কিডনি প্রতিস্থাপনের সফলতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলতে হয় কিডনি প্রতিস্থাপন তাদেরই দরকার যাদের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে যে একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেলেই আর একটা কিডনির প্রয়োজন হয়। আসলে কিন্তু তা নয়।
আমাদের শরীরের পক্ষে একটা কিডনি কাজ করলেই যথেষ্ট। কিডনি প্রতিস্থাপন তাদের করা হয় যাদের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন, কিডনি খারাপ হয় কেন? কিডনি খারাপ হওয়ার পিছনে জন্মগত কিছু কারণও থাকে।
যেমন কিডনির গঠন ঠিকমতো না হওয়া। তবে এই ধরনের কোনো অসঙ্গতি থাকলে জন্মাবার পরই বোঝা যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে কিডনি খারাপ হয়।
সাধারণত কিডনি খারাপ হওয়ার পিছনে থাকে অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। এই দুটো জিনিস যদি ঠিক সময়ে ধরা পড়ে তবে ওষুধের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো করা হয় না সেরকম ক্ষেত্রে দেখা গেছে শতকরা আশিভাগ কিডনি নষ্ট হয় শুধুমাত্র ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের কারণে।
দুটো কিডনি যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন তার চিকিৎসা হল— ডায়ালিসিস এবং কিডনি প্রতিস্থাপন।
Table of Contents
ডায়ালিসিস | Dialysis
ডায়ালিসিস হল সাময়িক উপায়। কিডনি নষ্ট হয়ে গেলে শরীরের দূষিত পদার্থগুলো শরীরের মধ্যে জমা হয়। সেই দুষিত বর্জ্য পদার্থগুলোকে বার করে দেওয়া হয় যন্ত্রের সাহায্যে। যার পোশাকি নাম ডায়ালিসিস।
অ্যাকিউট রোগীদের ক্ষেত্রে ডায়ালিসিস করা হয় ততদিন, যতদিন না কিডনি তার কর্মক্ষমতা ফিরে পায় ৷ কিন্তু ক্রনিক রোগীদের ক্ষেত্রে ডায়ালিসিস চালিয়ে যেতে হয় কিডনি প্রতিস্থাপন না করা পর্যন্ত।
ডায়ালিসিস দু’ ধরনের হয়—হিমো ডায়ালিসিস ও পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিস।
হিমো ডায়ালিসিসে একটা আর্টারি আর ভেনকে সার্জারি করে জোড়া লাগানো হয়। যাকে বলে এভি ফিসচুলা। এর মধ্যে দিয়ে শরীর থেকে রক্ত বার করে কৃত্রিম ছাঁকনি অর্থাৎ মেমব্রেন দ্বারা হেঁকে নিয়ে আবার শরীরে ফেরত পাঠনো হয়। রক্ত পাতলা করার জন্য এ সময় হেপারিন দেওয়া হয়। যদিও এটা পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিসের থেকে অনেক বেশি কার্যকরী।
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিমো ডায়ালিসিস করা যায় না। রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল না হলে, ইস্কিমিক হার্ট জিজিজ, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, রক্তচাপ কম, রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যদি থাকলে হিমোডায়ালিসিস করা যায় না। কারণ এতে এক ঝটকায় শরীর থেকে অনেকখানি রক্ত বার করে নেওয়া হয়। ফলে রক্তচাপ কমে যায়, হার্টে চাপ পড়ে এবং হেপারিন দেওয়ার ফলে রক্ত পাতলা হয়ে যাওয়ায় যাদের রক্তক্ষরণের প্রবণতা আছে তাদের নানা সমস্যা দেখা দেয়।
এসব ক্ষেত্রে পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হয়। কারণ এতে হেপারিন দিতে হয় না এবং শরীর থেকে রক্তও বার করা হয় না। এতে একটা নল দিয়ে শরীরের মধ্যে জল পাঠানো হয়, যেটা অনেকটা রক্তের মতোই হয় দেখতে। এই জল রক্তের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে বর্জ্য পদার্থগুলিকে বের করে আনে। কোনও কৃত্রিম মেমব্রেনেরও প্রয়োজন হয় না। পেরিটোনিয়ামের পর্দাই ছাঁকনির কাজ করে।
কিডনি প্রতিস্থাপন | Kidney Transplant or Renal Transplant
ডায়ালিসিস করে শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলোকে বের করে দিতে পারলেও কিডনির অন্যান্য কাজ কিছু করা যায় না। তাই যাদের বয়স ৬০-এর নীচে এবং অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা, হার্টের রোগ, ক্যানসার ইত্যাদি নেই তাদের ক্ষেত্রে কিডনি প্রতিস্থাপন করে নেওয়াই ভালো। কারণ ডায়ালিসিস কখনোই স্থায়ী প্রতিবিধান নয়। স্থায়ী প্রতিবিধান হল কিডনি প্রতিস্থাপন।
আমাদের দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে ১৯৬০ সাল থেকে। যদিও এই কিডনি প্রতিস্থাপন প্রথম দিকে পরীক্ষামূলক ছিল, বর্তমানে কিডনি প্রতিস্থাপন একদম নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী হয়। পৃথিবীর সব দেশেই কিডনি প্রতিস্থাপন দারুণভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছে। যদিও এটা ব্যয়সাপেক্ষ এবং কিডনি পাওয়াও দুষ্কর। তাই ডায়ালিসিসের মতো সাময়িক ব্যবস্থাকে মেনে নিতে হয়।
কিডনি প্রতিস্থাপন করলে একজন মানুষ মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। তবে তাকে সারাজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয় এবং ওষুধগুলো একটু দামিও বটে। এর কারণ একমাত্র যমজ ভাইবোনের কিডনি ছাড়া ১০০% টিস্যু ম্যাচিং অর্থাৎ HLA ম্যাচিং হয় না। তাই এই কারণে ওষুধের প্রয়োজন হয়। এই ওষুধগুলো ইমিউনোসাপ্রেসিভ, যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়, যাতে শরীর প্রতিস্থাপিত কিডনিকে রিজেক্ট না করে। এইসব ওষুধ খাওয়ার ফলে কিন্তু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকখানি কমে যায়। ফলে নানা ধরনের ‘সংক্রমণ সহজেই কাবু করে ফেলে। তবে মনে রাখতে হবে ডায়ালিসেসের চেয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করলে কোয়ালিটি অফ লাইফ অনেক ভালো হয়। এতে কিডনি তার অন্য কাজগুলো যেমন হরমোন উৎপাদনে সাহায্য, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সচ্ছন্দে করতে পারে। বাইরে থেকে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
কিডনি কারা দিতে পারে | Who Can Donate Kidney
কিডনি দিতে পারে পরিবারের লোক। তবে রক্তের মিল থাকা বাঞ্ছনীয়। কিডনি দাতার ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার ও ক্যানসার থাকলে চলবে না। যেকোনো বয়সের মানুষ কিডনি দিতে পারে। ১৮ বছর বয়স থেকে ৬৫ বছর বয়সি মানুষের কিডনি দিতে কোনো অসুবিধা নেই। অবশ্যই বাকি অর্গানগুলো ঠিক থাকতে হবে। যেহেতু একটা কিডনিই যথেষ্ট, তাই প্রতিস্থাপন একটা কিডনিই করা হয়। যিনি দান করবেন তাকেও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হয় কোনো কারণে যাতে তার বর্তমান এবং ভবিষ্যতে ক্ষতি না হয়। তাই কিডনি দাতাকে মেডিক্যালি, সাইকোলজিক্যালি এবং লিগ্যালি দেখে নেওয়া হয়।
১৯৯৪ সালে প্রথম অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট অ্যাক্ট চালু হয়। এই অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট অ্যাক্টে শুধু কিডনি নয়, হার্ট, লাঙস, প্যাংক্রিয়াস এবং চোখ সবই প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। বর্তমানে স্কিন ট্রান্সপ্ল্যান্টও করা হচ্ছে।
সমস্যা
যে পরিমাণ কিডনির প্রয়োজন সেই সংখ্যক – কিডনি পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবার ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে কিডনি পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে। এছাড়া পরিবারে যারা কিডনি দিতে ইচ্ছুক তারা উচ্চ রক্তচাপ ও সুগারের রোগী হলে তাদের কাছ থেকে কিডনি নেওয়া সম্ভবপর নয় । এইরকম সময় ভাবনা আসে তাহলে কে কিডনি দেবে ? সারা পৃথিবীতেই অর্গান ডোনেশন প্রকল্প চলছে। তার মধ্যে মৃত মানুষের দেহ থেকে কিডনি, স্কিন বা অন্য অর্গান নেওয়া শুরু হয়েছে। এখানে ডেডবডি বলতে নট হার্ট ডেথ, ডেডবডি বলতে ব্রেন ডেথ বোঝাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষ, যার ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে, ডাক্তারবাবু যদি সার্টিফাই করেন যে রোগীর ব্রেন ডেথ হয়েছে, রোগীকে বাঁচিয়ে আনা সম্ভব নয়, এরকম মুহূর্তে যদি সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষের বাড়ির লোক রাজি থাকেন তাহলে সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তির শরীর থেকে অর্গানগুলোকে আলাদা করে নেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে মৃত মানুষটির বাড়ির লোকের সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন। Cadaver organ donation নেওয়া হয়। এই ধরনের কেসে যদি হার্ট বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কিন্তু অর্গানগুলো কাজে দেবে না।
সুতরাং ব্রেনডেথ হয়ে গেলে কৃত্রিমভাবে অর্গানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এরপর সমস্ত কিছু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে অর্গানগুলো ব্যবহার করা যাবে। অর্গান নেবার জন্য রোগী তৈরি আছে জেনে ভেন্টিলেটর বন্ধ করে সব অর্গানগুলো হার্ভেস্টিং করা হয়। অর্থাৎ অঙ্গগুলো সংগ্রহ করে পারফিউশন করে বিশেষ ধরনের সল্যুশন দিয়ে ঠান্ডার মধ্যে রাখা হয় এবং যত দ্রুত সম্ভব রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।
অনেকের মনে প্রশ্ন আসে মর্গ থেকে কেন অর্গান সংগ্রহ করা হয় না। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে হার্ট যদি একবার বন্ধ হয়ে যায়, তবে সব অর্গান কয়েক মিনিটের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।
চোখের ব্যাপারটা আলাদা। চোখে রক্ত সঞ্চালন থাকে না। সেই কারণে মানুষ মারা যাওয়ার দু’ ঘণ্টার মধ্যেও চোখ দান করা যায় ।
চোখ ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ মারা যাবার পরে দেওয়া যায় না। কারণ অঙ্গ সবসময় বিটিং হার্টে দিতে হবে।
আগে প্রতিস্থাপন অনেক কম হত। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই প্রতিস্থাপনের ফলাফল ছিল ৫০- ৬০%। ৪০-৫০% ছিল রিজেক্টেবল। বর্তমানে যেসব ওষুধ এসেছে সেগুলো ব্যবহার করার ফলে বাতিলের সংখ্যা শতকরা দশভাগ কমে এসেছে। এই কারণে কিডনি যদি কারো খারাপ হয়ে যায় চিন্তার কারণ নেই। দান করা কিডনি পাওয়া গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের ফলাফল খুবই ভালো।
কিডনি ব্যাঙ্ক বলে কিছু নেই। হয় না। কিডনি কারো থেকে নেবার পর ভালো করে ধুয়ে ঠান্ডা করে আট থেকে দশ ঘণ্টা রাখা সম্ভব। ২০০০ সালের পর থেকে আমাদের দেশে ড্রাগের দাম কম হওয়ার ফলে আগে যেখানে অপারেশনের পরেও মাসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হত ওষুধের ব্যয় হিসাবে, এখন সেটা দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। আর অপারেশনের ছ’-সাত মাস পরে সেটা দশ হাজারের নীচে নেমে আসে। তাই ওষুধ ব্যবহার করার চলটা অনেক সহজ হয়ে গেছে।
দুটো কিডনি নষ্ট হলে যত দ্রুত সম্ভব ডায়ালিসিসে যেতে হবে। ডায়ালিসিসের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রেখে রোগীর সমস্ত পরীক্ষা করিয়ে দাতাকে খুঁজে বার করতে হবে। ডোনেশনে কিডনি পাওয়া গেলে অপেরেশনে কোনো অসুবিধা নেই। অপারেশনের ফল খুবই ভালো এবং অপারেশনের পর যে ওষুধ খেতে হয় সেটাও বেশ সস্তা হয়ে গেছে। বর্তমানে জেনেরিক ড্রাগের প্রচলনে মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা অনেকটাই অনুকুল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিডনি প্রতিস্থাপনের পর রোগীর অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকলে এবং রোগী চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত চেক-আপ করালে ও নিয়ম মেনে চললে সে স্বাভাবিক জীপনযাপন করতে পারে। কিডনি পরিবর্তনের পরে অনেককেই ১৫ বছরের বেশি বাঁচতে দেখা গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর সাধারণত ৪০ শতাংশ মানুষ দশ বছরেরও বেশি সময় সুস্থ থাকেন।