ক্যানসার হল এক ধরনের টিউমার। টিউমার বা অর্বুদ হল কোষ-গুচ্ছ, যারা বেড়ে ওঠে তাদের আপন খেয়ালে, তাদের জন্মদাতা কোষগুলোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে। ক্যানসার শরীরের একটি স্থানে থেমে থাকে না। লসিকা, শিরা, ধমনীর মধ্যে দিয়ে তা পৌঁছে যায় শরীরের অন্যত্র। যাকে বলে মেটাস্ট্যাটিস। তবে বায়োপসি করালে ক্যানসার বেড়ে যায়— এ ধারণাটা ভ্রান্ত। ক্যানসারের ধরন এবং তার সঠিক চিকিৎসার জন্য বায়োপসি করানোটা বরং অত্যন্ত জরুরি। ক্যানসার ছোঁয়াচে নয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বংশগত। বংশগত ত্রুটির জন্য রক্তের ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকলে ক্যানসারের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
ক্যানসারের চিকিৎসাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়—সার্জারি, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি। স্টেজ ওয়ানে থাকলে রোগের প্রথম এবং প্রধান চিকিৎসা অবশ্যই সার্জারি বা অস্ত্রোপচার। শরীরের যে অংশে ক্ষতিকর গ্রোথ দেখা যাচ্ছে, সেই অংশটিকে কেটে বাদ দিয়ে দিলেই রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবে। এই স্তরটিতে ক্যানসার থাকলে তা সারার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ।
দ্বিতীয় স্টেজে থাকাকালীন সারার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ ভাগ। এই পর্যায়ে খানিকটা অস্ত্রোপচার এবং খানিকটা ‘রে’ বা রশ্মি দিয়ে আক্রান্ত অংশ পুড়িয়ে রোগ নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়। সাফল্যের সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি।
তবে তৃতীয় স্টেজে অস্ত্রোপচারে খুব একটা সাফল্যে পাওয়া যায় না। রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপি করে শেষ চেষ্টা চালাতে হয় চিকিৎসকদের। সত্যি কথা বলতে কী, তৃতীয় স্তরটি হল অ্যাডভান্স স্টেজ। রেডিয়েশনের ওপরও যখন আর নির্ভর করা যায় না তখন ডাক্তারদের আশ্রয় নিতে হয় কেমোথেরাপির। কেমোথেরাপি হল ওষুধ ও ইঞ্জেকশনের প্রয়োগ।
আর চতুর্থ স্তরে রোগ অনেকটাই চিকিৎসকদের হাতের বাইরে চলে যায়। সে সময় কেমোথেরাপির মাধ্যমেই রোগীকে সারাবার এবং রোগের প্রকোপ খানিকটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। তবে কেমোথেরাপির প্রয়োগের পরেও যদি টিউমারের আয়তন না কমে, সেক্ষেত্রে সার্জারির আশ্রয় নিয়ে টিউমারটিকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে নানা ধরনের কেমোথেরাপির সাহায্যে চিকিৎসা চলছে।
সিসপ্ল্যাটিন, এন্ডকসন, ক্লোরামবিডসিল মেথোট্রেফসেট, থায়োটিপা ইত্যাদি ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। কেমোথেরাপি করেও অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার কেমোথেরাপিতে সাময়িক নিরাময়ের ব্যবস্থা করলেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয় না।
এখন প্রশ্ন, ক্যানসার রোগের পক্ষে কেমোথেরাপি কতখানি কার্যকর ভূমিকা নেয়? এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে কোন ধরনের ক্যানসার, রোগের অবস্থান এবং কী জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হবে তার ওপর। সাধারণত কেমোথেরাপি নেওয়ার পর রোগীর তিন রকম অবস্থা দেখা যায়। এক, রোগের প্রকোপ হ্রাস করে। দুই, রোগের সংক্রমণ কমিয়ে দেয়, রোগীকে দীর্ঘজীবী হতে সাহায্য করে। তিন, রোগের ওপর কোনোরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে না।
কেমোথেরাপি নেবার জন্য রোগীকে নার্সিংহোম বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তবে সেটা দীর্ঘদিনের জন্য নয়।
আবার প্রশ্ন আসে, রোগীকে কেন কেমোথেরাপি বারবার নিতে হয় ? সাধারণ রোগে ওষুধ যেমন বারবার খেতে হয়, কিছু ক্ষেত্রে রোগ কমে গেলেও কোর্স কমপ্লিট করার জন্য ওষুধ কিছুদিন খেয়ে যেতে হয়, কেমোথেরাপি ঠিক একইরকম। তবে রোজ নিতে হয় না। নির্দিষ্ট সময় অন্তর রোগের অবস্থা বুঝে কারো ক্ষেত্রে তিনটে সাইকেল, কারোবা ছ’টা সাইকেল ব্যবহার করতে হয়।
Table of Contents
![কেমোথেরাপির সাইড ইফেক্ট | Chemotherapy Side Effects 1 Chemotherapy Side Effects](http://banglaobangali.in/wp-content/uploads/2023/10/Chemotherapy-1024x683.jpg)
কেমোথেরাপি নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া | Side Effects After Chemotherapy
কেমোথেরাপি নেবার পর প্রতিটি রোগীরই যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবেই, সে বিষয়ে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কারণ কেমোথেরাপির ওষুধ শুধুমাত্র যে ক্যানসার আক্রান্ত কোষ বা সেলগুলির ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীরের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কোষের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে রোগীর দেহে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে শরীরের সাধারণ কোষগুলির পুনর্গঠন ক্ষমতা এত বেশি যে তারা খুব তাড়াতাড়ি পুনর্গঠিত হয়। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয় না। খুব অল্প ক্ষেত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয়। হলে রোগীর দেহে ক্ষতিসাধনও করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে একজন দক্ষ চিকিৎসক সুনির্দিষ্ট মতামত দিতে পারেন সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য।
এখন দেখা যাক কেমোথেরাপি নেবার পর রোগী কোন জাতীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়—
- গা বমি বমি ভাব বা বমি করা।
- চুল উঠে যাওয়া।
- রক্তাল্পতার জন্য দুর্বলতা।
- সংক্রমণ।
- পাতলা পায়খানা বা কোষ্ঠকাঠিন্য।
- যৌন ক্ষমতার ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
- ত্বক ও নখের সমস্যা।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা | How to Manage the Side Effects of Chemotherapy
গা বমি বমি ভাব
রোগী যদি বমি করে তাহলে একসাথে অনেকটা পরিমাণ খাওয়া চলবে না, অল্প অল্প করে বারে বারে খেতে হবে। ভারী কোনো কিছু খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বা পরে জল খাওয়া দরকার। ভাজাভুজি কিংবা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া চলবে না। যেকোনো খাবার ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে। রোগীকে মাঝে মাঝে বরফের টুকরো চুষতে দিতে পারেন। যেকোনো রকম অস্বস্তিকর গন্ধ থেকে রোগীকে দূরে রাখুন। রোগীকে ঢিলে ঢালা পোশাকে অভ্যস্ত করান। রোগীকে পছন্দমাফিক কাজ করতে দিন।
কেমোথেরাপি নেবার সময় যেসব রোগীর বমি শুরু হয় তাদের কেমোথেরাপি নেবার পাঁচ- ছ’ ঘণ্টা আগে থেকে কিছু না খাওয়াই ভালো।
চুল উঠে যাওয়া
কেমোথেরাপির পর সাধারণত রোগীর চুল উঠে যায়। কিন্তু কেমোথেরাপির কোর্স শেষ হওয়ার পর আবার নতুন চুল গজাতে শুরু করে। এই সময় হালকা শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। চুলে রং করা কিংবা হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করাই ভালো। চুল ছোট করে ফেলা ভালো। সূর্যের তাপ থেকে মাথাকে রক্ষা করার জন্য মাথায় একখন্ড কাপড় বা বড় রুমাল বাঁধা উচিত।
রক্তাল্পতার জন্য দুর্বলতা
রক্তাল্পতার কারণে দুর্বলতা অনুভব করলে রোগীকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবরকম কাজকর্ম বিশেষ করে অতিরিক্ত পরিশ্রম বন্ধ করতে হবে। রক্তাল্পতা দূর করতে সুষম খাদ্য খেতে হবে।
সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পেতে
সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পেতে হাত সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সংক্রামিত ও অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। রোগীকে অতি অবশ্যই জনবহুল জায়গা পরিত্যাগ করতে হবে।
কেটে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া বা অন্য কোনোভাবে যাতে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি না হয় তার দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। এছাড়া নখ কাটা, দাড়ি কাটা, ধারালো যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করা, দাঁত মাজা প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হতে হবে। কোনো কারণে শরীরের কোথাও যদি ক্ষত সৃষ্টি হয়, তাহলে তা দ্রুত পরিষ্কার করে সংক্রমণরোধক ওষুধ লাগাতে হবে। স্নানের জন্য অল্প উষ্ণ জল ব্যবহার করা দরকার।
যদি রোগীর ত্বক বেশি শুকনো, খসখসে মনে হয়, তাহলে রোগীকে ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করতে দিন। চিকিৎসকের অনুমতি ব্যতীত টীকা বা ভ্যাকসিন জাতীয় কোনোরূপ রোগ প্রতিষেধক ব্যবহার করা উচিত নয়।
মুখের ভিতরটা সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং দাঁতের কোনো সমস্যা থাকলে দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পায়খানা
কেমোথেরাপির পর পাতলা পায়খানা যদি অনেকবার হয় তবে চিকিৎসককে জানানো প্রয়োজন। পায়খানা বেশি হলে দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার ত্যাগ করতে হবে। পাতলা পায়খানার কারণে শরীরে জলের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে। সেইজন্য বেশি পরিমাণে জল বা তরল খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এছাড়া কলা, কমলালেবু, আলু জাতীয় খাবার খেলে পটাশিয়াম লবণের ভারসাম্য ঠিক থাকে। এই সময় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পাতলা পায়খানা বন্ধ করতে কোনও ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
কেমোথেরাপির পর কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। কারণ কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য মলদ্বারে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিলে বেশি করে তরল খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন ফল ও সেদ্ধ সবজি খেতে হবে। পাশাপাশি ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।
নখ বা ত্বক
কেমোথেরাপির পর নখ-বা ত্বকে জ্বালা-যন্ত্রণা, চুলকানি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দাড়ি কামাবার পর গালে কোনো সুগন্ধি লোশন ব্যবহার না করাই ভালো । থালা-বাসন ধোওয়া বা বাগান করতে হলে গ্লাভস পরে নেওয়া উচিত।
Flu
কেমোথেরাপি নেবার কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন বাদে রোগীর শরীরে Flu-র মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ রোগী পেশির যন্ত্রণা, অল্প জ্বর, শীতশীত ভাব, খিদে কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ অনুভব করতে পারেন। – এই সমস্ত বিষয় চিকিৎসককে জানানো উচিত। তাহলে তিনিই বলতে পারবেন ওটা ওষুধের উপসর্গ কি না।
যৌন ক্ষমতার ওপর প্রভাব
কেমোথেরাপি নেবার পর নারী কিংবা পুরুষের যৌন অভ্যাসের পরিবর্তন হতে পারে। তবে মহিলাদের যৌন ক্ষমতার ওপর কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একটু বেশি পরিমাণে দেখা যায়। পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় বা পরিমাণ কম হয়।
পিরিয়ড বন্ধ হওয়া মহিলাদের শরীরে যেসব উপসর্গ সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনই হয়। শরীরে গরম বোধ হয়, শরীরের চুলকানি বা জ্বালাভাব, যোনিপথের শুষ্কতার জন্য সঙ্গমে কষ্ট অনুভব ইত্যাদি। এমনকী জনন ক্ষমতাও হ্রাস পায়। কেমোথেরাপি চলাকালীন নারী বা পুরুষের প্রজননে অংশ না নেওয়াই ভালো। গর্ভবতী কোনো নারীকে কেমোথেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন হলে সন্তান ভূমিষ্টের পর কেমোথেরাপি প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়।
কেমোথেরাপি নেবার সময় সঙ্গম-ইচ্ছা ব্যাহত হয়। অনাসক্তি আসে। এর প্রধান কারণ দুরারোগ্য ক্যানসার ব্যাধির জন্য আসন্ন মৃত্যুজনিত ভয়। এবং শারীরিক কষ্ট সঙ্গম-ইচ্ছাকে দূরে রাখে।
এত সব সত্ত্বেও ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি নেবার অবশ্যই প্রয়োজন হয় ক্যানসারের জটিলতা থেকে দূরে থাকতে। শুধুমাত্র ওষুধ বা সার্জারি কিংবা রেডিওথেরাপি সব ক্যানসারকে ভালো করতে পারে না। কেমোথেরাপিরও গুরুত্ব অপরিসীম। রোগটি ধরা পড়ার পর সমস্ত পরীক্ষা করে চিকিৎসা পদ্ধতি স্থির করা হয় কতটা সার্জারি, কতটা কেমোথেরাপি এবং কতটা রেডিওথেরাপি লাগবে। এ বিষয়ে একজন দক্ষ ক্যানসার চিকিৎসকের মতামতই শেষ কথা।
কেমোথেরাপি চিকিৎসা করার সময় রোগীকে যে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা সত্যিই কষ্টকর। তাই এই সময় রোগীর বাড়ির লোক এবং বন্ধুরা পাশে থাকুন, উৎসাহ দিন যা একজন ক্যানসার রোগীর কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।