Home মানসিক স্বাস্থ্য পর্নোগ্রাফিতে কেন মানুষের এত আসক্তি? (Porn Addiction)

পর্নোগ্রাফিতে কেন মানুষের এত আসক্তি? (Porn Addiction)

পর্নোগ্রাফি হল যৌন সম্বন্ধীয় বিষয়বস্তু উপস্থাপন। এর উদ্দেশ্য হল মানুষের মনে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা, যা ব্যক্তিটিকে বৈধ কিংবা অবৈধ পন্থায় যৌন ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। পর্নোগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয় বা প্রচারিত হয়। যথা, পোস্টার, বিজ্ঞাপন (স্থির ও চলমান), বই, ম্যাগাজিন, ক্যালেন্ডার, ফটোগ্রাফ, ভাস্কর্য, ড্রইং, চিত্র, অ্যানিমেশন, অডিও ক্যাসেট, ভিডিও ক্যাসেট, সিনেমা, হাতে লেখা বা টাইপ করা- চিঠি ইত্যাদি। মানুষের কাম ও বাসনার কাছে আবেদন জানিয়ে পর্নোগ্রাফি চিন্তা ও ভাবনাকে প্রভাবিত করে। XXX এই চিহ্নটি পর্নো সম্বন্ধীয় বস্তু বা বিষয়কে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। পর্নোগ্রাফি যদিও কয়েকটি সাধারণ সূত্র অনুসরণ করে এবং সেই দিক থেকে সব দেশের পর্নোগ্রাফি মূলত একই ধাঁচের, তবে বর্তমান নিবন্ধে এই দেশের পটভূমিতে বিষয়টি আলোচনা করা হচ্ছে।

বেশ কিছুকাল আগে পর্নোগ্রাফি বই হিসাবে প্রকাশিত হত। অতি জঘন্য কাগজ। এবং ফটোও তেমনি। হলুদ সেলোফেন কাগজে মোড়া এবং পিন আপ করা এই সমস্ত বই ‘নিষিদ্ধ বই’ রূপে পরিচিত ছিল। এগুলো ‘বটতলার বই’-ও বলা হত। কিছু নির্দিষ্ট দোকানে গোপনে এইসব বইয়ের কেনাবেচা চলত। এর পরবর্তী পর্যায়ে পর্নোগ্রাফি বিষয়ক পুস্তক এল অপেক্ষাকৃত উন্নত রূপে। অর্থাৎ মোটামুটি ভালো কাগজে ছাপা এবং ছবি স্পষ্ট। ইতিমধ্যে পর্নোগ্রাফির পাঠক সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এরপর আরও উন্নতরূপে পর্নোপত্রিকা বাজারে এল। অতি উন্নত মানের কাগজ, চমৎকার ছাপা এবং ঝকঝকে রঙিন ছবি। এরই আরও উন্নত রূপ বর্তমান বাজারে খোলাখুলি বিক্রি হয়, কোনো লুকোচুরির ব্যাপার নেই। এ ধরনের বইতে থাকে মূলত নগ্ন নারীদেহের ছবি, নারী-পুরুষের সঙ্গমের দৃশ্য এবং কিছু বিকট যৌন ক্রিয়াকর্মের ছবি। গল্প বা কাহিনী হিসাবে যেগুলি থাকে সেগুলির আদৌ কোনো বিষয়বস্তু নেই। স্থুল আদিরসাত্মক অশ্লীল ভাষায় লেখা যা মূলত অবৈধ যৌনতা বিষয়ক।

একসময় অডিও ক্যাসেট পর্নোগ্রাফি হিসাবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যেখানে দেখানো হত অবৈধ যৌন ক্রিয়াকলাপের বিবরণ। বাংলাদেশের একটি চ্যানেল শুধুমাত্র এ জাতীয় পর্নোগ্রাফিই প্রচার করে। পরবর্তী পর্যায়ে এল ভিডিও ক্যাসেট। ক্যাসেটে নারী-পুরষের অবৈধ যৌনতার দৃশ্য খোলাখুলি ভাবে দেখানো হয়। অত্যন্ত কাছ থেকে নারী শরীরের বিভিন্ন অংশ, যৌনমিলনের বিভিন্ন দৃশ্য এমনভাবে সম্প্রচারিত হয় যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের মনে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা বহু ছবি সম্বন্ধেও অভিযোগ তোলা যায়। এদেশে এবং বিদেশের বহু চিত্রকরদের আঁকা ছবির মূল বিষয়বস্তু হল সম্পূর্ণ নগ্ন বা প্রায় নগ্ন নারীদেহ। এছাড়া ভাস্কর্যের মাধ্যমেও পর্নোগ্রাফির প্রকাশ ঘটে। বহু বিখ্যাত ভাস্কর্যবিদের সৃষ্টি যৌনতা বিষয়ক। উল্লেখ করা যেতে পারে খাজুরাহো ও কোনারক মন্দিরের দেওয়ালে যে অপূর্ব ভাস্কর্য রয়েছে এবং যা যুগ যুগ ধরে দর্শককে আকৃষ্ট ও দর্শনে বিমোহিত করে। এইসব ভাস্কর্যে একদম খোলাখুলি এবং শৈল্পিকভাবে দেখানো হয়েছে নারী পুরুষের বিভিন্ন ধরনের যৌন ক্রিয়াকলাপ। পুরাণের বেশ কিছু গ্রন্থে দেবদেবী ও মুনিঋষিদের নানান কান্ডকারখানার সরস বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে।

পর্নোগ্রাফিতে কী কী দেখানো হয় এমন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। বলা যেতে পারে যৌনতা এবং যৌনতা বিষয়ক যেকোনো বিষয় পর্নোগ্রাফিতে স্থান পায়। বর্তমানে পর্নোগ্রাফি মূলত ভিডিও মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়। এক্ষেত্রে দেখানো হয় বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নগ্ন নারীদেহ, বিভিন্ন ধরনের যৌন ক্রিয়াকলাপ, বিভিন্ন ভঙ্গীতে যৌনসঙ্গম, বিকৃত যৌনসঙ্গম ইত্যাদি। এছাড়াও থাকে কিছু বিকৃত যৌনাচার। যেমন পায়ুসঙ্গম, মুখমেহন, অজাচার (পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র, ভাই-বোন এদের মধ্যে যৌন ক্রিয়াকলাপ) । শিশুকাম (কোনো বয়স্কা নারী যখন খুব অল্পবয়সী পুরুষ-শিশুর সঙ্গে বা কোনো বয়স্ক পুরুষ কোনো শিশু-নারীর সঙ্গে যৌন `ক্রিয়াকলাপে রত) এবং সমকামিতা (দু’জন নারীর মধ্যে অথবা দু’জন পুরুষের মধ্যে যৌন সম্বন্ধ)। বাস্তবিক পক্ষে পর্নোগ্রাফিতে চলমান ছবির মাধ্যমে যা দেখানো হয় তা এত স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও জীবন্ত যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের মনকে উত্তেজিত করে তুলতে সক্ষম হয়। এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পর্নোগ্রাফিতে নারী পুরুষের যে সমস্ত সম্বন্ধের কথা বলা হয় আদৌ তাদের মধ্যে সেই সম্বন্ধ নেই। 

পর্নোগ্রাফি কারা দেখে এটিও একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন। উত্তর এভাবে দেওয়া যায় যে, বিভিন্ন বয়সের মানুষ পর্নোগ্রাফি দেখতে পছন্দ করে এবং অনেকে নিয়মিত দেখেন। অনেক মানুষ আছেন যারা মুখে পর্নোগ্রাফির নিন্দা করেন কিন্তু সুযোগ পেলে আদৌ দেখতে ছাড়েন না।

পর্নোগ্রাফির স্বপক্ষে কিছু যুক্তি উত্থাপন করা যায়। অর্থাৎ পর্নোগ্রাফির সবটাই খারাপ নয়, এর কিছু ভালো দিকও আছে। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে ব্যক্তি যৌনতা বিষয়ক জ্ঞান লাভ করে যা তার যৌনজীবনকে সমৃদ্ধ করে। বিভিন্ন ধরনের যৌন ক্রিয়াকলাপ ও যৌন সঙ্গমের বিভিন্ন ভঙ্গী সম্বন্ধে নারী ও পুরুষ অবহিত হতে পারে। যার ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে তারা অতিরিক্ত যৌনসুখ লাভ করতে পারে।

পুরুষ ও নারীদেহের বিশেষ কিছু অংশ অতি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর। এইসব অংশ সম্বন্ধে পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে কিছুটা অবহিত হওয়া যায়। এর ফলে নারী-পুরুষের যৌনজীবন আরও আনন্দদায়ক ও সুখকর হয়। প্রসঙ্গত,বহু নারী-পুরুষই এ ব্যাপারে অজ্ঞ।

বিবাহের কিছুকাল পরে যৌনজীবন অনেকটাই একঘেঁয়ে হয়ে যায়। এর ফলে যৌন অনিচ্ছা সৃষ্টি হতে পারে যা দাম্পত্য জীবনে অত্যন্ত কু-প্রভাব ফেলে। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গমের প্রক্রিয়া ও ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করে তাদের যৌন আগ্রহ ও যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং নিজেদের যৌন ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে তৃপ্তিলাভ করে।

বিবাহিত বিশেষত সদ্য বিবাহিত দম্পতি যদি কিছুক্ষণ পর্নোগ্রাফি দেখে তাহলে তাদের যৌন উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে এবং এই অবস্থায় যৌন ক্রিয়াকলাপ অনেক বেশি সুখকর হয়। অবিবাহিত অর্থাৎ যাদের কোনো বিশেষ কারণে বিবাহ করা সম্ভব হয়নি কিংবা অল্প বয়সে বিপত্নীক বা বিধবা অথবা ডিভোর্সি অর্থাৎ যারা স্বাভাবিক যৌনজীবন যাপন করতে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি কিছু পরিমাণে যৌনসুখ লাভে সহায়তা করে। এর ফলে তাদের মানস যৌনজীবন মোটামুটিভাবে সুস্থ থাকে এবং কোনো ব্যভিচার ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। এ কারণে পর্নোগ্রাফিকে ‘বিকল্প যৌনতা’ বলা যেতে পারে, যা বাস্তব নয়, আবার পুরোপুরি কাল্পনিক নয়।

যাদের যৌনজীবন প্রায় অস্তমিত, স্বাভাবিক যৌনকামনা প্রায় আসেই না, তারা অনেকেই ডাক্তারের কাছে যান এবং পরামর্শ মতো ‘ভায়াগ্রা’ জাতীয় ওষুধ সেবন করেন (যেসব ব্যক্তির হৃদযন্ত্রের গোলযোগ আছে তাদের ক্ষেত্রে ভায়াগ্রা নিষিদ্ধ ওষুধ)। এর পাশাপাশি যদি তারা পর্নোগ্রাফি দেখেন তাহলে তাদের যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং তারা যৌনমিলনে সমর্থ হয়।

অনেক নব দম্পতির ক্ষেত্রে উভয়ের কিংবা কোনো একজনের মধ্যে যদি যৌনকামনা স্তিমিত কিংবা অনুপস্থিত থাকে তাহলে স্বাভাবিক যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় না। এর ফলে তাদের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যৌনজীবন গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়। যার প্রভাব পড়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে। এরকম ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি যৌনচেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ধরনের সমস্যা নিয়ে যদি কোনো দম্পতি মনোচিকিৎসকের কাছে যান অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি তাদের একসঙ্গে বসে পর্নোগ্রাফি দেখার পরামর্শ দেন এবং তাতে আশ্চর্য রকমের সুফল ঘটে।

Recovery From Porn Addiction

পর্নোগ্রাফির বিপক্ষে যুক্তি

পর্নোগ্রাফি সত্য বা যথার্থ নয়, এ হল নিছকই মিথ্যা, অভিনয় মাত্র। বাস্তবের সঙ্গে একে মেলাতে গেলে বিভ্রান্ত হতে হবে। পর্নোগ্রাফি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক মিথ্যা রঙিন কল্পনার জাল বুনে দর্শককে বিভ্রান্ত করে।

  • বর্তমান যুগ হল দূর-সংযোগের যুগ। নেট সংযোগ যুগান্তর ঘটিয়েছে। এখন ছোট ছোট শিশুদের হাতে পর্যন্ত মোবাইল, কারো বাড়িতে নিজস্ব কম্পিউটার বা ল্যাপটপ। নেট সংযোগের সহায়তায় একটি শিশু তার মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখতে পারে। শিশুমনে এর অভিঘাত হয় মারাত্মক। বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া একাধিকবার পর্নোগ্রাফি দেখলে এর প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা অতি প্রবল।
  • মোবাইল ছাড়া তরুণ ও কিশোরদের ভাবাই যায় না। এবং প্রায় সকলেরই মোবাইলে নেট সংযোগ। এর ফলে মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখার পরিপূর্ণ সুযোগ তাদের থাকে। এবং অধিকাংশই তার সদ্ব্যবহার করে। এর ফলে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও তাদের মানস-যৌনজীবনের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়। তাদের বিপথগামী হওয়ার গুরুতর সম্ভাবনা থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেও থাকে। সাম্প্রতিককালে কিশোর ও তরুণদের দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে নিহিত কারণগুলির মধ্যে নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখাও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। প্রসঙ্গত, অল্পবয়সী মেয়ে রাও পর্নোগ্রাফিতে ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ছে এবং এর ফলে অবৈধ যৌন ক্রিয়াকলাপ অনেক সহজ হয়ে গেছে।
  • পর্নোগ্রাফিতে অজাচার ও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক দেখানো হয়। যদিও সেগুলি বাস্তবের ঘটনা নয়। কিন্তু এ জাতীয় বিকৃত যৌন সম্বন্ধ প্রদর্শন অনেক মানুষকেই অবৈধ, অনৈতিক যৌন সম্বন্ধে আবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবেও এমন ঘটনা ঘটে যায়।
  • পর্নোগ্রাফি অনুসরণ করে যৌন ক্রিয়াকলাপ সম্পূর্ণ করতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে হয়। এ কারণে হতাশার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে ব্যক্তির স্বাভাবিক যৌনজীবন ব্যাহত হতে পারে।
  • পর্নোগ্রাফিতে এমন কিছু বিকৃত যৌনাচার দেখানো হয় যা মনকে বিকৃত করে দেয়। প্রায়ই যৌনতার প্রতি এক ধরনের ঘৃণা ও বিতৃষ্ণ জন্মায়। মূলত মেয়েদের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে। এরকম ক্ষেত্রে তার স্বাভাবিক যৌনজীবন ব্যাহত হয়, স্বাভাবিক যৌন ক্রিয়াকর্মে সে কখনোই সচ্ছন্দভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এবং যৌন সুখ লাভ থেকেও সে রক্ষিত হয়।
  • পর্নোগ্রাফি দেখতে হয় গোপনে। এটি মনে এক ধরনের অপরাধবোধ সৃষ্টি করে। যদি কেউ দেখে ফেলে সে পর্নোগ্রাফি দেখছে তাহলে তাকে চরম অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। একদিকে দেখার অদম্য ইচ্ছা, অন্যদিকে ধরা পড়ে যাবার আশঙ্কা—এই দুইয়ের সংঘাত মনে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে। যার ফলে মনের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়।
  • পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ হল যে, এমন কিছু ক্রিয়া আছে যেগুলি নিজে মন্দ নয়, কিন্তু প্রকাশ্য প্রদর্শন অনুমোদন যোগ্য নয়। পর্নোগ্রাফি সম্বন্ধে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সমাজের সার্বিক কল্যাণের ওপর পর্নোগ্রাফির প্রভাব ভয়াবহ এবং নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর।
  • একটি সর্বজন স্বীকৃত নৈতিক নীতি হল মানুষকে কখনোই উপায় হিসাবে গণ্য করা উচিত নয়। সর্বদা লক্ষ্য হিসাবে গণ্য করা উচিত। পর্নোগ্রাফি এই মৌলিক নীতির পরিপন্থী। কেননা তা নারীকে যৌনসুখ ভোগ করার উপায় হিসাবে গণ্য করে। পর্নোগ্রাফিতে নারীকে যৌনবস্তু হিসাবে গণ্য করা হয়, ব্যক্তি হিসাবে নয়। 

এই যুক্তিটির বিরুদ্ধে বলা যায় পর্নোগ্রাফিতে শুধুমাত্র নগ্ন নারীদেহ প্রদর্শিত হয় না, নগ্ন পুরুষদেহও প্রদর্শিত হয়। তাছাড়া পর্নোগ্রাফি ছেলেদের মতো মেয়েরাও উপভোগ করে । অধিকন্তু পর্নোগ্রাফিতে যদি নারী যৌনবস্তু হিসাবে গণ্য হয় তাহলে পুরুষও যৌনবস্তু হিসাবে গণ্য হবে।

  • পর্নোগ্রাফিতে কোনো কাহিনী থাকে না, থাকে শুধুমাত্র যৌনদৃশ্য। কাহিনী ব্যতিরেকে যৌনতা প্রদর্শন অযৌক্তিক। পর্নোগ্রাফির নিহিতার্থ হল এই যে, যৌনসুখই চরম সুখ, কিন্তু একথা সত্য নয়। যৌনতা মানবজীবনে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মানুষের আরও অনেক চাহিদা আছে সেগুলি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
  • নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্নোগ্রাফিকে অসম্মানজনক বা অমানবিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারীবাদীরা মনে করেন, পর্নোগ্রাফি নারীকে অমর্যাদাকর এবং অমানবিকভাবে চিত্রিত করে। পর্নোগ্রাফির এই উদ্দেশ্য সমাজের নৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে। বলাইবাহুল্য নারীবাদীরা পর্নোগ্রাফিকে পুরষতন্ত্রের দানবীয় প্রকাশরূপে বর্ণনা করেছেন। এই যুক্তিটির উত্তরে বলা যেতে পারে, পর্নোগ্রাফি শুধুমাত্র নগ্ন নারীদেহ নয়, নগ্ন পুরুষদেহেরও জীবন্ত প্রকাশ। আর উভয়ের ‘সহযোগিতার ভিত্তিতেই যৌন ক্রিয়াকলাপ সম্পূর্ণ হতে পারে ও হয়ে থাকে যা পর্নোগ্রাফিতে প্রদর্শিত হয়।

মানব জীবনে যৌনতা বাস্তব। নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। শুধুমাত্র পুরুষদেরই যৌন কামনা, বাসনা আছে, নারীর নেই—একথা সম্পূর্ণ ভুল। পুরুষ যেমন না দেহের মাধ্যমে যৌনসুখ লাভ করতে চায় এবং করে, তেমনি নারীও পুরষ দেহের মাধ্যমে যৌনসুখ লাভ করতে চায় ও করে। এ কারণেই পুরুষ যদি যৌন দিক থেকে অক্ষম হয় তাহলে তার স্ত্রী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নানান পন্থা ও পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে এবং করেও থাকে। যথা পর পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্বন্ধে লিপ্ত হওয়া বা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। কাজেই পুরুষের মতো নারীও যৌনসুখ লাভের জন্য লালায়িত ও উদগ্রীব থাকে। কাজেই পর্নোগ্রাফি পুরুষ ও নারী উভয়েরই চাহিদা মেটায়। পর্নোগ্রাফি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নির্মিত হয় এমন কথা আদৌ ঠিক নয়।

পর্নোগ্রাফি চলছে, চলেই আসছে, দিনে দিনে- এর দর্শক সংখ্যাও বাড়ছে। পর্নোগ্রাফি ঘিরে নতুন ধরনের চাহিদাও তৈরি হচ্ছে। এর ফলে নতুন নতুন সাইট খোলা হচ্ছে যেখানে শুধু পর্নোগ্রাফি দেখানো হয়।

শেষের কথা

একটি প্রশ্ন ওঠে, পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয় না কেন? এমনকী নারীবাদীরাও শুধুমাত্র বিবৃতি দিয়েই খালাস, আন্দোলন গড়ে তুলছেন না কেন? পর্নোগ্রাফির মতো এত আপত্তিজনক বিষয় নিয়ে আন্দোলন নেই কেন? উত্তরে বলতে হয় যে, ঠিক যে কারণে মদ, ড্রাগ, জুয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয় না, সরকার কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয় না, ঠিক সে কারণেই পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এইসব নিয়ে কোনো গোষ্ঠী প্রশ্ন তুললে তাদের নানাভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়। মদ, ড্রাগ, জুয়ার মাধ্যমে যেমন একশ্রেণীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিপুলভাবে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়, ঠিক তেমনি সরকারের কোষাগারে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা পড়ে। এছাড়া আছে বিভিন্ন ধরনের সরকারি কর্মচারীসহ ব্যক্তিদের বেআইনিভাবে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ। তাই মদ, ড্রাগ, জুয়ার মতো পর্নোগ্রাফিও বাধাহীনভাবে চলছে ও চলবে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version