কিডনির রোগ সম্পর্কে অনেক সময় অকারণেই মানুষের মনে ভীতি দেখা যায়। আবার পাশাপাশি কোনো মানুষকে কিডনি দান করবার অনুরোধ জানালে তিনি প্রচন্ড বিরক্ত হন। ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়, কিডনি রোগগ্রস্ত মানুষের সাথে সাথে তাকেও যেন বিপদে ফেলার চেষ্টা। অথচ জেনে রাখা দরকার কিডনি সংক্রান্ত রোগের পঁচাত্তর শতাংশই নিরাময়যোগ্য। এমনকী কিডনি প্রতিস্থাপনও যন্ত্রণাবিহীন। আর কিডনি প্রতিস্থাপনের পর রোগী আগের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন ৷
কিডনি সংখ্যায় এক জোড়া, দেখতে শিমের দানার মতো। আকারে অবশ্য অনেকটাই বড়। শিরদাঁড়ার দু’পাশে, কোমরের একটু ওপরে থাকে ৷ ওজন একশো ত্রিশ গ্রাম থেকে একশো পঞ্চাশ গ্রামের মতো।
কিডনি দুটো আমাদের দেহে ছাঁকনির কাজ করে। একটি কিডনি খারাপ হলে বা জন্ম থেকেই না থাকলে আরেকটি কিডনি সুন্দরভাবেই কাজকর্ম করে। দুটো অংশ থাকে কিডনিতে— বাইরে কর্টেক্স আর ভেতরে মেডালা। কিডনি গঠিত প্রায় দশ লক্ষ নেফ্রন নিয়ে, যার আবার দুটো অংশ গ্লোমেরুলাস ও টিবিউল। শরীরের হাজার রকম দূষিত পদার্থ রক্তের মাধ্যমে কিডনির গ্লোমেরুলাসে পৌঁছয়। সেখানে ছেঁকে নেবার পর পরিশুদ্ধ রক্ত আবার দেহে ফিরে যায় আর দূষিত অংশ মূত্র হয়ে টিবিউলের মধ্যে দিয়ে বার হয়ে এসে মূত্রনালী বা ইউরেটার বাহিত হয়ে মূত্রথলি বা ব্লাডারে জমে। এবং নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বার হয়ে যায় ৷
প্রতিদিন প্রায় একশো আশি লিটার তরল কিডনিতে ঘুরে বেড়ায় এবং এর প্রায় সবটাই শোষিত হয়ে রক্ত সঞ্চালনে ফিরে যায়। মাত্ৰ দেড় থেকে দু’লিটার মূত্র বা প্রস্রাব হয়ে দেহ থেকে বার হয়ে যায়।
Table of Contents
কিডনির কাজ কী কী
আমাদের শরীরে কিডনি দুটো অনেক কাজ করে। প্রধান কাজ হল দেহের পক্ষে ক্ষতিকর পদার্থগুলোকে দেহ থেকে বিদায় করা। এদের মধ্যে রয়েছে প্রোটিনজাত ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি। এছাড়া ওষুধ ও নানা ক্ষতিকর পদার্থ কোনোভাবে যা দেহে প্রবেশ করেছে তাকেও মূত্রের সঙ্গে বার করে দেয় কিডনি।
শরীরে জলের এবং নানা খনিজ পদার্থের ভারসাম্য বজায় রাখা, অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষা করার পাশাপাশি কিডনি লাল রক্তকণা তৈরির জন্য এরিথ্রোপোয়েটিন নামে একটি হরমোন তৈরি করে। এছাড়া ভিটামিন-ডি বিপাকে সহায়তা করাও কিডনির গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখা, রেনিন ও প্রস্টাগ্ল্যান্ডিন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করা এবং প্রতিকূল অবস্থায় ‘রক্তচাপ ঠিক রাখাও কিডনির কাজ।
কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ | Kidney Failure Symptoms
কিডনি খারাপ হয় নানা কারণে। যেমন-
- জন্মগত কারণে অর্থাৎ বাবা-মায়ের নেফ্রাইটিস রোগ থাকলে তা পরবর্তী প্রজন্মে সন্তানদের মধ্যে পরিবাহিত হতে পারে। একে বলে হেরিডেটারি নেফ্রাইটিস।
- কিডনি শরীরের দূষিত পদার্থ নানা প্রণালীর মাধ্যমে দেহ থেকে নির্গত করে। এই গঠনপ্রণালীর কোথাও ত্রুটি থাকলে সমস্যা দেখা দেয়। এই রোগের নাম পি.ইউ.জে অবস্ট্রাকশন। যা শিশুদের মধ্যে দেখা যায় ।
- প্রস্রাব সঠিকভাবে বের হতে না পারলে কিডনি ফুলে বেলুনের মতো হয়ে ওঠে। এতে কষ্ট হয়। প্রস্রাবে এই ধরনের বাধা নিয়মিত হতে থাকলে কিডনির অসুখ দেখা দেয়।
- নানা ধরনের সংক্রমণ থেকে কিডনির গুরুতর ব্যাধি হতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে ইউরিনারি সংক্রমণ প্রায়ই ঘটে। যা অনেক সময় কিডনি খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- কিডনিতে পাথর জমতে পারে, যাকে কিডনি স্টোন বলে।
- এছাড়া ইমিউনোলজিক্যাল ডিজিজের কারণে চামড়ায় ঘা, টনসিল সংক্রমণ ইত্যাদি হলে বাচ্চাদের শরীর ফুলে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, জ্বালা করে, কষ্ট হয়। কখনও কখনও কিডনি ড্যামেজও হয়ে যায়।
- কোনো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছেমতো অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ খাওয়া বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথার ওষুধ দীর্ঘদিন খেলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফলে গুরুতর রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।
- টিবি বা ক্যানসার হলেও কিডনি বিকল হতে পারে।
- সাপে কাটা রোগীর দেহে বিষক্রিয়ায় কিডনি বিকল হবার সম্ভাবনা আছে।
- খাদ্যে অত্যধিক মাত্রায় রাসায়নিক থাকলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর আজকাল প্রায় সব খাদ্যে মেশানো হচ্ছে নানা রাসায়নিক। যা অত্যন্ত চিন্তার ব্যাপার।
![কিডনি রোগ কি ভাল হয় | Is Kidney Disease Curable? | Kidney Failure Symptoms | Early Signs of Kidney Disease 1 Kidney Failure Symptoms](http://banglaobangali.in/wp-content/uploads/2024/01/Is-Kidney-Disease-Curable.png)
কিডনির কী কী ধরনের অসুখ হতে পারে
কিডনিতে নানা ধরনের অসুখ হতে পারে। আমাদের দেশে মূলত কিডনির অ্যাকিউট অসুখ বেশি হয় ৷
এই রোগে হঠাৎ করে কিডনির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এই রোগের কারণ হচ্ছে—অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস, ক্রনিক নেফ্রাইটিস; নেফ্রোটিক সিনড্রোম ইত্যাদি ৷
অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস | Acute Nephritis
হঠাৎ করেই ইনফেকশন হয় কিডনিতে। স্ট্রেপ্টোকক্কাস হিমোলাইটিকাস জীবাণু এজন্য দায়ী। বেশি হয় শিশুদের এবং তরুণদের। টনসিলের অসুখ এবং গাঁটের বাত বা রিউম্যাটয়েড আথ্রাইটিস হলে এ রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। আক্রান্তহয় গ্লোমেরুলাস এবং টিবিউলগুলো। ফলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ কিডনিতে জমতে থাকে। কিডনি আর স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। রক্তচাপ, অ্যানিমিয়া, রক্তে ইউরিয়ার মাত্রা বেড়ে যায় ।
উপসর্গের মধ্যে রয়েছে চোখের পাতা, মুখ, হাত-পা এমনকী সারা শরীর ক্রমেই ফুলে যায় । প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং প্রস্রাবে রক্ত দেখা দিতে পারে। প্রস্রাব পরীক্ষা করলে অ্যানিমিয়া অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম পাওয়া যায়। বেশি পাওয়া যায় ইউরিয়া।
এই রোগ নির্ণয় করা যায় সহজেই। চিকিৎসার খরচও বেশি নয়। শতকরা প্রায় নব্বইভাগ রোগী ভালো হয়ে যায়।
ক্রনিক নেফ্রাইটিস | Chronic Nephritis
এই রোগে কিডনিতে প্রদাহ দেখা যায় ৷ রোগ-লক্ষণ প্রকাশ পায় ধীরে ধীরে। এ সব ক্ষেত্রে রোগীর ইতিহাস নিলে দেখা যাবে অনেকেরই ছোটবেলায় অ্যাকিউট নেফ্রাইটিসের ইতিহাস আছে। দীর্ঘদিন ধরে হাইপারটেনশন থাকলেও ক্রনিক নেফ্রাইটিস দেখা যায়। রক্ত পরীক্ষা করলে – হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম পাওয়া যায়। এই রোগ সহজে সারতে চায় না। কিডনির কাজকর্ম বন্ধ হয়ে আসে। অবশেষে ক্রনিক রেনাল ফেলিওর দেখা যায়, তখন ডায়ালিসিস ছাড়া কিছু করার থাকে না।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম | Nephrotic Syndrome
কিডনির গ্লোমেরুলাসে প্রদাহের ফলে কিডনির ফিলট্রেশন রেট বেড়ে যায়, প্রস্রাবের সঙ্গে শরীর থেকে প্রচুর প্রোটিন বার হয়ে যায়। ফলে রোগীর পা আর মুখ ফুলে যায়। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হলে বুক এবং পেটে জল জমতে পারে, বারবার নানা ধরনের ইনফেকশন হয়। সাধারণত অল্প বয়সে এই রোগ হয়। রোগীর রক্তচাপ ও অ্যানিমিয়া খুব বেশি থাকে। নানা কারণে নেফ্রোটিক সিনড্রোম হতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং জীবাণু সংক্রমণ হল প্রধান তিনটি কারণ। ডায়াবেটিসে দীর্ঘদিন ধরে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকায় কিডনির নেফ্রনের রক্তবাহী নালী অর্থাৎ গ্লোমেরুলাসে নানা ধরনের পদার্থ জমতে থাকে, যার ফলে গ্লোমেরুলাসে রক্তের চাপ বেড়ে যায় এবং এগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, ফলে রক্তে ইউরিয়া বেড়ে যায়। প্রস্রাবের সাথে অ্যালবুমিন জাতীয় প্রোটিন বেশি পরিমাণে বার হতে থাকে। উচ্চরক্তচাপেও কিডনির গ্লোমেরুলাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিডনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না।
ইনফেকশন বা জীবাণু সংক্রমণও হয় কিডনিতে। স্ট্রেপ্টোকক্কাস হিমোলাইটিকাস জীবাণুর সংক্রমণে টনসিলাইটিস থেকে গেঁটেবাত বা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস থেকে এস.এল.ই নামক জটিল অসুখে নেফ্রোটিক সিনড্রোম হতে পারে।
নেফ্রাইটিস হয়েছে বোঝা যাবে কীভাবে | Nephrotic Syndrome Signs and Symptoms
নানা রকমের উপসর্গ হতে পারে। প্রথমদিকে গলাব্যথা, গাঁটে ব্যথা, জ্বর বা ত্বকে ঘা হতে পারে। ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। মুখ ও শরীর ফুলে যায়। প্রস্রাব কমে যায়। প্রস্রাবের সাথে রক্তও আসতে পারে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। কখনও কখনও প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় উপসর্গ মারাত্মক না হওয়ায় রোগ ধরা পড়ে দেরিতে। এমনকী কিডনি খারাপ হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত ধরা পড়ে না অনেক সময়।
তবে নেফ্রাইটিস বা অবস্ট্রাকটিভ ইউরোপ্যাথি থেকে কিডনির অসুখ প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়। তাই ভয়ের কিছু নেই কিডনি নিয়ে। ডাক্তার দেখিয়ে ঠিকমতো ওষুধ খান। সঠিক চিকিৎসাই আপনাকে ভালো রাখবে।