Home মানসিক স্বাস্থ্য দীপিকা পাড়ুকোনও এই অদ্ভুত রোগের শিকার । OCD ( Obsessive Compulsive Disorder...

দীপিকা পাড়ুকোনও এই অদ্ভুত রোগের শিকার । OCD ( Obsessive Compulsive Disorder )

মানুষ মনে করেন, মনোচিকিৎসকের কাছে কেবল তারাই যান যাদের মাথাটা ‘একেবারে গেছে’। এই ভাবনাটা শুধু যে ভুল তা নয়, রীতিমতো ক্ষতিকর। এর ফলে যারা প্রতিদিনের .কাজকর্ম করে যান ঠিকই, কিন্তু মনে মনে নানা কারণে টেনশনে ভোগেন, বেশি খুঁতখুত করার জন্য অন্যদের কাছে বকুনি খান, কিংবা সারাদিনের কাজে কোনো উৎসাহ বা ভালোলাগার খোঁজ পান না, তারা আর সাহস করে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না। ভাবেন, গেলে যদি আমায় সবাই পাগল ভাবে ! এইভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায়, জীবনকে সেইভাবে উপভোগ করা আর হয়ে ওঠে না। ব্যর্থতার বোঝা বাড়তেই থাকে।

আবার উল্টো দিকে যারা একটু সচেতন, সাহস করে ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়েই পড়লেন হয়তো একদিন তাদের নিয়ে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের মাথাব্যথার শেষ নেই। দশদিক থেকে উড়ে আসে বাক্যবাণ, কেন তুমি চিকিৎসা করাবে, এইসব হাবিজাবি ওষুধ খেলে জানো ‘নার্ভের’ কী ভয়ানক ক্ষতি হয়?” এবং সর্বোপরি, ‘তোমার মনের জোর নেই’? ভাবখানা এমন যেন মনে জোর না থাকা, অবসাদ বা উৎকণ্ঠায় ভোগা একটা দারুণ দুর্বলতার লক্ষণ। এবং দুর্বল মানুষেরা, কে না জানে, সমাজে ‘ভীষণভাবে ব্রাত্য। সে প্রাচীন গ্রীসে স্পার্টা নগরীর সময় থেকে এই মাত্র কয়েক দশক আগে অ্যাডল্‌ফ হিটলারের আমলেও দুর্বল মনের মানুষদের জন্য আমাদের হৃদয়ে বা সমাজে — কোথাও যেন ঠাঁই নেই । অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব বলছে, মানসিক চিকিৎসা করালে যারা উপকার পাবেন তাদের ৬০ শতাংশ কিন্তু এইসব ‘ছোটখাটো’ ‘উপেক্ষণীয় নিউরোটিক ডিসঅর্ডারে ভোগেন। চলচ্চিত্রে বা রোমহর্ষক উপন্যাসে যেসব বিপজ্জনক, বাস্তববিচ্ছিন্ন উন্মাদদের দেখতে পাই তারা, সংখ্যায় নগণ্য।

এইরকমই একটা ‘ছোটখাটো’ অসুখের নাম ‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’ বা সংক্ষেপে OCD। এই সমস্যাটা যাদের আছে তাদের কেউ ‘পাগল’ অন্তত বলবে না। বরং তাদের সুনাম হবে তাদের ঝকঝকে পরিষ্কার বাড়ির জন্য, অতি সাবধানী ব্যবহারের জন্য এবং কাজেকর্মে কোনোরকম ভুলভ্রান্তি, নড়চড় সহ্য করতে না পারার জন্য।

তবে গন্ডগোল একটা তাদের থাকেই এবং সেটা প্রধানত বুঝতে পারেন বাড়ির লোকেরা। কাজের লোক চলে গেলেও ওরা আর একবার ঘর পরিষ্কার করবেনই। কাপড় কাচা, বাসন মাজার মতো প্রাত্যহিক কাজগুলো বারবার করতে থাকেন। কেউ কেউ আবার লোক রাখেন না স্রেফ এই কারণে যে তাদের দায়সারা কাজ ওদের পছন্দই হয় না। প্রথম প্রথম এইসব কাজ নিজেই করে নিতে পারতেন হয়তো, কিন্তু সময় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিবারের লোকেদের ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। কারণ তারা পরিচ্ছন্নতার দাবি মেনে যতবার বাইরে যান ততবার হাত-পা মোটেই ধোন না, ছোট বাচ্চারা লাফিয়ে বিছানায় ওঠে—চাদরে তাদের ছোট ছোট পায়ের ছাপ পড়ে। মেঝেতে সামান্য কাগজের টুকরো পড়লেও তক্ষুণি সেটা তুলে ফেলে দেয় না কেউ। আর তাদের এই হৃদয়হীন ব্যবহারে, যার, ‘ও.সি.ডি’ আছে তিনি ভীষণ দুঃখ পান, অথবা রেগে চটে একসা হন। এই অবস্থাটা বাড়তে বাড়তে একটা সময় আসে যখন সারাটা দিনই কেটে যায় ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, গ্যাস ধোওয়া, টেবিল মোছা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কাজ সারতে। রান্না শেষ হতে হতে হয়তো বেলা তিনটে। এর মধ্যে আবার বাড়িতে যদি কোনো বাইরের লোকের আগমন হয় তাহলে তো সর্বনাশ। আবার গোড়া থেকে তার পায়ে চলা রাস্তাটুকু পরিষ্কার করা, ছেলেমেয়ে বাড়ি ফিরলে তাদের জামা, জুতো, টাই, মোজা তখনই কেচে ফেলা—সব মিলিয়ে কাজের মহাযজ্ঞ চলে সবসময়। ক্রমে অতিথিরা অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েন। তারা ভুল বোঝেন, দুঃখ পান। সারাদিন কেবল চারপাশটা পরিষ্কার করতে করতে নিজের যত্নের জন্য আর সময় থাকে না। ও.সি.ডি যখন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায় তখন অনেক সময় দেখা যায় রোগীর দুই হাতের আঙুলে ইনফেকশন, ত্বক ও চুল অতিরিক্ত সাবান ব্যবহারের ফলে শুকনো ও রুক্ষ, শরীর ক্লিষ্ট, দুর্বল, মেজাজ সপ্তমে।

এই নোংরা বাতিকের একটা চূড়ান্ত উদাহরণ। দেখা যায় রজঃস্রাবের সময়। যা স্বাভাবিক, তাকে নোংরা ভাবার একটা মনোভাব তো এমনিতেই ছোটবেলা থেকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যার ‘ও.সি.ডি’ আছে, তার অবস্থা তখন সহজেই অনুমেয়। সমস্ত দিন কাটে বাধক্রমে, অতিরিক্ত ধোয়াধুয়ির ফলে হাত-পা সাদা হয়ে যায়। কেউ কেউ এমনকী আমাদের কাছে অনুরোধ করেন, ওষুধ বা অস্ত্রোপচার করে ঋতু বন্ধ করার উপায় বার করতে। সার্জারি বা অ্যানাস্থেশিয়ার ঝুঁকি তাদের কাছে তুচ্ছ তখন।

Obsessive Compulsive Disorder 02

Obsessive Compulsive Disorder (OCD) কী?

ও.সি.ডি-র উপসর্গ কেবল পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলি নিয়েই হবে এমন কিন্তু নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এটা প্রকাশ পায় মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে। ধরুন কিছু টাকা দিলেন কাউকে, তারপর শুরু হল মনের মধ্যে দ্বিধা —ঠিকঠাক দিলাম তো? সদর দরজা বন্ধ করতে ভুলে যাইনি তো? গ্যাসের চাবি ? হয়তো বাড়ি থেকে বেরোনোর এক ঘণ্টা বাদে মনে দ্বন্দ্ব দেখা দিল —যতই নিজেকে বোঝান মন মানে না। ক্রমশ অস্বস্তি বাড়তে থাকে – শেষমেশ আর একবার বাড়ি ফিরে যেতে হয়, দরজার তালা ঠিকমতো বন্ধ হয়েছে কি না তা দেখতে।

তো এই বারবার ধোওয়া বা ফিরে দেখার চত্তরে পড়ে কত যে সময় নষ্ট হয় তার ইয়ত্তা নেই। জীবন যে অমূল্য এবং পৃথিবীতে আমরা যে অনন্তকাল বাঁচতে আসিনি, এটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। সুতরাং ঘর পরিষ্কার, হাত-পা ধোওয়া বা সবকিছু কেবল গুছিয়ে রাখার মতো যান্ত্রিক কাজগুলো করতে গিয়ে আমরা যদি বেড়াতে যেতে, ভালো বই পড়তে, নতুন কিছু লিখতে বা আবিষ্কার করতে সময় না পাই, তাহলে তার চেয়ে আফশোসের বিষয় আর কী বা হতে পারে?

এতক্ষণ আমরা কেবল যেকোনো কাজ বারবার করা, বা কম্পালসিভ অ্যাক্টস-এর কথা আলোচনা করলাম। এবার বলব অবসেশন বা একই চিন্তা মনের মধ্যে বারবার আসার গল্প। ধরুন আপনি পড়ার টেবিলে বসে চুপচাপ নিজের কাজ করছেন, আপনার ছোট্ট নাতনি আপনমনে খেলছে আপনার কাছেই। তাকে আপনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন, সে আপনার নয়নমণি । হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আপনার মনে হল- “আচ্ছা, আমি যদি ওর গলা টিপে ধরি।’কী ভয়ঙ্কর চিন্তা। আপনি তো স্তম্ভিত। খানিকক্ষণ পর আবার সেই একই চিন্তা—’ওকে যদি মেরে ফেলি।’ ধরমে মরে গেলেন আপনি। কাউকে একথা বলাও যায় না, নিজের কাছ থেকে নিজেরই মনে হয় পালিয়ে যাই, মনে হয় আমার মতো পাষন্ড তো আর কেউ নেই। এতটাই বেড়ে ওঠে অপরাধবোধ যে এমনকী আত্মহত্যার কথাও মনে হয়।

এই যে অর্থহীন চিন্তা, যা আপনার চরিত্রের সঙ্গে হয়তো একেবারেই খাপ খায় না এরই নাম অবসেশন। যতই যুদ্ধ করুন, নিজের সঙ্গে, অবসেশন কমে তো না-ই, উল্টে আরও ঘাড়ে চেপে বসে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সংসারে যাকে আমরা সবচেয়ে ভালোবাসি, সচরাচর তার সম্বন্ধেই এই চিন্তাগুলি বেশি আসে। ভক্তপ্ৰাণ মানুষের মনে আসে ঈশ্বর সম্বন্ধে অসম্মানজনক ভাবনা, মায়ের আসে সন্তান সম্বন্ধে, স্বামীর সমস্যা স্ত্রীকে নিয়ে। কখনো বা আগ্রাসী বা ভায়োলেন্ট চিন্তা, কখনো যৌনগন্ধী বা সেক্সুয়াল চিন্তা, কখনো আবার আরও নানা ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনা ভীষণ কুণ্ঠিত, লজ্জিত ও অপরাধী করে তোলে মনে মনে।

OCD-র রোগীদের লক্ষণ কী?

হয়তো ভাবছেন—এগুলো আবার অসুখ নাকি? হ্যাঁ, এগুলো আসলে সব ‘ও.সি.ডি এর লক্ষণ। এবং ভয় নেই, ‘ও.সি.ডি’ সহজেই সারানো যায়। সারানোর প্রশ্নে আসার আগে একটু জেনে নেওয়া দরকার ‘ও.সি.ডি‘ কেন হয়। খুব সরল করে বলতে গেলে আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্নায়ুতন্ত্রে যখন সেরোটোনিন বলে একটি রাসায়নিকের অভাব ঘটে তখনই হয় এইসব কান্ড। অনেকসময় অসুখটি বংশগত, কিন্তু কখনো কখনো তা নাও হতে পারে।

তাহলে সেরোটোনিনের পরিমাণ বাড়ালেই তো অসুখ সেরে যাবে—তাইনা? কতকটা তাই- ই। সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SRI) নামে কিছু ওষুধ আমরা ‘ও.সি.ডি’-তে দিই। যদিও প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে তার ডোজ আলাদা। বিভিন্ন ধরনের এস.আর.আই-এর মধ্যে ঠিক কোনটি আপনার জন্য ঠিক তা বুঝঝতে পারবেন একজন দক্ষ চিকিৎসক। ধরুন রোগীর প্রেসার বেশি বা অন্য কোনো অসুখ আছে তাহলে এক একটি এস.আর.আই সেই রোগীর জন্য· বিপজ্জনক হতে পারে। কাজেই সেইসব তথ্য। চিকিৎসককে অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না। অনেকে বলেন, ‘আচ্ছা এমন কোনো খাবার- দাবার নেই যা খেলে সেরোটোনিনের ঘাটতি পুরণ করা যায়?’ দুর্ভাগ্যবশত না। আপাতত আমাদের হাতে এমন কোনো তথ্য নেই। তাই শুধু ওষুধেই এখনকার মতো ভরসা রাখতে হচ্ছে।

কতদিন ওষুধ খাবেন? সেটা নির্ভর করছে নানা বিষয়ের ওপর। কাজেই এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে নিজে নিজে ওষুধ বন্ধ করলে রোগ প্রায়ই ফিরে আসে।

ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? আছে, কিন্তু তা অনতিক্রম্য নয়। খোলা মনে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আলোচনা করুন। জেনে নিন কী কী বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে আপনাকে । দ্বিধা না করে সবরকম অসুবিধার কথা ওনাকে খুলে বলুন।

ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপি, সহজবোধ্য ভাষায় যাকে অনেকেই কাউন্সেলিং বলেন– তারও একটা বড় ভূমিকা আছে “ও.সি.ডি’ চিকিৎসায়। তবে কেবলমাত্র কাউন্সেলিং করে ও.সি.ডি’ সারিয়ে তোলা খুব মুশকিল। সঙ্গে ওষুধ লাগবে। এই ওষুধগুলো মোটের ওপর খুব একটা ক্ষতিকর নয়। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে চললে সন্তানের মা হওয়া বা স্বাভাবিক যৌনজীবনে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

পরিশেষে বলি, “ও.সি.ডি’-কে অবহেলা করবেন না। কারণ চিকিৎসার দেরিতে অসুখটি যখন ক্রনিক হয়ে যায় তখন কিন্তু তাকে বাগে আনা খুব কঠিন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হয়। এবং রিফ্র্যাক্টরি কেস অর্থাৎ কিছুতেই সারছে না এমন ক্ষেত্রে অনেকসময় মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের বিধান ও রয়েছে ডাক্তারি বইতে। তবে সে সব ঘটনা সচরাচর ঘটে না, আমরা ওষুধ দিয়েই ‘ও.সি.ডি’- কে বশ করে ফেলতে পারি।

তবে আর দেরি কেন, যদি বারবার অর্থহীন কোনো কথা মনের মধ্যে উকিঝুঁকি দিয়ে যায়, যদি পরিচ্ছন্নতাটা প্রায় বাতিকের পর্যায়ে পৌঁছয়, যদি একই জিনিস বারবার পরখ করতে গিয়ে বা একই পড়া পরীক্ষার আগের দিন বহুবার পড়ে যেতে হয় তাহলে সব দ্বিধা সরিয়ে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিন। যে অসুখ সেরে যায় তাকে কেন মিছিমিছি ভয় পাব?

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version