুপাত ৪:১। অর্থাৎ প্রতি চারজন পুরুষের হার্ট অ্যাটাক হলে মহিলাদের ক্ষেত্রে হয় একজনের। ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক মহিলাদের দেহে ইস্ট্রোজেন নামক একটি বিশেষ হরমোনের প্রভাবে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেকটা কমে

যায়। এই হরমোন হলৎপিণ্ডকে হার্ট অ্যাটাকের বিরুদ্ধে একটা বিশেষ ধরণের রক্ষা কবচ দেয়। তাই এই বয়সের মেয়েদের হার্ট অ্যাটাক হবার সম্ভাবনা অনেক কম তবে ৪৫ বছরের পর পুরুষ এবং মহিলা হার্ট অ্যাটাক হবার সম্ভাবনা উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রায় সমান সমান।

শিশুদের বা আরো ভালো করে বলতে গেলে ২৫ বছর পর্যন্ত ব্যক্তিদের হার্ট অ্যাটাক সাধারণত হয় না। শিশুদের হৃৎপিণ্ডে বিভিন্ন জন্মগত রোগ থাকতে পারে, কিন্তু কখনোই তাদের হার্ট অ্যাটাক হয় না। হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কোলেস্টেরলকে। কোলেস্টেরল ধমনীতে জমে গিয়ে রক্তক্ষবাহের পথ সরু করে দিতে দিতে কসময় তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ২৫ বছর পর্যন্ত ধমনী তরতাজা থাকে তাই কোলেস্টেরল জমা হতে পারে না। শিশু এবং তরুণদের চর্বি জাতীয় খাদ্য হজম করার ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই তাঁদের সাধারণত হার্ট অ্যাটাক হয় না।

হার্ট অ্যাটাকে প্যারালিসিসের আশঙ্কা থাকে?

হার্ট অ্যাটাকে সাধারণত কোনো রোগীর প্যারালিসিস হতে দেখা যায় না। প্যারালিসিস সাধারণত হয় ব্রেন স্ট্রোকে। তবে হার্ট অ্যাটাক খুব বড় ধরনের হলে প্যারালিসিস হতেও পারে। সে-সম্ভাবনা প্রতি ৩০ জনে একজনের। অ্যাটাকের পর যদি খুব বড় ধরনের রক্তপিণ্ড হৃৎপিণ্ডে থাকে তাহলে প্রতি ৩০ জনে একজনের ক্ষেত্রে সেই রক্তপিণ্ডটা ছিটকে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং তখন রোগীর প্যারালিসিস হয়। বাকি ২৯ জনের ক্ষেত্রে কিন্তু ঐ রক্তপিণ্ড হৃৎপিণ্ডেই থেকে যায়। তাই তাদের ক্ষেত্র প্যারালিসিস হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

কখন পেসমেকার প্রয়োজন?

অনেকেরই ধারণা, হার্ট অ্যাটাক হলেই বোধহয় পেসমেকার বসাতে হয়। না, এরকম কোনো বাধ্যতা নেই। হার্ট অ্যাটাকে যদি হৃৎপিণ্ডের নিজস্ব পেসমেকার নষ্ট হয়ে যায়, একমাত্র তাহলেই লাগে কুত্রিম পেসমেকার। এরকম সম্ভাবনা প্রতি ২৫০ জনে মাত্র একজনের। আসলে পেসমেকার বসানোর প্রয়োজন হয় সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আমাদের হৃৎপিও অনেকটা আমাদের বাড়ির মতো। বাড়িতে যেমন অনেক ঘর থাকে ঠিক তেমনি হৃৎপিণ্ডে থাকে চারটি প্রকোষ্ঠ। আবার বাড়িতে যেমন এক ঘর থেকে আর একঘরে যাবার দরজা থাকে ঠিক তেমনি হৃৎপিণ্ডের এক প্রকোষ্ঠ থেকে আরেক প্রকোষ্ঠে যাবার জন্য থাকে ভাল্ভ। হৃৎপিণ্ডের ঐ ভাল্ভ নষ্ট হয়ে গেলে, ছিড়ে গেলে বা কুঁচকে গেলে সারানোর জন্য আছে নির্দিষ্ট চিকিৎসা। বাড়িতে যেমন জল সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে ঠিক তেমনি

হৃৎপিণ্ডে থাকে রক্ত সরবরাহের ব্যবস্থা। যা বিঘ্নিত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। আর বাড়ির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার মতোই হৃৎপিণ্ডেরও একটা নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা থাকে। এই বিদ্যুৎ সরবরাহ, হয় হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক পেসমেকারের সাহায্যে। সেটাই কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে প্রয়োজন হয় কৃত্রিম পেসমেকারের। এই কৃত্রিম পেসমেকার ডানদিকের কলার বোনের তলায় বসিয়ে একটা তার

হৃৎপিণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই তারের মাধ্যমেই কৃত্রিম বিদ্যুৎ সরবরাহ করে হৃৎপিণ্ডের কাজ স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করা হয়ে থাকে।

heart attack 1024x512 1

হার্ট অ্যাটাকের সাবধানতার সংকেত 

সম্ভাব্য হার্ট অ্যাটাকের সংকেত কিন্তু আগেভাগেই মেলে। সেই সংকেত যদি সঠিকভাবে বুঝে ওঠা যায়, তাহলে বড় বিপদের হাত থেকে সহজেই বাঁচা যায়। প্রথম প্রথম অনেকক্ষণ হাঁটাচলা করলে বা কোনো ভারি কাজ করলে বুকের মাঝখানে হঠাৎ একটা ব্যথা হতে শুরু করে, তার সাথে শুরু হয় ঘাম। কিছুক্ষণ বাদে এই ব্যাথা এমনিতেই কমে যায়। ধীরে ধীরে ধমনীগুলোর দেওয়ালে কোলেস্টেরল জমা হয়ে যত পুরু হতে থাকে ততই ঘন ঘন এই ব্যথা ফিরে আসতে থাকে। অল্প ইঁটাচলা করলে, বেশিক্ষণ কথা বললে, এমনকী বাথরুমে স্নান করলেও বুকের মাঝখানে ব্যথা শুরু হয় এবং ঘাম হতে থাকে। এইভাবে চলতে চলতে এক সময় দেখা যায় বসে থাকলেও বুকে ব্যথা হচ্ছে। এমন রোগীকে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে বা কোনো কার্ডিওলজিস্ট এর কাছে নিয়ে যেতে হবে। কারণ এটাই হার্ট অ্যাটাকের ঠিক আগের অবস্থা। লক্ষণ দেখা দেবার পরেই যদি ডাক্তারবাবুর প্রামর্শ নেন তাহলে কিন্তু খুব সহজেই এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। মনে রাখবেন হার্ট অ্যাটাক অনেক সময় সারাদিন ধরে হয়।

হার্ট অ্যাটাকের আরো কিছু কারণ

অনেকে বলেন ঠাণ্ডায় অর্থাৎ শীতকালে নাকি বেশি হার্ট অ্যাটাক করে। কিন্তু এই ধারণা আমাদের দেশে অচল। সারাবছরই বলতে গেলে একই হারে এখানে হার্ট অ্যাটাক হতে দেখা যায়। তবে পশ্চিমের দেশগুলোতে যেখানে খুব ঠাণ্ডা পড়ে সেখানে শীতকালে বেশি হার্ট অ্যাটাক হতে দেখা যায়। 

হার্ট অ্যাটাক হলেই যে তার উচ্চ রক্তচাপ থাকবে, এমন ধারণা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। এদেশে শতকরা ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়। শতকরা ৫৫ জনের হার্ট অ্যাটাকের কারণ ডায়াবেটিস। 

টেনশনের সাথে হার্ট অ্যাটাকের কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই। কিন্তু টেশনের ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। ঘন ঘন সিগারেট খাবার প্রবণতা বাড়ে। ঠিকমতো ঘুম হয় না। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায় এবং এই সমস্ত কারণেই কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হয়। তাই মানসিক দুশ্চিন্তাকে হার্ট অ্যাটাকের পরোক্ষ কারণ বলা যায়।

হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা

আমাদের হৃৎপিণ্ডে তিনটি প্রধান ধমনী আছে। এই তিনটি ধমনীই যদি একসাথে ব্লক হয়ে যায় তাহলে টিপল বাইপাস সার্জারি করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যদি একটা ধমনী ব্লক হয়ে যায় তবে অনেক সময় রোগীকে কিছু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট করা হয়, যার ফলে শতকরা ৩০ ভাগ রোগীর হৃদপেশিগুলো সম্পূর্ণ নিজে থেকে দু তিন সপ্তাহে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং বাইপাস সার্জারি করার প্রয়োজন হয় না। তবে সুস্থ হয়ে যাবার পর তাঁকে সতর্কভাবে জীবনযাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে একবার অ্যাটাকের অর্থ হল জীবনের মেয়াদ কিছুটা কমে যাওয়া। তাই ডাক্তারবাবুর প্রামর্শমতো খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, নিয়মিত ওষুধ-পথ্য খেতে হবে এবং নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করতে হবে। এই নিয়ম মেনে চললে একবার হার্ট অ্যাটাকের পর বাইপাস সার্জারি ছাড়াও দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায়।

আমাদের হৃৎপিণ্ডের তিনটি ধমনীর মধ্যে প্রধান হল লেফট অ্যান্টিরিয়াল ডিসেন্ডিং আর্টারি। ওল্টটানো পিরামিডের মতো হৃৎপিণ্ডের সামনের দেওয়ালে রক্ত সরবরাহ করে এই ধর্মনীটি। এছাড়া পিছনের এবং নিচের দেওয়ালে রক্ত সরবরাহ করে আরো দুটি ধমনী। ঐ মূল ধমনীটিকে সংক্ষেপে বলা হয় এল-এ-ডি ধমনী। এই ধমনী যদি রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে কিন্তু হাৎপিণ্ডের স্বাভাবিক পাম্পিং ক্ষমতা শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমে যায়। এই অবস্থায় রোগীকে ফেলে রাখলে রোগী মারা যাবেন, বা বাঁচলেও দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দী হয়ে যাবেন। সঙ্গে থাকবে শ্বাসকষ্ট। এই অবস্থায় কিন্তু হার্টের বাইপাস সার্জারি করাই একমাত্র চিকিৎসা।

সাধারণভাবে যখন দেখা যায় যে রোগীর একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তখন ধরে নেওয়া হয় যে তার বাঁচার ক্ষমতা কমে গেল। এখন যদি রোগী সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্টে সুস্থ হয়ে যান তাহলে তাকে নিয়মিত দুটো পরীক্ষা করতে হবে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে রোগীর শোয়া অবস্থায় যে ই-সি-জি করা হয় তার কোনো মূল্য বর্তমান চিকিৎসা জগতে নেই। এই ধরণের ই-সি-জি তে কেবলমাত্র আগেকার হ্যার্টের ই-সি-জি করা থাকলে তার সাথে তুলনা করা যায় মাত্র। তাই রোগীকে ছ’মাস অন্তর অন্তর ট্রেসটেস্ট এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফি করাতে হবে ইকোকার্ডিওগ্রাফির সাহায্যে শব্দতরঙ্গের অভিক্ষেপণের মাধ্যমে হৃৎশিণ্ডের একটা ছবি ধরা পড়ে। এর সাহায্যে বোঝা যায় যে সামগ্রিকভাবে হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং ক্ষমতা কেমন আছে এবং যে দেওয়ালটা নষ্ট হয়ে গেছে তার পাম্পিং ক্ষমতা কেমন। এছাড়া ট্রেস টেস্ট বা দৌড়ে ই-সি-জি বা এক্সারসাইজ টলারেন্ট টেস্টের মাধ্যমে দেখা হয় যে অসুস্থ হৃৎপিণ্ড কতটা পরিশ্রম সহ্য করতে পারছে। যদি দেখা যায় যে হৃৎপিণ্ডের জখম-জায়গা সারছে না বা অবস্থা আরো ঘোরালো হচ্ছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে রোগীর অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করে দেখতে হবে যে রোগীর বাইপাস সার্জারি করতে হবে কি না। যদি এর উত্তর হয় হ্যাঁ, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বাইপাস সার্জারি করতে হবে।

এছাড়া অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা হয় যদি দেখা যায় রোগী হার্ট অ্যাটাকের পর সুস্থুই ছিলেন, কিন্তু হাঁটাচলা করলে বা সিঁড়ি ভাঙলে বুকে লাগছে এবং ব্যথা হচ্ছে। অ্যাঞ্জিওগ্রাফি পরীক্ষাটি হল করোনারি অ্যাঞ্জিও গ্রাফ বা করোনারি ব্লাড ভেসেলকে দেখা। প্রথম প্রথম এই পরীক্ষায় জীবনের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে সেই আশঙ্কা দূর হয়েছে। তবে এই পরীক্ষা বেশ খরচসাপেক্ষ। এবং পরীক্ষার জন্য একদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। সরকারি হাসপাতালে এর খরচ তিন থেকে চার হাজার টাকা হলেও বেসরকারি হাসপাতালে খরচ ১২,০০০ থেকে ৩৫,০০০ টাকা। 

হার্টের চিকিৎসার মূল সমস্যা খরচ হলেও বর্তমানে এই চিকিৎসার খরচ বেশ খানিকটা কমে গেছে। আগে বুকের মাঝখানে বেশ কিছুটা জায়গা কেটে হৃৎপিণ্ডাক থামিয়ে কৃত্রিম হার্ট লাং মেশিন দিয়ে হৃৎপিণ্ডের কাজ চালু রাখা হত। এর ফলে অস্ত্রোপচারের খরচ পড়ত দু’ তিন লক্ষ টাকা। কিন্তু গত দু’-তিন বছরে বাইপাস সার্জারিতে কার্যত বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন শতকরা ৮০ ভাগ লোকেরই মিনি বাইপাস সার্জারিতেই কাজ হয়ে যাচ্ছে এই ধরনের অস্ত্রোপচারে হৃৎপিণ্ডকে থামানোর কোনো প্রয়োজন নেই। হৃৎপিণ্ডের যে জায়গাটায় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন সেখানকার এক বর্গ ইঞ্চি জায়গা স্থির করে নিয়ে তারপর অস্ত্রোপচার করা হয়। আগে এই ধরনের অস্ত্রোপচারে পাঁচ থেকে ছ-বোতল রক্ত লাগত। এখন প্রায় একদমই রক্ত লাগে না বা লাগলেও তা দু’-এক বোতলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই ধরনের বাইপাস সার্জারির দুটো সুবিধা আছে। প্রথমত অস্ত্রোপচারের জন্য সামান্য জায়গা কাটতে হওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর ব্যথা কম হয় এবং রোগী এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। কৃত্রিম ভাবে হৃৎপিণ্ড চালাবার মেশিন না লাগায় প্রায় ৫০,০০০ টকা খরচ বেঁচে যায়। তাই ৮০/৮৫ হাজার টাকাতেই এখন বাইপাস সার্জারি করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া মিনি বাইপাস সার্জারিতে যেমন খরচ কম, তেমন নিরাপদ।

সার্জারির পরবর্তী সতর্কতা।

বাইপাস সার্জারির পর অনেকে মনে করেন আর কোনো বিধিনিষেধ মানার প্রয়োজন নেই। এটা কিন্তু মারাত্মক হতে পারে। মনে রাখবেন, হার্ট অ্যাটাক কখনোই পুরোপুরি রোধ করা যায় না। কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই যত্ন না নিলে শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে আবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তাই অস্ত্রোপচারের পর রোগীর সুগার থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এছাড়াও অস্ত্রেপচারের পর নিয়মিত ডাক্তারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। কার্ডিয়াক কেয়ার হার্ট রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে, যারা বাইপাস সার্জারির পর নিয়মিত ডাক্তারবাবুর কাছে যান তাঁদের শতকরা পাঁচ জনের এবং যাঁরা যাননি তাঁদের মধ্যে শতকরা ৬৫ জনের আবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

তাই বাইপাস সার্জারির পর নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। নিয়ন্ত্রিত করতে হবে ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার কোলেস্টেরল। যদি ডায়েটিংয়ে নিয়ন্ত্রিত না হয় তবে কোলেস্টেরল কমাবার ওষুধ এবং একই সাথে সারাজীবন দিনে একটা করে অ্যাসপিরিন খেয়ে যেতে হবে। ধূমপান সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। বছরে একবার হার্টের পরীক্ষা করাতে হবে। এর সঙ্গে থাকবে নিয়মিত ব্যায়াম। সবথেকে ভালো, দিনে একঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা। হাঁটতে সমস্যা থাকলে বাড়িতে যোগ ব্যায়াম করতে হবে। শীর্ষাসন বাদে সমস্ত ধরনের যোগ ব্যায়ামই করা যাবে।

হার্ট অ্যাটাক এড়ানো সম্ভব?

চিকিৎসার থেকে ভালো হার্ট অ্যাটাক এড়ানো। বিধিনিষেধগুলো যদি মেনে চলা যায় তাহলে সম্পূর্ণ না হলেও হার্ট অ্যাটাক অনেকটাই এড়ানো যেতে পারে। যে সমস্ত খাদ্য, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ায় ২৫ বছর বয়সের পর থেকেই সেই সমস্ত খাদ্যে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। তাই যাদের হার্টের রোগ আছে তাঁরা ঘি, মাখন, চর্বিওয়ালা পাঁঠার মাংস, চীজ, ডিম, ক্ষীর, ক্রিম, ঘন দুধ, পায়েস, রাবড়ি একদমই বর্জন করবেন। সাধারণ মানুষ এই সমস্ত খাবার খাবেন, তবে অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে। ব্রয়লার মুরগি না খাওয়াই ভালো, কারণ এতেও যথেষ্ট চর্বি থাকে। দেশি মুরগির মাংস খেলে চর্নি এড়ানো যায়। মাছ, সবরকমই খাওয়া যেতে পারে তবে চর্বি জাতীয় মাছ খাওয়ার পরিমাণ কমান। মাছের তেল না খাওয়াই ভালো, তবে সামুদ্রিক মাছের তেল খেতে পারেন। সামুদ্রিক মাছের তেল রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়। 

অনেকেরই প্রশ্ন, সরষের তেল হার্টের অসুখের পক্ষে ক্ষতিকর কি না। সরষের তেল হার্টের অসুখ হলেও খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু খুবই পরিমিত পরিমাণে। সব থেকে ভালো হয় বিভিন্ন ধরনের তেল মিশিয়ে মিশিয়ে খেলে। হয়তো সরষের তেল দিয়ে একটা পদ রাঁধলেন, আবার একটা পদ রাধালেন সয়া তেলে তৃতীয় পদটি আপনি রাঁধতে পারে সানফ্লাওয়ার তেল দিয়ে। স্যালাড খাওয়ার সময় স্যালাডের সঙ্গে কিছুটা পরিমাণে অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। অলিভ অয়েল রক্তে চর্বি বা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।

সাবধানতার শুরু যৌবনেই

যাঁদের বংশে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা আছে তাঁদের সাবধান হতে হবে যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই। খাদ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আমেরিকায় এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে র্যাদের হার্ট অ্যাটাক হতে পারত তাঁর বিধিনিষেধ মেনে চলে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে বিপদ-মুক্ত থাকতে পেরেছেন। এই পদ্ধতিতে হার্ট অ্যাটাক নিয়ন্ত্রণ করাকে হাইরিস্ক রোগীদের প্রাইমারি প্রিভেনশন ট্রায়াল বলে। বাকি শতকরা ৪০ জন রোগীর হার্ট অ্যাটাক হলেও তাঁরা অল্পেতেই রক্ষা পান। তাই প্রাইমারি প্রিভেনশন ট্রায়াল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলে কী করবেন

বাড়ির কারোর হঠাৎ, হার্ট অ্যাটাক হলেই প্রাথমিক কর্তব্য হল তা আদৌ হার্ট অ্যাটাক কি না তা নির্ণয় করা। অর্থাৎ রোগীর বুকে ব্যথার সাথে সাথে ঘাম হচ্ছে কি না তা দেখা। ঘাম হলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে, বাড়িতে যদি না থেকে থাকে তাহলে যেখান থেকে পারেন একটা অ্যাসপিরিন কিনে এনে রোগীকে জল দিয়ে খাওয়াতে হবে। তবে রোগী যদি আলসারে ভোগেন তাহলে এটা করা যাবে না। যাঁদের বাড়িতে হার্টের অসুখে ভুগছেন এমন রোগী আছেন তাঁদের সবসময় উচিত একটি ডায়রিতে যে সমস্ত হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট আছে তাদের নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লিখে রাখা। রোগীর হার্ট অ্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে ঐ সমস্ত হাসপাতালে ফোন করে খবর নিতে হবে কোথায় জায়গা ফাঁকা আছে এবং ঐ জায়গায় আপনি রোগী নিয়ে যাচ্ছেন তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানান। এছাড়া যাঁদের বাড়িতে হার্টের অসুখের প্রবণতা আছে তাঁদের বাড়ির একজন বা দুজনে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন (সি আর পি) টেনিং অবশ্যই নেওয়া উচিত। না হলে অজ্ঞ লোক হার্ট ম্যাসাজ করতে গেলে বিপদ ডেকে আনতে পারে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version