Home পারম্পরিক ঔষধি ঘরোয়া প্রতিকার কৃমি দূর করার উপায় | কৃমির ঔষধ | Roundworm | Hookworm |...

কৃমি দূর করার উপায় | কৃমির ঔষধ | Roundworm | Hookworm | Pinworm | Tapeworm

খোকন মণ্ডল, বয়স চার। বাড়ি হাওড়ার এক অখ্যাত গ্রামে। বাবা রাজমিস্ত্রী অভাবের সংসার। পাঁচ-ছটি খাবার লোক। তবুও বাবা ও মায়ের চেষ্টার ত্রুটি নেই। ছোট্ট খোকনের জন্য সাধ্যমতো খাবার যোগানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু খোকনের চেহারা বয়সের সঙ্গে মোটেই বাড়ছে না। প্রায়ই পেটখারাপ আর পেটে ব্যাথা। সর্দি-কাশিরও শেষ নেই। কেমন যেন ঝিমিয়ে থাকে সারাক্ষণ। তবে খুব খেতে চায়— সবসময়ই তার খিদে। দামী খাবার না হলেও পেট ভরার মতো খাবার ও পায়। তবুও দিন দিন কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে। পেটটা বড় হয়ে যাচ্ছে, হাত পা গুলো সরু সরু।ইদানীং রাতেও চোখে ভালো দেখতে পাচ্ছে না। খোকনের বাবা গ্রামের বড় গুনিনের কাছে ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন। একে এক দুষ্টু প্রতিবেশী ‘বাণ’ মেরেছে। সেই ‘বাণ’ তুলতে হবে। তার জন্য ভালোই খরচাপাতি আছে। খোকনের বাবা ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। সমস্যা থেকে উদ্ধার করল গ্রামের নবজাগরণ সঙ্ঘের কিছু উৎসাহী তরুণ। তাদেরই পরামর্শ আর সাহায্যে খোকনকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হল। পরীক্ষা করেই ডাক্তারবাবু বললেন– “আরে এর পেটে তো কৃমি ভর্তি। শরীরটা বাড়বে কী করে? যা খায় তার অর্ধেকই তো কৃমিগুলোর পেটে যাচ্ছে। একেই তো যে পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ থাকা দরকার খোকনের খাবারে সেই পরিমাণ নেই। যেটুকু থাকে তাও কৃমির উৎপাতে শরীরে ঢোকে না। তাই রাতকানা রোগও হয়েছে। একে কৃমির ওষুধ দিতে হবে। তবে তার আগে একবার পায়খানা পরীক্ষা করিয়ে নিলে ভালো হয়”। পায়খানা পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা গেল—ডাক্তারবাবু যা বলেছিলেন ঠিক তাই। রিপোর্টে অসংখ্য গোলকৃমির ডিম পাওয়া গেছে। ডাক্তারবাবুর উপদেশ মতো খোকনকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো হয়। তারপর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে খোকনের পায়খানার সঙ্গে ছোট বড়-মাঝারি মিলিয়ে প্রায় গোটা কুড়ি কৃমি পড়ল। এরপর থেকে সে অনেকটাই সুস্থ। চেহারায় জৌলুস এসেছে, ছটফটে হয়েছে। রাতের কম আলোয় বই পড়তে এখন তার কোনো অসুবিধা হয় না। পেট ব্যথার কষ্টও আর সেরকম নেই। 

নাজিরগঞ্জের ছোট্ট মেয়ে সামিনা’-কে নিয়ে ওর বাবা-মা খুব ঝামেলায় পড়েছিলেন। বছর খানেক ধরেই লক্ষ্য করছিলেন সামিনা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। অথচ গায়ের রং ছিল বেশ ময়লা। ইদানীং যেন ফর্সা হয়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে পাড়ার মেয়েরা হাসাহাসি করছিল। সামিনার মা রসিনাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, তোর ফর্সা মেয়ের ভালো জামাই হবে। কিন্তু বললে কী হবে, সামিনা কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ছিল আস্তে আস্তে। ছোটাছুটি, খেলাধুলো করতে পারে না। একটু দৌড়োলেই হাঁপিয়ে পড়ে, বলে বুক ধড়ফড় করছে। চোখমুখ, গাঁ-হাত-পা কেমন যেন ফোলা ফোলা। রসিনা পাড়ার ডাক্তারের কাছে সামিনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেখে বললেন—“এর তো সাংঘাতিক অ্যানিমিয়া। খুব তাড়াতাড়ি কোনো হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। দরকার হলে রক্ত দিতেও হবে। রসিনা পরদিনই হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আউটডোরে ডাক্তারবাবুরা দেখেই ওকে ভর্তি করে নেন। ডাক্তারবাবুরা জানালেন, ওর শরীরে রক্ত খুব কমে গেছে। দু-একদিনের মধ্যেই ওকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে আরও জানা গেল যে রক্ত কমে যাওয়ার কারণ ওর অন্ত্রের মধ্যে ‘হুক ওয়ার্ম’-এর সংক্রমণ হয়েছে। পায়খানা পরীক্ষা করে এই কুমির ডিম খুঁজে পাওয়া গেছে। হাজার হাজার কৃমি ছোট সামিনার পেটের ভেতর ঢুকে তার রক্ত শুয়ে খাচ্ছিল। এক বোতল রক্ত দেওয়া হল। সেইসঙ্গে হুক ওয়ার্মের ওষুধ এবং ভিটামিন, আয়রন দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সামিনা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এল। এখন সে রোজ বন্ধুদের সঙ্গে এক্কা- দোক্কা আর বুড়ি-বসন্ত খেলে। তার আর হাঁফ ধরে না, বুক ধড়ফড় করেনা। তবে হ্যাঁ, ফর্সা রঙের বদলে তার গায়ের রঙ এখন আবার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

সুফল বাগ্‌দির ছেলে নিতাই-এর কুমির অসুখটা প্রথমে তো বুঝতেই পারা যায়নি। দশ বছরের স্বাস্থ্যবান ছেলে হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। মুখ দিয়ে ফ্যানা বেরোতে আরম্ভ করে আর হাত-পা খিঁচতে থাকে। গ্রামের ডাক্তারবাবু তো মৃগী সন্দেহ করে তার চিকিৎসাও শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিন-চার মাসে কোনো ফল না মেলায় তিনি নিতাইকে হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগে দেখাতে পরামর্শ দেন। সেখানে সি.টি. স্ক্যান করে দেখা গেল নিতাইয়ের মাথার ভেতর বাসা বেঁধেছে কৃমির লার্ভা। খুব সম্ভবত ভালোভাবে রান্না না করা শুয়োরের মাংস খাবার ফলে এই কৃমি শরীরে ঢুকে রাক্তের সঙ্গে ভেসে গিয়ে মাথায় আটকে পড়েছে। হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ভর্তি রেখে চিকিৎসার ফলে নিতাই এখন অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু মাঝে মাঝে ঐ খিঁচুনির ব্যাপারটা এখনও আছে। ডাক্তারবাবুরা বলেছে। এটা ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যেতে পারে। যদি একান্তই না কমে তবে অপারেশনের কথা ভাবা হবে সেই অপারেশন অনেক জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ সবজায়গায় হয়ও না। সুবল ছেলের জন্যে খুব চিন্তায় আছে।

যে কোনো ডাক্তারবাবুর কাছেই রোজ মৌমিতা, শ্রমণা, সায়ন, শুভদীর মতো অনেকেই আসে প্রায় এই সমস্যা নিয়ে। সন্ধ্যা হলেই তাদের মলদ্বারে অসহ্য চুলকানি শুরু হয়। বারবার প্রস্রাব, ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। বাবা-মা মলদ্বারে দেখেন ছোট ছোট সাদা কৃমি নড়ছে। দু’-চারটে বের করে দেন। অনেকে তেল লাগিয়ে দেন। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। পরদিন সন্ধ্যায় আবার একই উৎপাত- চিৎকার শুরু হয়ে যায়। ডাক্তারবাবুরা ওষুধ দেন বলেন যে এটা কুঁচো কৃমি বা ব্লেড ওয়ার্ম-এর সংক্রমণ। ওষুধ খেলেই বেশ কয়েক মাসের জন্য অব্যাহতি। তারপর আবার ওষুধ, এইরকম চলে বেশ কয়েক বছর, যতদিন না স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাধরণ নিয়মগুলি শিশুরা শিখে ফেলে।

চার রকমের কৃমিজনিত অসুখ অর্থাৎ রাউন্ড ওয়ার্ম, হুক ওয়ার্ম, টেপ ওয়ার্ম আর থ্রেড ওয়ার্ম আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সবথেকে বড় সমস্যা। কিন্তু এগুলিছাড়াও আরও অনেক কৃমি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধির চেষ্টা করে তার নানারকম বিপত্তি ঘটায়। বিশ্বের প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কোটি মানুষ এক বা একাধিক কৃমির সংক্রমণে ভুগছে। কৃমির প্রাদুর্ভাব সেইসব দেশেই বেশি, যেখানে বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা ভালোমতো নেই। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যচেতনা এবং পরিবেশ সচেতনতা কম। অসংখ্য মানুষ বিশেষ জায়গায় মল মূত্র ত্যাগ না করে যেখানে-সেখানে করে, জলশৌচের পর হাত-পা সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে না, অপরিষ্কার হাতে খাবার তৈরি করে বা অপরকে পরিবেশন করে। খাদ্য-পানীয় ঢাকা দিয়ে রাখে না, নোংড়া পুকুর বা নদীর জল শোধন না করে খায়, জুতো না পরে খালিপায়ে মাঠে-ঘাটে চলাচল করে, কাজ থেকে ফিরে হাত-পা না ধুরে খায়, নিয়মিত নখ কাটে না, শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে না, লক্ষ্য রাখে না তারা ময়লা জিনিসপত্র মুখে দিচ্ছে কি না। আসলে তৃতীয় বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের সাধারণ চেহারাটাই এইরকম। তার সঙ্গে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো আছে দারিদ্র, অপুষ্টি। আছে গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়ার প্রতিকূলতা। ফলে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা বিভিন্ন ধরনের কৃমির মুক্তাঞ্চল।

মানুষের শরীরে ঢুকে উৎপাত ঘটায় প্রধানত দু’রকমের কৃমি। রাউন্ড ওয়ার্ম বা গোলকৃমি এবং টেপ ওয়ার্ম বা ফিতাকৃমি। দুটো শ্রেণীরই কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। গোলকৃমির দেহ গোলাকার এবং লম্বা। তাদের শরীর অনেক খণ্ডে বিভক্ত নয় এবং স্ত্রী ও পুরুষ ভেদাভেদ আছে। পক্ষান্তরে টেপ ওয়ার্ম বা ফিতা কৃমি দেখতে চ্যাপ্টা, শরীর অনেক খণ্ডে বিভক্ত এবং এরা সাধারণত উভয়লিঙ্গ প্রাণী অর্থাৎ একই শরীরে স্ত্রী ও পুরুষের সমাহার। গোলকৃমিরা একই প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে তাদের জীবনচক্র সম্পূর্ণ করতে পারে। কিন্তু ফিতা কৃমিরা তাদের জীবন সম্পূর্ণ করতে সাধারণত দুটো প্রাণীর সাহায্য নেয়। যে সমস্ত গোলকৃমিরা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে সমস্যার সৃষ্টি করে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের, তারা হল সাধারণ গোলকৃমি, হুক ওয়ার্ম, থ্রেড ওয়ার্ম বা পিন ওয়ার্ম, হুইপ ওয়ার্ম, Strongyloidiasis

যে সমস্ত ফিতা কৃমি শিশুদের শরীরে বেশি সংক্রামিত হয়, সেগুলি হল- গো-মাংস থেকে আসা Taenia Saginata, শুয়োরের মাংস থেকে আসা Taenia Solium, ছোট ফিতা কৃমি Hymenolepis, Hydatid-Cyst সৃষ্টিকারী  Taenia Echinococcus

এবার সাধারণের পরিচিত অথচ বিপজ্জনক কৃমিগুলি কীভাবে শিশুদের শরীরে ঢুকে বংশবৃদ্ধি করে এবং নানারকম অসুবিধার সৃষ্টি করে সে সম্বন্ধে জানা যাক।

Roundworm

সাধারণ গোলকৃমি | Roundworm

শিশুদের এবং বড়দের শরীরে যেসব কৃমি সংক্রমণ হয় তাদের মধ্যে এই কৃমি কালপ্রিট। দেখতে সাধারণত মাটির ভেতরে যে কেঁচো থাকে অনেকটা তাদের মতোই, রঙটা অতটা লালচে নয়, লম্বায় ২০ থেকে ৩৫ সেমি. পর্যন্ত। মানুষের অন্ত্রে এরা নিশ্চিন্তে বাস করে খাদ্যরস শুষে নেয়। সংখ্যা এদের এক থেকে শুরু করে শতাধিকও হতে পারে। পরিণত বয়সে স্ত্রী-কৃমিগুলি ডিম পাড়ে। সেই ডিম মানুষের মলের সঙ্গে বাইরে যায় এই ডিম গুলি মাটিতে বা জলে বেশ কয়েক সপ্তাহ জীবিত থাকতে পারে। এবং খাবার বা জলের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। অন্তের মধ্যে ডিওডিনাম নামক অংশে এই কৃমি গুলি থেকে লার্ভা বেরিয়ে আসে। এই লার্ভাগুলি আবার ডিওডিনামের দেওয়াল ভেদ করে রক্তপ্রবাহের মধ্যে মিশে যায় এবং নানাপথ অতিক্রম করে অবশেষে ফুসফুসের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ফুসফুসের মধ্যে শুরু হয় এদের অগ্রগমন। ধীরে ধীরে শ্বাসনালী বেয়ে এরা ওপরে উঠতে থাকে এবং অবশেষে শ্বাসনালীর উচ্চতম অংশ ল্যারিংস টপকে খাদ্যনালীর মধ্যে ঢুকে পড়ে। খাদ্যনালী দিয়ে আবার শুরু হয় নীচের দিকে নামা। পাকস্থলি হয়ে ক্ষুদ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছালেই মোটামুটি যাত্রা শেষ। ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যেই বড় হতে থাকে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে, যতক্ষণ না সাবালক হয়।

সাস্থ্যবান শিশুর শরীরে দু-একটি গোলকৃমি থাকলে সাধারণত কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। বাইরে থেকে পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবুরা অনেক সময় বুঝতেও পারেন না প্রায়শই শোনা যায় সুস্থ শিশুর পায়খানা বা বমির সঙ্গে দু-একটি বড় কৃমি বেরিয়েছে কিন্তু সমস্যা দেখা যায় শিশুর অন্ত্রের মধ্যে যদি একসঙ্গে অনেকগুলি বড় গোলকৃমি বাসা বাঁধে। সেইসব ক্ষেত্রে সাধারণত যেসব সমস্যা হতে পারে— শিশুটির স্বাস্থ্য ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। হাত-পা সরু সরু, পেটটা বেঢপ, দেখলেই বোঝা যায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশু। অনেকের চোখ পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে তারা রাতকানা রোগে ভুগছে। প্রথমদিকে খিদে খুব বেশি থাকে। পরে শিশুর ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে। ক্রমশ শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে।

মাঝে মাঝেই পেটের যন্ত্রণা, বমি, বদহজম বা পেটখারাপ হতে পারে। অনেকসময়ই পায়খানা বা বমির সঙ্গে ছোট বা বড় কৃমি বেরোতে থাকে। কৃমির সংখ্যা খুব বেশি হলে কিছু কিছু কৃমি অন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ওপরে উঠতে পারে। এক-আধটি কৃমি যদি পিত্তনালীর মধ্যে ঢুকে পড়ে তাহলে অন্ত্রের মধ্যে পিত্ত আসতে পারে না। ফলে শিশুদের জনডিস হতে পারে।

গলার ভেতরে শ্বাসনালী আর খাদ্যনালী একেবারে সামনে পেছনে গলাগলি করে থাকে। কখনও-সখনও কৃমি খাদ্যনালী দিয়ে ওপরে উঠে মুখ দিয়ে না বেরিয়ে সরাসরি শ্বাসনালীর মধ্যে ঢুকে শুরু করে হাঙ্গামা। ফলে সুস্থ শিশুর আচমকা শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে। 

কৃমির আবার অন্ত্রের অর্ধপাচিত খাদ্যরসের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে অ্যাপেনডিক্স নামক অন্তের ছোট্ট উপাঙ্গের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে অ্যাপেনডিসাইটিস নামক বিপজ্জনক পরিস্থিতি বানিয়ে ফেলতে পারে।

কৃমির সংখ্যা অস্বাভাবিক বেশি হলে তারা একসঙ্গে মিলে দলা পাকিয়ে বলের মতো হয়ে অন্ত্রের মধ্যে খাবার যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেয় ইনটেস্টিনাল অবস্ট্রকশনের মতো জটিল ও জীবন সংশয়কারী অসুখের কারণ হয়ে ওঠে।

কৃমিগুলির লার্ভা যখন ফুসফুসের মধ্যে প্রবেশ করে ওপরদিকে উঠতে থাকে তখন প্রায়ই সর্দিকাশি বা এলার্জির সৃষ্টি হয়। রক্তে ইওসিনোফিল নামক একধরনের শ্বেত কণিকার সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে পারে।

আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ অথচ প্রায়ই জীবনসংশয়কারী এই কৃমিদের তাই আগে থেকে আঁচ করে নেওয়া এবং প্রয়োজন মতো চিকিৎসা করা অত্যন্ত জরুরি। বাইরে থেকে অনেক সময় বুঝতে না পারা গেলেও শিশুর পায়খানা পরীক্ষা করে সুনিশ্চিত হওয়া যায়। এই কৃমি গুলো ধ্বংস করার অনেক ভালো ভালো ওষুধ বেরিয়েছে। পাইপারজিন (Piperazine ) তো অনেক পুরনো অথচ ফলদায়ী ওষুধ, তারপর এসেছে মেবেনডাজোল (Mebendazole), আলবেনডাজোল (Albendazole), পাইরান্টেল (Pyrantel), লিভামিসোল (Levamisole) এবং আরও কয়েকটি নতুন ওষুধ। এই ওষুধগুলি খুবই নিরাপদ। ডাক্তারবাবুদের নির্দেশমতো এগুলি শিশুকে খাওয়ালে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় না বললেই চলে এবং শিশু কৃমির আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। যে সমস্ত অঞ্চলে কৃমির প্রকোপ খুব বেশি সেখানে অনেক সময় শিশুদের বছরে দু-তিনবার কৃমির ওষুধ রুটিন মাফিক খাওয়ানো যায় পায়খানা পরীক্ষা না করিয়েই।

হুক ওয়ার্ম | Hookworm

হুক ওয়ার্মগুলি সাধরণ গোলকৃমির তুলনায় দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট। ১ সেমির বেশি লম্বা নয়। তবে সংখ্যায় অনেক। রাউন্ড ওয়ার্ম যেখানে পাঁচ-দশটি, হুক ওয়ার্ম সেখানে হাজার হাজার। এরা সাধারণত অন্ত্রে ডিওডিনাম এবং জেজুনাম অঞ্চলে বাসাবাঁধে, অন্ত্রের মধ্যে ভেসে বেড়ায় না। এঁদের সুতীক্ষ্ণ দাঁত আছে। সেই দাঁত দিয়ে অন্ত্রের ঝিল্লির মধ্যে আটকে থাকে আর অন্ত্র থেকে রক্ত চুষে খায়। দেখা গেছে যে একটি হুক ওয়ার্ম দিনে প্ৰয়ে ০.০৩ মিলি থেকে ০.১৫ মিলি. রক্ত খেয়ে নিতে পারে। কাজেই বিপুল সংখ্যক হুক ওয়ার্ম যদি শিশুর শরীরে ঢুকে পড়ে তবে বুঝে দেখুন কী সাংঘাতিক কান্ডটাই না হবে। ১০০টি হুক ওয়ার্ম একটা শিশুর শরীর থেকে দিনে প্রায় ৩ মিলি. রক্ত চুষে খাবে দিনের পর দিন যদি এই পরিমাণ রক্ত কোনো শিশুর শরীর থেকে বেরিয়ে যায় তবে কিছুদিনের মধ্যেই সে মারাত্বক অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার শিকার হবে। রক্ত মানে শুধু লোহিত কণিকা নয়। তাঁর সঙ্গে প্রোটিন, ভিটামিন ও আরও মূল্যবান জিনিস হারাবার ফলে শিশু কিছুদিনের মধ্যেই অপুষ্টির শিকার হয়। এই অপুষ্টি এবং অ্যানিমিয়ার যুগলবন্দীতে বহু শিশুকেই অকালে প্রাণ হারাতে হয়। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই। 

মানুষের অন্ত্রের মধ্যে যে হুক ওয়ার্ম বাসা বেঁধে থাকে পরিণত বয়সে তারা ডিম পাড়ে। সেই ডিম মলের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে জল-কাদার মধ্যে মিশে যায়। খাবার বা জলের সঙ্গে অন্য মানুষের শরীরে ঢুকেও পড়ে। আবার ডিম ফুটে লার্ভা বেরোয়, ঠিক গোলকৃমির মতো।। এছাড়া তারও এক অদ্ভুত উপায়ে এরা মানুষের শরীরে ঢুকে পড়তে পারে মাটিতে বা কাদায় এই কৃমির ডিম থেকে লার্ভা বেরিয়ে আসতে পারে। সেই লার্ভা গুলি মানুষের পায়ের বা হাতের বা মলদ্বারের চারপাশের চামড়া ভেদ করে সোজা লিম্ফনালীর মাধ্যমে রক্তের মধ্যে মিশে যেতে পারে। রক্ত বাহিত হয়ে আবার কুসফুসের মধ্যে ঢোকে। এবং সেখান থেকে শ্বাসনালী হয়ে খাদ্যনালীর মধ্যে দিয়ে অন্ত্রে ঢুকে পড়ে রাউন্ড ওয়ার্ম বা গোলকৃমির মতোই। চামড়া ভেদ করে শরীরে ঢুকে পড়ার এই আশ্চর্য ক্ষমতার জন্য পল্লীগ্রামে যেখানে সাধারণত শিশুরা জুতো না পরেই মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়—হুক ওয়ার্মের সংক্রমণ সেখানেই সাংঘাতিক বেশি হয়। চামড়ার যে অঞ্চল দিয়ে নার্ভাগুলি ঢুকে পড়ে, অনেকসময় সেই জায়গাগুলি চুলকায়, ফুলে ওঠে। জীবাণুর সংক্রমণে ঘা হয়ে যায়। লার্ভাগুলি ফুসফুসের মধ্যে দিয়ে যখন এগোয় তখন শিশুদের সর্দিকাশি বা এলার্জি হতে পারে।

হুক ওয়ার্ম ধ্বংস করার পুরনো ভালো ওষুধ অ্যালকোপার (Alcopar)। আধুনিক ওষুধগুলির মধ্যে পাইরানটেল (Pyrantel) , মেবেনডাজোল (Mebendazole), অ্যালবেনডাজোল (Albendazole) খুব ভালো কাজ করে। তবে অনেকসময় একবার ওষুধ দিলে সমস্ত কৃমি মরে না। কিছুদিন পর আবার দেখা দেয়। 

Trichuris Trichiura‘ আর এক ধরনের ছোট গোলকৃমি যা সহজেই, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের শরীরে ঢুকে পড়ে হুক ওয়ার্ম এর মতো। লম্বায় ৩ থেকে ৫ সেমি, এই কৃমিগুলির সমনেটা অনেকটাই বেতের মতো বাঁকানো। তাই এর আরেক নাম হুইপ ওয়ার্ম তবে শিশুর অন্ত্র থেকে খাবার খাওয়া ছাড়া এরা সাধারণত খুব একটা ক্ষতি করতে পারে না। সংখ্যায় অনেক বেশি ঢুকে পড়লে পেটেব্যাথা বা পেটের অসুখ শিশুকে ভোগায়। মেবেনডাজোল (Mebendazole), বা পইরানটেল (Pyrantel) এদের খতম করে দেয়।

কুঁচো কৃমি | Pinworm

ছোটবেলায় মলদ্বারে কুঁচোকৃমির কামড়ে অস্থির হয়ে পড়েননি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে কি গ্রামে কি আধুনিক শহরে। কৃমি ঘটিত যত সমস্যা নিয়ে শিশুরা ডাক্তারখানায় আসে তাদের মধ্যে এটাই সবথেকে পরিচিত কষ্টদায়ী সমস্যা। যে সমস্যার কারণ কুঁচো কৃমি বা সুতোকৃমি। যার ইংরেজি নাম থ্রেড ওয়ার্ম। গর্ভবতী মেয়ে কৃমি গুলি সন্ধ্যাবেলায় বৃহদন্ত থেকে হেঁটে হেঁটে মলদ্বারের কাছে ডিম্ পাড়তে আসে। তাদের পাড়া ডিমগুলি মলদ্বারের সন্নিহিত অঞ্চলের চামড়ায় চুলকানির সৃষ্টি করে। চুলকাতে চুলকাতে ঐ সমস্ত অঞ্চলে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। অনেকসময় জীবাণুর সংক্রমণে ঘা হয়ে যায়। রাতে শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। অসহ্য কষ্ট, যন্ত্রনায় শুধু শিশু নয় বাড়ির সকলেই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। মলদ্বারে আঙুল দিয়ে চুলকানোর ফলে নখের খাঁজে ডিমগুলি আস্তানা গাড়ে। ঐ হাত মুখে নিলে কৃমির ডিমগুলি আবার পেটে চলে যায় এবং সেগুলি থেকে বাচ্ছা ফোটে। এই চক্র চলতে থাকে দিনের পর দিন, যতক্ষণ পর্যন্ত না শিশুকে ওষুধ খাওয়ানো যায় এবং তাকে পরিচ্ছন্ন থাকার প্রাথমিক পাঠটুকু শেখানো যায়। অবশ্য শুধু মুখে হাত দেওয়ার জন্য সংক্রমণ ঘটে না। ডিমগুলি শিশুর জামাকাপড় বা চাদরের মধ্যেও পড়ে থাকতে পারে। সেগুলি ভালো করে না, কাচলে খাবার বা জলের মাধ্যমেও এ ডিমগুলি আবার শিশুর শরীরে ঢুকে নতুন করে উৎপাত শুরু করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় শুধু শিশু না বাড়ির অন্যরাও আক্রান্ত হতে পারেন। স্কুলে এক শিশু থেকে অন্য শিশুর মধ্যেও সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। এইসব কৃমির খুব ভালো ওষুধ মেবেনডাজোল (Mebendazole), অ্যালবেনডাজোল (Albendazole) বা পাইরানটেল (Pyrantel)। কিন্তু শিশুকে একা ও একবার এই ওষুধ খাইয়ে সুস্থ রাখা সম্ভব নয়। কারণ দেখা যায় যে কিছুদিনের মধ্যে শিশুর শরীরে নতুন কৃমির সংক্রমণ ঘটে আবার ঐ পুরনো লক্ষণগুলি প্রকাশ পাচ্ছে। তাই একটি শিশুকে দীর্ঘদিন এই কৃমির হাত থেকে বাঁচাতে বাড়ির ছোটোবড়ো সবাইকে এবং সম্ভব হলে স্কুলের সহপাঠী এবং খেলার সাথী সবাইকেই এই ওষুধ একই সঙ্গে খাওয়াতে হবে।

ফিতা কৃমি | Tapeworm

দু’ধরনের ফিতাকৃমি সাধারণত আমাদের দেশে শিশুদের শরীরে বাসা বাঁধে। গো-মাংস থেকে আসা টেনিয়া স্যাগিনেটাম আর শুয়োরের মাংস থেকে আসা টেনিয়া সোলিয়াম। এই কৃমিগুলি চ্যাপ্টা, লম্বায় অনেক বড়। সময় সময় এক মিটারেরও বেশি। মুখের সাহায্যে অন্ত্রের গায়ে আটকে থাকে। আর এই মুখ থেকে একটার পর একটা খণ্ড গজিয়ে লম্বায় ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে। এরা উভলিঙ্গ প্রাণী। প্রতিটি খণ্ডেই অসংখ্য ডিম তৈরি হয়। পরিণত বয়সে এই খণ্ডগুলি মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খসে পড়ে এবং অবশেষে পায়খানার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। খণ্ডগুলিকে খালি চোখেই দেখা যায়। মাটিতে পড়ার পরও এরা অনেকদিন সক্রিয় থাকে। ঘটনাচক্রে এই কৃমিগুলিকে গরু শুয়োর অনেক সময় খাবারের সঙ্গে খেয়ে ফেলে। এবং পেটের মধ্যে ডিম ফেটে লার্ভা বেরোয়। সেই লার্ভ গুলি তাদের অন্ত্রের দেওয়াল ভেদ করে রক্তস্রোতে মিশে যায় এবং মাংসপেশিতে বাসা বাঁধে সিস্ট হিসাবে। ঐ অবস্থায় তারা দীর্ঘকাল জীবিত থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, আক্রান্ত গরু বা শুয়োরের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু আজও গরু বা শুয়োরের মাংস যদি ভালোভাবে রান্না না করা অবস্থা মানুষের পেটে যায় তবে ঐ সিস্টগুলি থেকে লার্ভা পুনর্জীবিত হয়ে ধীরে ধীরে বড় কৃমিতে রূপান্তরিত হয়। মুশকিল হল এই কৃমিগুলির মাথাটিই সবথেকে বেশি ঝামেলা পাকায়। শরীরের অন্যান্য খণ্ড গুলিকে ধ্বংস করলেও এই মাথাটাকে যদি ধ্বংস না করা যায় তবে এর থেকে আবার নতুন নতুন খন্ড গজাতে থাকে। শুয়োরের মাংস থেকে আসা টেনিয়া সোলিয়াম আবার একটা ভয়ঙ্ককর কাণ্ড করে থাকে। অশোধিত খাবারের সঙ্গে মানুষ যদি এর ডিম খেয়ে ফেলে তবে পেটে গিয়ে ডিম ফুটে লার্ভা  বেরিয়ে রক্তের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বাসা বাঁধে লিভার, কিডনি, চামড়া, মাংসপেশী এমনকি ব্রেনে গিয়েও এগুলি সিস্ট বানিয়ে ফেলে। নানারকম জটিল উপসর্গের সৃষ্টি করে। প্রাজিকুইনটেল (Praziquantel) এবং নিক্লোসামাইড (Niclosamide) এই ধরনের কৃমির মহৌষধ। অনেক সময় এই ওষুধগুলি খাওয়ার সঙ্গে জোলাপ খাওয়ারও দরকার হয়।

কৃমি কেন হয় ও কৃমি নিয়ে ভুল ধারণা

মিষ্টি খেলে কখই কৃমি হয় না বা কৃমির উপদ্রব বাড়ে না। কেবলমাত্র সংক্রমিত খাদ্য বা পানীয়ের মাধ্যমে বাহিত হয়ে কৃমির ডিম পেটে ঢুকলে তবেই শরীরে নতুন কৃমির জন্ম হয়। অনেক সময় ভালোভাবে রান্না না করা ও শুয়োরের মাংসের মাধ্যমেও এই কৃমি শিশুর শরীরে ঢুকে পড়ে।

রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় দাঁত কিড়মিড় করা, আবোল-তাবোল বকা, মুখ দিয়ে লালা ঝরা, বারবার প্রস্রাবে যাওয়া, ঘুমন্ত অবস্থায় প্রস্রাব করা, অন্য শিশুদের খিমচি কাটা বা কামড়ে দেওয়া, মাটি খাওয়া, খুতু ফেলা, দেওয়াল চাটা— কোনোটাই কৃমির জন্য নয়। এগুলোর অধিকাংশই মানসিক বা ব্যবহারগত সমস্যা। 

বাজার চলতি কৃমির ওষুধগুলো খুবই নিরাপদ এবং কার্যকরী। এর কোনোটাই  তেমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে না। ক্ষেত্রবিশেষ একাধিকবার ব্যবহার করলেও কোনো শারীরিক অসুবিধা হয় না। দুর্ভাগ্যবশত এই ওষুধগুলো ব্যবহার করতে অনেকেই ভয় পান। ডাক্তারবাবুদের উপদেশ সত্ত্বেও ওষুধ খাওয়াতে দ্বিধা করেন। তার ফলে ঠিকসময়ে সঠিক ওষুধ না পড়ার ফলে অনেক কৃমিই গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। তাই উপদেশ মতো শিশুদের কৃমির ওষুধ খাওয়াতে দ্বিধা করবেন না। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই কৃমি থাকুক না থাকুক শিশুদের বছরে কয়েক বার ওষুধ খাওয়ানো হয়। এতে অপুষ্টি এবং শিশুমৃত্যুর হার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

অতিরিক্ত কৃমি হলে করনীয়

বিশুদ্ধ পানীয় জল—শহরে বা গ্রামে যদি সারা বছর সরবরাহ করা যায় তবে প্রধান কৃমির সংক্রমণ প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কমিয়ে ফেলা সম্ভব। এ ব্যপারে যেমন সরকারি প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন সাধারণ মানুষের সচেতনতার। পানীয় জলের পুকুর বা কুয়ো পরিষ্কার রাখা জন্য বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়াও দরকার।

পায়খানা করার জন্য সুনির্দিষ্ট জায়গার ব্যবস্থা কৃমি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একান্ত জরুরি। গ্রামাঞ্চলে বিশেষত দেখা যায়, ছোট এবং বড় অনেকেই মাঠে পায়খানা করে এবং পুকুর বা নদীতে জলশৌচ করে। এতে আক্রান্ত মানুষের পায়খানার সঙ্গে কৃমির যে ডিমগুলো বেরোয় তা মাটিতে বা জলে মিশে যায়। পরে তা আবার খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে মিশে অন্য মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে কৃমির বংশ বৃদ্ধি করে।

মানুষের স্বাস্থ্যচেতনার উন্নয়ন ভীষণ প্রয়োজন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যশিক্ষা সব মানুষের থাকা দরকার। খাওয়ার আগে এবং পরে হাত ধোয়া এবং সম্ভব হলে সাবান দিয়ে – এ শিক্ষাটাই কৃমির সংক্রমণকে অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। নিয়মিত নখ কাটা দরকার এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এটা সাপ্তাহিক এবং বাধ্যতামুলক পদ্ধতি হওয়া উচিত। জুতো পরে মাঠে এবং রাস্তায় চলাচল করা ছোট বড় সকলের পক্ষেই জরুরি। যারা খাবার রাঁধেন এবং পরিবেশন করেন তাদের এইসব কাজের আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। বাজার থেকে বা মাঠ থেকে নিয়ে আসা শাকসবজি, ফলমূল বিশেষত যেগুলো কাঁচা খাওয়া হয়- খাবার আগে অবশ্যই তা ধুয়ে নেওয়া কর্তব্য। মাংস অনেক্ষণ গরমে রাঁধতে হবে। সমস্ত রকম খাবার জিনিস ঢেকে রাখা দরকার। বড়রা এবং ছোটরাও নিয়মিত সাবান মাখবে, জামাকাপড় পরিষ্কার রাখলে জামাকাপড়ের মধ্যে, বিছনার চাদরে, বালিশের ওয়াড়ে কৃমির ডিম্ পড়ে থাকতে পারে। কাজেই সেগুলো নিয়মিত গরমজল ও সাবানে কাচা দরকার হাতের নখ খাওয়া, ব্যবহার্য জিনিসপত্র চাটা, মাটি থেকে কুড়িয়ে খাওয়ার অভ্যাস যে সমস্ত শিশুদের থাকে তাদের কৃমির সংক্রমণ অনেক বেশি হয়। তাই এসব ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা উচিত। শেষে আবার বলি কৃমির ওষুধ খাওয়ানোর উপযোগিতার কথা। ওষুধ খাইয়ে যদি কৃমির সংখ্যা কমানো যায় তবে তাদের ডিমের সংখ্যাও কমবে আর তাতে কমবে কৃমির সংক্রমণও। 

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version