Home স্বাস্থ্য পরামর্শ স্বাস্থ্যসম্পর্কিত খবর আপনার রোজের প্রয়োজনীয় ওষুধের গুণগত মান কতটা সঠিক ?

আপনার রোজের প্রয়োজনীয় ওষুধের গুণগত মান কতটা সঠিক ?

একে তো রোগের জ্বালায় জর্জরিত মানুষ তার থেকে রেহাই পেতে ওষুধ খাবেন সেখানেও প্রশ্নচিহ্ন— যে ওষুধ খাওয়া হল তার গুণমান ঠিক আছে তো? সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা জানা তো সম্ভব নয়। দোকান থেকে ওষুধ কেনার সময় একজন সাধারণ মানুষ যেটুকু করতে পারেন সেটা হল, ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট টা  দেখে নিতে পারেন আর ওষুধের নামটা ঠিক আছে কি না সেটা মিলিয়ে নিতে পারেন। তাহলে গুণমান ঠিক আছে কি না বুঝবেন কীকরে? সেটা তো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। তিনি তো এটুকু ধরে নিয়েই ওষুধটা কিনছেন যে, সেটা ঠিক আছে। ওষুধের গুণমান বিচারের জন্য ড্রাগ কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট রয়েছে, তাদেরই দায়িত্ব ওষুধের মান নির্ণয় করার।

আজকাল খবরের কাগজে প্রায়ই দেখা যায় নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছেয়ে গেছে। ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স অনুযায়ী নিম্নমান বা লো-কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে ওষুধকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।

স্পুরিয়াস ড্রাগ

বহুল প্রচলিত কোনো ওষুধের নামকে নকল করে একই রকম দেখতে নকল ওষুধ তৈরি হয়। কিন্তু তাতে কোনো ড্রাগ সাবস্ট্যান্স থাকে না। এমনকী প্যাকেজিং, লেবেল পর্যন্ত নকল করা হয়, যা আসল ওষুধের সাথে হুবহু এক দেখতে হয়। সাধারণত নামী কোনো ওষুধের নকল করে স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় এমন দুষ্কর্ম করে।

মিসব্র্যান্ডেড ড্রাগ

কিছু কিছু ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যাওয়া ওষুধে অন্য কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয় বা তার প্যাকেজিং ও লেবেলিং-এ পরিবর্তন করা হয়। আবার ওষুধের গায়ে যদি সঠিক তথ্য না দেওয়া থাকে তাহলে সেটাও নিম্নমানের ওষুধ বলেই ধরে নেওয়া হয়। আর যদি ওষুধের লেবেলে বিভ্রান্তিকর কোনো তথ্য দেওয়া থাকে, সেটাও অপরাধ।

অ্যাডালটারেটেড ড্রাগ

অ্যাডালটারেটেড কথাটা বোঝায় ভেজাল ওষুধকে। বাইরে থেকে দেখে ওষুধটা ঠিক মনে হলেও আদতে তা নয়। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটা ট্যাবলেটকে দেখে ঠিক মনে হতে পারে কিন্তু তার মধ্যে যে ওষুধ থাকার কথা আদতে তা নেই। এমনও হতে পারে তাতে ওষুধ নয়, এমন কিছু মেশানো আছে যা ক্ষতিকারক। আবার এমনও হয় কোনো একটি ট্যাবলেটে হয়তো পাঁচশো মি.গ্রা. ওষুধ থাকার কথা ছিল কিন্তু তাতে আছে একশো মি.গ্রা. ওষুধ আর বাকিটা অন্যকিছু। তাহলে সেই ওষুধ খেলে যতটা কাজ হবার কথা তা হবে না।

এছাড়াও মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ওষুধের লেবেল পরিবর্তন করে তার মেয়াদের সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়। যা একটি মারাত্মক অপরাধ। এমন ঘটনার খবর আমরা প্রায়ই কাগজে দেখে থাকি। আসল কথা হল নিম্নমানের ওষুধের মূল উদ্দেশ্য হল লোক ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন।

একটা ওষুধকে নিম্নমানের বলা মানেই যে সেটা ভেজাল বা নষ্ট হয়ে যাওয়া ওষুধ কিংবা নকল ওষুধ তা কিন্তু নয়। একটা ওষুধ বাজারে আসার আগে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের অনেকগুলো ধাপে পরীক্ষা পেরিয়ে তবেই বাজারে আসে। সেখানে যদি কোনো গাফিলতি থাকে তাহলে সেটা নিম্নমানের ওষুধ বলেই পরিগণিত হবে। একটা ওষুধ তৈরি করা থেকে অর্থাৎ তার র-মেটেরিয়াল থেকে আরম্ভ করে ওষুধটাকে প্যাকিং করে লেবেল করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে তার কোয়ালিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। এবং তাতে সন্তুষ্ট হলে তবেই কোয়ালিটি কন্ট্রোল থেকে ওষুধটার বাজারে যাবার ছাড়পত্র মেলে। এরপরও ওষুধটির স্যাম্পেল রেখে দেওয়া হয় এবং তা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরীক্ষা করে দেখা হয় যে সেটা ঠিক অবস্থায় আছে কি না।

অ্যালোপ্যাথি ওষুধের ক্ষেত্রে এই নিম্নমানের ওষুধের সমস্যাটাই সবথেকে বেশি। স্বাভাবিক ভাবে যে পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরি হয় সেখানেও যে গাফিলতি থাকে না তা নয়। ওষুধের র-মেটেরিয়ালস বা অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্র্যাডিয়েন্টস-এর গুণমান যদি ঠিক না থাকে তাহলে প্রথমেই সমস্যা শুরু। ওষুধ তৈরির প্রতিটি ধাপে বিভিন্ন পরীক্ষা চলে, সমস্যা সেখানেও থাকতে পারে। প্রতিটি ইন্সট্রুমেন্ট থেকে আরম্ভ করে ওষুধ তৈরির পরিবেশ সবকিছুই হওয়া উচিত জি.এম.পি (গুড ম্যানুফ্র্যাকচারিং প্রসিডিওর) অনুযায়ী। কিন্তু সঠিক পরিদর্শনের অভাবে বহু ছোট থেকে মাঝারি ওষুধ কোম্পানি সবসময় এসব নিয়ম-কানুন মেনে চলে না, ফলত ওষুধের গুণমানও সেইরকমই হয়। ইঞ্জেকশন (বা বিভিন্ন পেরেন্টোরাল প্রোডাক্ট), চোখের ড্রপ, কানের ড্রপ ইত্যাদির ক্ষেত্রে যথেষ্ট রকম প্রিকশন নিতে হয়। ওষুধ তৈরির পরিবেশ (পরিবেশ অর্থাৎ যেখানে ওষুধ তৈরি হয় সেই জায়গাটা হয় সম্পূর্ণ স্টেরিলাইজড বা জীবাণুমুক্ত, এমনকী জীবাণু সংক্রমণ এড়ানোর জন্য একটি বিশেষ রশ্মি ব্যবহার করা হয়ে থাকে) থেকে ব্যবহার করা ডিস্টিল ওয়াটার ও অন্যান্য মেটেরিয়ালস হতে হয় একদম নিখুঁত মানের, এমনকী যিনি সেখানে কাজ করছেন তার মুভমেন্ট পর্যন্ত রেস্ট্রিক্টেড করা হয় জীবাণুর সংক্রমণ এড়াতে। ওষুধ তৈরির পরেও র‍্যান্ডম স্যাম্পেলিংয়ের মাধ্যমে তার গুণমানের পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় তাতে ওষুধের পরিমাণ ঠিক আছে কি না, কোনো জীবাণুর উপস্থিতি আছে কি না ইত্যাদি।

allopathic medicine

ট্যাবলেটের ক্ষেত্রে তার ডিসইন্ট্রিগেশন টেস্ট করা হয় তার বাইন্ডিং ঠিক আছে কি না দেখার জন্য, ডিসোলিউশন টেস্ট করা হয় তার বায়োএভিলিব্লিটি বোঝার জন্য। বাজারে ছাড়ার পরেও ওষুধটা যেরকম তাপমাত্রায় রাখার কথা সেরকম তাপমাত্রায় কিছু স্যাম্পেল রেখে দেওয়া হয় দেখার জন্য যে, এক্সপায়ারি ডেট অবধি ওষুধটা ঠিক থাকছে কি না। যদি কোনোরকম সমস্যা হয় তাহলে তখন ওষুধটা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়।

এ তো গেল একটা ওষুধ কোম্পানি কীভাবে ওষুধের গণমানের দেখভাল করে। এবার ওষুধ কোম্পানির তরফ থেকে যদি কোনো পদ্ধতিগত গাফিলতি থাকে তাহলে ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাজার চলতি কোনো ওষুধকে যদি বেআইনিভাবে নকল করে কেউ তৈরি করে তাহলে অনেক সময়ই খালি চোখে তা বোঝা সম্ভব নয়।

 হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ক্ষেত্রেও যে সমস্যাটা নেই তা নয়। প্রথমত,হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সাধারণত একটি নামেই হয়, অ্যালোপ্যাথির মতো কোম্পানিভেদে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নাম নেই। অর্থাৎ নাক্সভমিকা মানে নাক্সভমিকাই, সে যে কোম্পানিরই হোক না কেন। এর অন্য কোনো নাম হবে না। আর ব্র্যান্ড নামে হোমিওপ্যাথির যে মিশ্রণ ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় তা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসারই নীতি বিরুদ্ধ। সুতরাং এর গুণই বা কি আর মানই বা কি, তার কোনো নির্দিষ্টতা নেই। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিভিন্ন সোর্স থেকে তৈরি হয়ে থাকে। সুতরাং র-মেটেরিয়ালস-এর সঠিক মানের ওপর ওষুধের গুণ নির্ভর করে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরি হয় ডাউনওয়ার্ড স্ট্রোকের মাধ্যমে, সঠিক সংখ্যক স্ট্রোক যদি না দেওয়া হয় তাহলে ঠিকমতো পোটেনটাইজেশন হবে না। অ্যালকোহলের গুণের ওপরেও ওষুধের গুণমান অনেকাংশে নির্ভর করে। হোমিওপ্যথিক ওষুধ কোম্পানিও জি.এম.পি-এর আওতাধীন। সুতরাং ওষুধ তৈরি থেকে বাজারে যাওয়া অবধি প্রতিটি ধাপেই কোয়ালিটির পরীক্ষা চলে। কিন্তু পদ্ধতিগত ত্রুটি যদি থেকে যায় তাহলে ওষুধের মান নিয়েও সংশয় থেকে যায়।

প্যাথি যাই হোক, ওষুধ প্রস্তুতকারক সব সংস্থাই সবসময় চেষ্টা করে ওষুধের গুণমান ঠিক রাখতে। যদিও কোনো গাফিলতি থাকে সেটা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে মেটানো যায় (যদি সরষের মধ্যে ভূত না থাকে)। কিন্তু অসাধু, বেআইনি কিছু ব্যবসাদারদের মাধ্যমে তৈরি হওয়া জাল ওষুধ এমনিতে দেখে বোঝা বা জানা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের তরফে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ওষুধের বিশুদ্ধতার জন্য।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version