পাহাড়ে অভিযানের খুঁটিনাটি

পাহাড় আর প্রকৃতি আমার জীবনে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো জড়িয়ে আছে। ভালোলাগা, ভালোবাসা কোনো শব্দ দিয়েই পাহাড়কে আমি সঠিকভাবে ব্যক্ত করতে পারি না। তাই তার জন্য যাবতীয় আবেগ তোলা থাক আমার মনের সিন্দুকে। বরং তার কাছে যেতে হলে এমন কিছু অঙ্গীকার করে বা শর্ত মেনে যেতে হয় যার একচুল এদিক ওদিক হলেই তার রোষের কবলে পড়তে হয়। পাহাড়ের একটা ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ আছে। শুধুমাত্র সুন্দর রূপের টানে ছুটে গেলে ভয়ঙ্করের মুখোমুখিও হতে হয়। আমরা যারা অভিযাত্রী তারা সবকিছু জেনে, বুঝে, সতর্ক হয়েই যাই আর সেজন্যই বোধহয় কখনো কখনো ভয়ঙ্করের মুখে পড়লেও তা মনের মধ্যে বিষণ্ণতার ছায়া ফেলতে পারেনি।

আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন পাহাড়ে গেলে কী কী বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আমি কিন্তু সোজাসুজিই বলে দিতে পারি যে পাহাড়ের থেকে সমতলেই বিপদ অনেক বেশি। তবুও আমাদের বিষয় যখন পাহাড় তখন পাহাড়ের অসুবিধেগুলোই আলোচনা করব। সমতল থেকে মানুষ যখন পাহাড়ে যান তখন প্রথম যে অসুবিধে সামনে আসে তা হল উচ্চতার তফাত। অতি উচ্চতায় অক্সিজেন কমের ফলে সমস্যা দেখা দেয়। প্রথম অবস্থায় একেবারে টানা পাহাড়ে ওঠা যায় না। এর জন্য শরীরকে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার সময় দিতে হয়। সাধারণত দেখা গেছে আট থেকে দশ হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত অসুবিধে হয় না। তারপর সমস্যা আসে। এরপর থেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পদ্ধতি শুরু করতে হয়। অর্থাৎ

কিছুদূর উঠে আবার নেমে আসতে হয়। পরদিন আবার একইভাবে। এই পদ্ধতির নাম acclimatization অর্থাৎ শরীরটাকে সমতল থেকে উচ্চতার তারতম্যে খাপ খাইয়ে নেওয়া। বেস ক্যাম্পে যেতে হলেও এই পদ্ধতিতে যেতে হবে। এটা ঠিকমতো না হলে শরীরে অস্বস্তি শুরু হয়, যেমন বমি হওয়া, মাথার যন্ত্রণা, তন্দ্রাচ্ছন্নভাব ইত্যাদি। এসময় উপরে ওঠার জন্য যে হাঁটা শুরু হয় তার কিছুক্ষণ পরে, ধীরে ধীরে নীচে নেমে এসে ঘুমোতে হবে। কারণ শরীর পরিশ্রান্ত থাকলে আর প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নিলে শরীর খারাপ হতে বাধ্য। দু’বার-তিনবার ওঠানামা করে তারপর ওই জায়গায় ক্যাম্প করবে এবং ওইখান থেকে

আবার পরবর্তী উচ্চতায় যাওয়ার আগে এভাবেই খাপ খাইয়ে নেওয়ার পদ্ধতি চলতে থাকবে। এইভাবেই ধীরে ধীরে লক্ষ্যপথে এগোতে হয়। আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হয় যে, পাহাড়ে ওঠাটা একটা দলগত ব্যাপার। সম্পূর্ণ একা পাহাড়ে ওঠা যায় না। সঙ্গে তো গাইড থাকেই, এছাড়াও দলে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি – পাহাড়ের সবকিছু যার জানা, এরকম মানুষকে দলে রাখতেই হবে। যিনি অভিযাত্রী তিনি সব সময় নিজের শারীরিক অবস্থার কথা বুঝতে পারেন না যেটা অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে এবং সেটা অভিযাত্রীকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আরেকটা অসুবিধে হল অতি উচ্চতায় শরীরে জলের ঘাটতি দেখা যায়। এজন্য সমতলে আমরা যে পরিমাণ জল খাই পাহাড়ে তার থেকে অনেক বেশি জল খেতে হয়। তবে এখানে একটা বড়সড় অসুবিধে হল মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রায় বেশি জল খাওয়াটাও অসুবিধেজনক। সবসময় জল গরম রাখার ব্যবস্থা রাখতে হয়।

পাহাড়ে বার বার ওঠা-নামার পরিশ্রমে শরীরে প্রচুর ঘাম হয়, ফলে প্রয়োজনীয় জল না পেলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে জলের পাশাপাশি তরল জিনিস যেমন, চা, কফি খাওয়া যেতে পারে। এতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় না। এছাড়াও হিল ডায়রিয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে হিল ডায়রিয়া খুব কমই হয়।

পাহাড়ের বিপদ

এ প্রসঙ্গে বলি যে এর কারণ দুটো— এক প্রকৃতির কারণে আর দ্বিতীয়, নিজের ভুলে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে পারি যে, অভিযাত্রীর বিপদ আসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের ভুলে। মনে রাখবেন সামান্যতম ভুল অভিযাত্রীর জীবনে বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। যেমন জেদের বশে হঠাৎ করে অতি উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া। এতে বড়সড় শারীরিক বিপদ আসতেই পারে। এরপর আসি প্রকৃতির কারণে পাহাড়ে কী ধরনের বিপদ আসে। প্রকৃতির দিক থেকে যে বিপদগুলো আসে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল রক্ ফল। পাহাড়ে এটা প্রায়শই হয়। বরফের ধস নামে। পাহাড়ের ওপর থেকে বড় বড় বরফের চাঁই-যেগুলোকে অ্যাভেলাঞ্চ বলা হয়, তাতে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, এমনকী প্রাণহানির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এক্ষেত্রে ওই এলাকার ম্যাপ স্টাডি করে গেলে এই ভয়টাকে এড়ানো যায়। অর্থাৎ অভিজ্ঞ অভিযাত্রী ম্যাপ স্টাডি করলেই মোটামুটি বরফের ধস নামতে পারে বা এরকম প্রবণতা আছে এ অঞ্চলগুলোকে চিহ্নিত করতে পারেন। আরেকটা ভয়ের ব্যাপার হল বরফের ফাটল। বরফের রাস্তায় বড়সড় ফাটল অভিযাত্রীদের যাবার পথে অসুবিধের সৃষ্টি করে। এখানে বলি যদি ফাটলটি সরাসরি দেখা যায় তাহলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার অনেক উপায় আছে। ফাটলের ওপর আড়াআড়িভাবে অ্যালুমিনিয়ামের মই  ফেলে যাতায়াত করা যায়। তবে মারাত্মক হল, কিছু কিছু ফাটল আছে যার ওপর হালকা বরফের আস্তরণ পড়ে থাকে। ওপর থেকে দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে আসলে কতটা গভীর। এগুলোর আন্দাজ না পাওয়ার জন্যই যেকোনা সময় বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যদি ভাগ্য ভালো থাকে তবেই ক্রিভাস বেয়ে ওপরে ওঠা সম্ভব হয়। তবে এখানেও বলি অভিযাত্রী যত অভিজ্ঞ হবেন অর্থাৎ পাহাড়ে অনেকবার যাওয়ার অভিজ্ঞতায় এই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হলেও এক্ষেত্রে তিনি ক্রিভাসগুলোর সম্পর্কে সাবধান হয়ে চলতে পারবেন। 

এবার স্নো-ফলের কথায় আসি। নীচে যেমন ঝড়বৃষ্টি পাহাড়ে সেটাই তুষার ঝড় ও তুষারপাত বা স্নো ফল। তুষারপাত শুরু হলেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুতে ঢুকে পড়তে হবে। একেবারেই বাইরে বেরোনো চলবে না। যদি দু’-তিন দিন ধরে তুষারপাত চলে তবে বাইরে বেরিয়ে তাঁবুর ওপরের বরফ পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। বরফ যদি ক্রমাগত জমতে থাকে তাহলে একসময় ওই বরফ চাপা পড়েই তাঁবুর লোকজন মারা পড়তে পারে। তুষার ঝড়ও বেশ বিপজ্জনক। এতে তুষারপাতের সঙ্গে প্রবল ঝড় বইতে থাকে। এই ঝড়ে পাথর উড়ে এসে পড়তে পারে। সেই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখতে হয়। পাহাড়ে যখন খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে তখন মনে রাখতে হয় যে, খুব সকালে বেরিয়ে দুপুর বারোটা থেকে একটার মধ্যে ফিরে আসতে হয়। কারণ সাধারণত এরপর থেকেই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। স্নো ফল, মেঘলা আবহাওয়া এগুলোর মুখোমুখি হতে হয়। 

আরেকটা অসুবিধে হয় যেটাকে আমরা বলি হোয়াইট আউট হয়ে যাওয়া। বরফের পথে যেতে যেতে হঠাৎই চারদিক মেঘে ঢেকে যায়, কিছুই দেখা যায় না। অনেক সময় এমন অবস্থা হয় যে দু’হাত দুরের জিনিসও দেখতে পাওয়া যায় না। বরফের মধ্যে চিহ্নিত রাস্তাও যায় হারিয়ে। এ সময় অভিযাত্রী যদি বসে না পড়েন বা আশ্রয় না নেন তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। 

আরেকটা ব্যাপার বলি। সমতলে আমরা দূষণমুক্ত অঞ্চল খুঁজে পাই না। অথচ পাহাড়ের পুরোটাই প্রায় দূষণমুক্ত। যত ওপরে ওঠা যায় ততই পরিবেশ দূষণমুক্ত হতে থাকে। এর ফলে বরফের ওপর যখন সূর্যালোক পড়ে তার থেকে সরাসরি প্রতিফলন ঘটে, সেটা আমাদের চোখের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। এজন্য দেখবেন অভিযাত্রীরা স্নো-গগলস্ পরে থাকেন। যদি কখনো ভুল করে এটা পরা না থাকে তাহলে এক থেকে দু’ মিনিটের মধ্যেই চোখে নেমে আসে অন্ধকার। এতে চোখে প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়, জল পড়ে এবং চোখের দৃষ্টিক্ষমতা চলে যায়। তবে এটা পুরোপুরি অন্ধত্ব নয়। তিন-চার দিনের মধ্যে আবার দৃষ্টি ফিরে আসে। এটা অভিযাত্রীরা জানেন। তবে সেই জানার মধ্যে যদি কিছু ফাঁক বা গাফিলতি থেকে যায় তাহলে এর কবলে পড়তে হয়। যেমন ধরুন মেঘলা আবহাওয়া দেখে কেউ যদি ভাবেন স্নো-গগলস্ না পরলেও চলবে তাহলেই ভুল করবেন। আর এখানে ও সেই অভিজ্ঞ অভিযাত্রীর প্রসঙ্গে এসে যায়। যিনি কখনোই এই ভুল করেন না এবং সঙ্গে নবীন অভিযাত্রীদের সাবধান করে দেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, কেউ কেউ বলেন পাহাড়ে ভূমিকম্প হলে তার কীভাবে মোকাবিলা করা যায়। আমার মনে হয় ভূমিকম্প সমতল বা পাহাড় সব জায়গাতেই সমান প্রভাব ফেলে। পাহাড়ে বিপদ একটাই বড় বড় পাথর গড়িয়ে আসার। তবে যেখানে অনেকখানি বড় প্রান্তর থাকে সেখানে ভয়টা কম।

trekking guide in bengali

ভুলভ্রান্তি

এরপর আসি নিজেদের ভুলভ্রান্তির কথায়। সবার শরীরের গঠন সমান নয়। অনেকের অতি উচ্চতায় গেলেই শরীর খারাপ করে। বারবার সাবধানবাণীর মতোই বলছি কোনোরকম শরীর খারাপ হলে তা উপেক্ষা করা একেবারেই উচিত নয়। সবসময় সুস্থ থাকতে হবে। পাহাড়ে গেলে কতগুলো অসুবিধে নিয়েই চলতে হয়, যেমন ঠিকমতো স্নান করা যায় না, ঠিকমতো খাওয়া হয় না, শারীরিক অসুস্থতা দেখা যায়। এ অবস্থায় একমাত্র কর্তব্য হল সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে নীচে নামিয়ে আনা, তাহলেই সে সুস্থ বোধ করবে। নীচে না এসে যদি সে ওখানে থেকেই চিকিৎসা করার কথা ভাবে তাহলেই ভুল করবে এবং এই ভুলের মাসুল তাকেই দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, পোশাকের কথায় আসি। অভিযাত্রীদের পোশাক। পায়ের বিশেষ জুতো, হাতের গ্লাভস ইত্যাদি যদি অনেকক্ষণ ভিজে অবস্থায় থাকে তাহলে অতিরিক্ত ঠান্ডায় পায়ের আঙুল, হাতের আঙুলের মাথা গুলোতে এবং নাকের ডগা, কানের লতি ইত্যাদিতে ঠিকমতো রক্ত চলাচল না হওয়ার জন্য পচন ধরে যায় এবং এর থেকে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেলে সেই জায়গাটুকু বাদ দিয়ে দিতে হয়। এছাড়া অভিযাত্রীদের শরীরের চামড়া সূর্যের তেজে ঝলসে যায় যেটাকে আমরা স্কিন বার্ন বলি। এর জন্য একটা বিশেষ লোশন মাখতে হয়। যে ব্যাপারগুলো উল্লেখ করলাম সেইসব ক্ষেত্রে আগাম সতর্ক হয়ে চললে যেমন ধরুন ফ্রস্ট বাইট হলে সঙ্গে সঙ্গে নীচে নামিয়ে নিয়ে এসে গরম কাপড়ে জায়গাটা জড়িয়ে রাখতে হয় ইত্যাদি, তাহলে অভিযাত্রী সুস্থ হয়ে ওঠে। 

পাহাড়ের অভিযানে কতগুলো অলিখিত শর্ত আছে যা কোনো নিয়ম-নীতির বইতে হয়তো লেখা নেই তবুও সার্বিক স্বার্থে তা মেনে চলতে হয়। পাহাড়ের অভিযান কোনো একক অভিযান নয় বরং দলগত অভিযান, একথা আগেই বলেছি। কিন্তু শুধু কাজে নয়, মানসিকভাবেও প্রত্যেক অভিযাত্রীকে সমমনস্ক হতে হয় বা এক থাকতে হয়। প্রথমত দলে যিনি অভিজ্ঞ থাকবেন তাকে প্রত্যেক সদস্যের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। এছাড়াও দলে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন তাকে চিকিৎসাধীন রেখে বাকিরা অভিযানে গেলেন এবং মনে ভাবলেন অসুস্থ ব্যক্তিকে পরে নিয়ে নামবেন— এমন ভাবনা পাহাড়ের অভিযানে চলে না। যদি পরিস্থিতি জটিল হয় তখন একজনের জন্যই পুরো অভিযান বাতিল করে নীচে নেমে আসতে হবে এবং এর জন্য কাউকে দোষারোপ করা চলবে না। 

দীর্ঘ অভিযাত্রী জীবনের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে চাই কোনো অভিযানে গেলে তার প্রাক্ প্রস্তুতি খুব ভালো করে করতে হয়। সম্পূর্ণ অভিযানের একটা পরিকল্পনা ভালোভাবে করতে হয়। পরিকল্পনা যত ভালো তার সাফল্যের মাত্রা তত বেশি। এবং নতুন অভিযাত্রী হলে সঙ্গে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাউকে রাখতে হয় এবং সবসময় দলনেতার নির্দেশ মেনে চলতে হয়। এভাবে চললে অভিযানের সাফল্যের হার বেশি হবে এবং সুন্দরভাবে অভিযান করে নেমে আসতে পারবে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version