Home স্বাস্থ্য পরামর্শ ব্লাড ক্যান্সারের কারণ ও লক্ষণসমূহ এবং তার আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি | Blood...

ব্লাড ক্যান্সারের কারণ ও লক্ষণসমূহ এবং তার আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি | Blood Cancer | Myeloma | Blood Cancer Symptoms

ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় লিউকোমিয়া, সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ব্লাড-ক্যানসার নামে। লিউকোমিয়া এসেছে ল্যাটিন শব্দ লিউকোস থেকে। যার অর্থ শ্বেতকণিকা এবং মিয়া মনে রক্ত। সাধারণভাবে ক্যানসার মানে কোনো কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। লিউকোমিয়ায় রক্তে অবস্থিত রক্তকণিকার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঘটার জন্যই একে ব্লাড ক্যানসার নামে অভিহিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত হাড়ের মধ্যেই এই মরণ রোগটি ধীরে ধীরে বাড়াতে পারে। এবং একসময় ছিনিয়ে নেয় জীবন। লিউকোমিয়াকে বাগে আনতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেই চলছে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অক্লান্ত গবেষণা। চূড়ান্ত সাফল্য মেলেনি ঠিকই, কিন্তু নিরাময় অনেকটাই এখন হাতের মুঠোয়। সেজন্য অবশ্যই চাই সতর্কতা ও সচেতনতা।

ব্লাড ক্যান্সারের কারণ ?

রক্ত গঠিত রক্তরস এবং রক্তকণিকা দিয়ে। এই রক্তকণিকায় থাকে লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা আর অনুচক্রিকা। লিউকোমিয়ায় শ্বেতকণিকাগুলি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার অনেক সময় রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যাও কমে যেতে দেখা যায়। অতিরিক্ত শ্বেতকণিকা আমাদের কাজে তো লাগেই না, উল্টো ন’নারকম বিপত্তির সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের শরীরে শ্বেতকণিকা তৈরির কতকগুলো ধাপ আছে। এই ধাপগুলির কোনোটাতে গণ্ডগোল হলেই বিপদ, হানা দেয় ভয়ঙ্কর লিউকোমিয়া।

ব্লাড-ক্যান্সারের রকমফের

লিউকোমিয়া সাধারণভাবে দু’রকমের—অ্যাকিউট এবং ক্রনিক। অ্যাকিউট লিউকোমিয়াকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়—অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক এবং অ্যাকিউট মায়োলোব্লাস্টিক। অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিকের আবার তিনটি সাব-টাইপ আছে। L১ থেকে L৩। অ্যাকিউট মায়োলোব্লাস্টিকের M১ থেকে M৭ পর্যন্ত সাব-টাইপ দেখা যায়। ক্রনিক লিউকোমিয়ার ভাগ দুটি- ক্রনিক লিম্ফোটিক এবং ক্রনিক মায়েলয়েড।

ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ

রক্তে অতিরিক্ত শ্বেতকণিকার মধ্যে বেশ কিছু থাকে অপরিণত। অনেক সময় ওই সব অপরিণত শ্বেতকণিকাগুলি পরিণত শ্বেতকণিকার থেকে বেশিদিন বাঁচে। এইসব অপরিণত শ্বেতকণিকাকে বলে ব্লাস্ট সেল। ব্লাস্ট সেল কিন্তু স্বাভাবিক শ্বেতকণিকার মতো রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না। বিপদ শুধু এখানেই নয়, এই সমস্ত ব্লাস্ট সেল নতুন রক্তকণিকা তৈরিতেও বাধা দেয়। ফলে রক্তে যথেষ্ট সংখ্যক লোহিতকণিকা অনুচক্রিকার সংখ্যা হ্রাস পায়। রক্তের অক্সিজেন বহনে সমস্যা দেখা দেয়। রক্ত জমাট বাঁধে না এবং পরিণত শ্বেতরক্তকণিকার অভাবে রোগর্জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা কমে যায়। রোগীর দেহে অ্যানিমিয়ার লক্ষণ দেখা যায়। শরীরে ক্লান্তি অনুভূত হয়। সঙ্গে হাড়ে ব্যথা, গায়ে ব্যথা এবং জ্বরও থাকে। অনেক সময় দাঁতের মাড়ি, নাক প্রভৃতি থেকে রক্ত পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে পায়খানা ও প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়ে।

চামড়ায় স্পট তৈরি হয়। দেহের ওজন হ্রাস পায়, ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য শরীরে ঘন ঘন নানারকম রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন মুখে ঘা, চামড়ায় চুলকানি, নিউমোনিয়া, সেপ্টিসিমিয়া প্রভৃতি। এছাড়া শ্বেতকণিকাগুলি যকৃত এবং প্লীহায় বাসা বাঁধার জন্য গ্ল্যান্ডগুলো বড় হয়ে যায়। 

ব্লাড ক্যান্সার পরীক্ষা

লিউকোমিয়া যেহেতু রক্তের রোগ, তাই রোগ নির্ণয় করতে রক্তপরীক্ষা নিতান্তই জরুরি। পরীক্ষায় যদি দেখা যায়, রক্তে শ্বেতকণিকা একটা নির্দিষ্ট

পরিমাণের থেকে কম বা বেশি, তাহলে সন্দেহ করা হয় লিউকোমিয়ার। রক্তে ব্লাস্ট সেল দেখা যাচ্ছে কি না এবং রক্তে হিমোগ্লোবিন কম আছে কি না তাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। এছাড়া রক্তের TC, DC, অনুচক্রিকা-সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষাও করা হয়। এই সমস্ত পরীক্ষার পর বোনম্যারো করে নিশ্চিত হওয়া যায়। সম্প্রতি কিন্তু অত্যাধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে কী ধরনের লিউকোমিয়ায় রোগী আক্রান্ত, তা খুব দ্রুত এবং নিশ্চিতভাবে জানা যায়। পরীক্ষাগুলি হল—ক্রোমোজোম স্টাডি, মার্কার স্টাডি প্রভৃতি। অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়ার ক্ষেত্রে বি-সেল, টি-সেল ইত্যাদি স্টাডি করা হয়।

blood cancer

ব্লাড ক্যান্সার কিভাবে হয় ?

লিউকোমিয়া বংশগত নয়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, লিউকোমিয়৷ আক্রান্ত রোগীর পরিবারের কারোর কারোর অন্য ধরনের ক্যান্সার আছে তবে বাবা-মা কারোর লিউকোমিয়া হলেই যে সন্তানের লিউকোমিয়া হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিছু ক্ষেত্রে জিনগত সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে। তবে তা গবেষণার পর্যায়েই রয়ে গেছে। রোগী চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাবার পর ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এমনকি বিবাহও করতে পারেন। পরে যদি লিউকোমিয়া ধরা পড়ে, তবে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী সন্তান নেওয়া উচিত। গর্ভে সন্তান এসে যাবার পর যদি মায়ের এই রোগ ধরা পড়ে, তবে গর্ভস্থ সন্তান দু তিন মাসের হলে তাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। আর সন্তান পাঁচ মাসের হয়ে গেলে তাকে রাখার চেষ্টাই করা হয়।

 ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার ও তার প্রতিরোধের উপায়

রোগের সঠিক কারণ এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তাই সম্পূর্ণ রোগ প্রতিরোধ করা কার্যত অসম্ভব। অবশ্য দেখা গেছে, যাঁরা রেডিওলজিস্ট, নিউক্লিয়ার গবেষণাগারে বা নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে কাজ করছেন অর্থাৎ যাঁদের দেহে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রবেশের সম্ভাবনা আছে, তাঁদের এই রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে বেশি। হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর অনেকেই এই রোগে দীর্ঘকাল ভূগে মারা গেছেন। তাই যাঁরা ঐসব কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের উচিত নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা এবং দেহে যাতে যতটা সম্ভব কম তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রবেশ করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া।

এদেশে লিউকোমিয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। অবশ্য রোগটা আগেও ছিল। এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে দ্রুত রোগ নির্ণয়ের ফলেও রোগীর সংখ্যা বেশি দেখাচ্ছে। শিশুদের ক্যানসারের মধ্যে কিন্তু লিউকোমিয়াই প্রধান। আশার কথা শিশুদের রোগ প্রায় সম্পূর্ণই সেরে যায়। তাই শিশুদের মধ্যে ন্যূনতম লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসার সুযোগ নেওয়া প্রয়োজন। সুতরাং প্রাথমিক লক্ষণ চেনা বা জানা বিশেষ করে প্রত্যেক শিশুর বাবা-মায়ের খুবই প্রয়োজন।

অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকোমিয়৷

সাধারণত এক থেকে বারো বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই এই ধরনের লিউকোমিয়া বেশি দেখা যায়। বয়স্কদেরও হয়, তবে তুলনায় অনেক কম এই রোগে শ্বাসকষ্ট থাকে। যকৃত, প্লীহা প্রভৃতি বড় হয়ে যায়। অনেক সময় ফুসফুসের পেছনে মাংসপিণ্ডও গঠিত হয়। রক্তে ব্লাস্ট সেলের পরিমাণ বেশি থাকায় রোগীরা খুবই অসুস্থ হয়ে থাকে। ছোটদের এই রোগ হলে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যায়। এজন্য প্রায় তিন বছর টান চিকিৎসার প্রয়োজন। চিকিৎসার পর বাড়ি গিয়ে রোগী পাঁচ থেকে দশ বছর সুস্থভাবে বেঁচে থাকলে দেখা যায় এদের মধ্যে শতকরা ৫০ জনই সম্পূর্ণ সুস্থ, আর পাঁচটা শিশুর মতোই খেলাধুলো করতে পারছে, এমনকি স্কুলেও যেতে পারছে। অন্যান্যদের

মধ্যে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন অর্থাৎ স্কুলে যেতে পারে, খেলাধুলোও করতে পারে।

চিকিৎসা শুরুর সময় বিশেষত ছোটরা খুবই অসুস্থ থাকে, তাই টানা তিনমাস হাসপাতালে রেখেই সাবধানে চিকিৎসা করতে হয়। রক্ত পরিবর্তনের দরকার হয় না। প্রথমে কেমোথেরাপির সাহায্যে রক্তে অবস্থিত দুষ্ট কোষগুলোকে মেরে ফেলা হয়। এরপর রক্তে স্বাভাবিক ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। এইভাবেই রক্ত একসময় স্বাভাবিক হয়েও যায়। তবে এই চিকিৎসার সময় রোগীকে রক্ত দিতে হয়। একে বারে পাঁচ-দশ থেকে শুরু করে ত্রিশ ইউনিট পর্যন্ত রক্ত দিতে হতে পারে। রক্ত দেবার সময় রক্ত থেকে অনুচক্রিকাগুলি বের করে নেওয়া হয়। লিউকোমিয়ার দুষ্ট কোষ আমাদের মস্তিষ্কেও পৌঁছে যেতে পারে। তাই একই সঙ্গে মস্তিষ্কে এই কোষের প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য বিশেষ

চিকিৎসা করা হয়। মস্তিষ্কে রোগ ছড়ানো বন্ধ করতে এবং ছড়িয়ে থাকলে কোষগুলিকে মেরে ফেলার জন্য ইনট্রাথিক্যাল এবং ক্রেনিয়ালইরাডিয়েশন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। প্রথম পদ্ধতিতে শিরদাঁড়া দিয়ে ইঞ্জেকশন করা হয়। এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিতে মস্তিষ্কে রে দেওয়া হয়। প্রথম তিনমাস হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার পর রোগী বাড়ি চলে যেতে পারে। তারপর হাসপাতালের আউটডোরেই চিকিৎসা করা হয়। তিন বছরে এই চিকিৎসার খরচ ন্যূনতম তিন’ থেকে চার লক্ষ টাকা। যা অবশ্যই সাধারণ মানুষের আয়ত্ত্বের প্রায় বাইরে। কিন্তু উপায় কী!

অ্যাকিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকোমিয়া 

পরিণত বয়সেই এই ধরনের লিউকেমিয়া বেশি হয়। ছোটদেরও হয়, তবে অনেক কম। এই ধরনের লিউকেমিয়া খুব খারাপ। খুব ভালো চিকিৎসা করেও এখনও পর্যন্ত ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি সাফল্য পাওয়া যায়নি। কেমোথেরাপি দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা করলে প্রাথমিকভাবে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি রোগটির পুনরাক্রমণ ঘটে। অর্থাৎ দু’-এক বছর সুস্থ থাকার পর এরা আবার চিকিৎসার জন্য ফিরে আসেন। তবে নতুন করে চিকিৎসা করে আর লাভ হয় না। অবস্থা ক্রমশ খারাপ দিকে যেতে থাকে। ওষুধে কাজ হয় না, ইনফেকশন হয়, হয় সেপ্টিসিমিয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত পড়ে। গায়ে ঘা হয়। অবশেষে রোগীর মৃত্যু হয়। এই ধরণের লিউকোমিয়ার একমাত্র চিকিৎসা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই বোন ম্যারো

চিকিৎসা। খরচ দশ বারো লক্ষ টাকা। চিকিৎসার প্রয়োজনে রোগীকে মাস দুয়েক হাসপাতালে থাকতে হয়। তারপর বোন ম্যারো পরিবর্তন সফলভাবে করা গেলে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। এই ধরনের চিকিৎসার জন্য রোগীর ভাই-বোন থাকা একান্ত প্রয়োজন। সব থেকে ভালো যমজ ভাই বোন। 

চিকিৎসায় প্রথমে রোগীর খারাপ বোন ম্যারো সরিয়ে ফেলা হয়। তারপর ভাই বা বোনের বোন ম্যারোর সঙ্গে রোগীর এইচ. এল. এ. টাইপিং এবং টিস্যু টাইপিং মিললে তবেই সেই বোন ম্যারো রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। রোগীর শরীরের লিউকোমিয়া আক্রান্ত সেলকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে তবেই অবশ্য নতুন বোন ম্যারো রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। একে বলে আলোট্রান্সপ্ল্যান্ট। যদি ভাই-বোন না থাকে বা ভাই-বোনের সঙ্গে টিস্যু টাইপিং না মেলে, তাহলে অটো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। এই পদ্ধতিতে রোগীর শরীর থেকে লিউকোমিয়া কোষগুলোকে মেরে ফেলে তারপর ভালো কোষ তৈরি হলে রোগীর দেহ থেকে বোন ম্যারো বার করে নিয়ে তাকে ফ্রিজ করা হয়। তারপর ওই সুস্থ বোন ম্যারোকে রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। এটাই লিউকোমিয়ার চিকিৎসার সর্বাধুনিক পদ্ধতি।

কলকাতাতেও কিছুদিন হল এই চিকিৎসা শুরু হয়েছে। তবে বিদেশে এই চিকিৎসার সাফল্য শতকরা ৭০-৮০ ভাগ হলেও এদেশে এই সাফল্যের হার শতকরা ৪০-৫০ ভাগ। বোন ম্যারো পরিবর্তন করার সময় বেশ কিছু রোগীর মৃত্যুও ঘটে। তবে সাফল্যের সঙ্গে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা গেলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। এছাড়াও বর্তমানে স্টেম সেল এবং কর্ড ব্লাড সেল ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমেও এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। এই দুটি প্রতিতে চিকিৎসার খরচ অনেক কম। লিউকোমিয়া নিরাময়ের জন্য যত রকম চিকিৎসা আছে তার মধ্যে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের খরচই সর্বাধিক।

ক্রনিক লিম্ফোটিক লিউকোমিয়া

এই ধরনের লিউকোমিয়ায় রক্তে ব্লাস্ট সেল কম দেখা যায়। বেশিরভাগই পরিণত শ্বেত রক্তকণিকা থাকে। তাই রোগী এই রোগে আক্রান্ত হলেও অনেক কম অসুস্থ থাকে। তবে যকৃত, প্লীহা এবং শরীরের বিভিন্ন গ্ল্যান্ডের বৃদ্ধি ঘটতে দেখা যায়। এই লিউকোমিয়ায় ০–৪ এই পাঁচটি পর্যায় আছে। রোগী কোন পর্যায়ে আছে, সেই অনুযায়ী চিকিৎসা হয়। শূন্য এবং এক পর্যায়ে থাকা রোগীরা চিকিৎসা ছাড়াও পাঁচ থেকে দশ বছর সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কেউ কেউ কুড়ি বছরও ভালো থাকে। তবে রোগীর ওপর নজর রাখতে হয়। যদিও রোগীরা সাধারণ চিকিৎসাতেই ভালো থাকে, তবে এই রোগ কখনোই সম্পূর্ণ সারে না। ওষুধ দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। রোগটা খারাপের দিকে গেলে রোগী খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনিতে রোগী সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে। বোনম্যারো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।

ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকোমিয়া

এই ধরনের লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের শতকরা ৯৫ ভাগের ক্ষেত্রেই ক্রোমোজোমে ত্রুটি দেখা যায়। যেহেতু এই রোগ ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে হয় তাই এই রোগ চিকিৎসায় ভালো হবার সম্ভাবনা কম। এই রোগে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ রোগীরই প্লীহা বড় হয়ে যায়। সাধারণত দেখা গেছে, এই ধরনের রোগীরা চিকিৎসাতে দু’- তিন বছর ভালো থাকে, কিন্তু তারপরই এটি অ্যাকিউট লিউকোমিয়ায় পরিবর্তিত হয়।

বর্তমানে এই রোগের একটি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। বায়সাপেক্ষ এই চিকিৎসা-পদ্ধতিতে ওরাল কেমোথেরাপির সঙ্গে এন্টারফেরোন  প্রয়োগ করা হয়। ইন্টারফেরোন প্রয়োগ করলে রোগী পাঁচ থেকে আট বছর ভালো থাকে। আর না করলে বড় জোর তিন-সাড়ে তিন বছর রোগী সুস্থ থাকে। তবে খুব দ্রুত বোন ম্যারো পরিবর্তন করা সম্ভব হলে এই রোগ সারানো সম্ভব হয়। নচেৎ ইন্টারফেরোন- প্রয়োগ করে কেবল রোগীর আয়ুষ্কাল বাড়ানো যায়।

রক্ত পরিবর্তন করা কতটা প্রয়োজন ?

লিউকোমিয়া যেহেতু রক্তের রোগ তাই অনেকের ধারণা, এই রোগে বুঝি শুধু রক্ত পাল্টানো হয়। এ ধারণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে রক্তের স্বাভাবিক উপাদান স্থির রাখার জন্য মাঝে মাঝে রক্ত দিতে হয়। বারবার রক্ত দেবার জন্য, বিশেষ করে ছোটদের গলা দিয়ে হার্টের ভেতরে ছ’মাসের জন্য ক্যাথিটার (দাম ছ’ সাত হাজার টাকা) ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে সেন্ট্রাল লাইন। এই লাইনের মাধ্যমে গায়ে সুচ না ফুটিয়েই শরীরে রক্ত দেওয়া হয়। সুচ ফুটিয়ে রক্ত দেওয়া হলে বারবার রক্ত দিতে দিতে রক্ত দেবার জায়গাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তখন অন্য জায়গা খুঁজে বের করে রক্ত দিতে হয়।

মানসিক প্রস্তুতি

লিউকোমিয়ার রোগীদের বাঁচার ইচ্ছা, রোগের সঙ্গে লড়াই করার ইচ্ছাটা বড় কথা। চিকিৎসার পাশপাশি সেই ইচ্ছাটাই জাগিয়ে তুলতে হবে রোগীর মধ্যে তাই লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে তার রোগ সম্বন্ধে আগেই জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশে এধরনের কেসে রোগীকে সব বলে দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও রোগীকে সব জানানোর ব্যবস্থা করা উচিত। তবে ছোটদের এটা জানানো হয় না। তার পরিবর্তে তার বাবা-মাকে রোগ সম্বন্ধে জানানো হয়। এমনও হতে পারে, রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম সেক্ষেত্রেও রোগীকে সব কিছু জানানো উচিত। কারণ তাঁর কিছু শেষ ইচ্ছা থাকতে পারে বা তিনি প্রয়োজনীয় উইলও করতে পারেন। এছাড়া এই রোগের চিকিৎসা এত জটিল যে, রোগীর সক্রিয় সাহায্য না পাওয়া গেলে চিকিৎসা করাই সম্ভব নয়। সেজন্যও রোগীকে রোগ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানানো  দরকার।

লিউকোমিয়ার চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল। আমাদের মতো গরিব দেশে সবার যথাযথ চিকিৎসা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বেশিরভাগ ওষুধ বিদেশী, সরকারকে উচ্চ ট্যাক্স দিতে হয়। ফলে ওষুধের দামও খুব বেশি হয়। সেজন্য ডাক্তারবাবুদেরও কিছু করার থাকে না। তাই এদিকে সরকারের নজর দেওয়া দরকার। বর্তমানে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই ধরনের ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ আংশিক হলেও মেটাতে এগিয়ে এসেছেন। তাদের সাহায্য নিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করে এবং আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহৃদয় ব্যক্তিদের সাহায্যে গরিবরাও কিছু পরিমাণে এই রোগের চিকিৎসা করাতে পারেন।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version