Home মহিলাদের স্বাস্থ্য রক্তশূন্যতার লক্ষণ ও প্রতিকার | Anemia | Iron Deficiency Symptoms

রক্তশূন্যতার লক্ষণ ও প্রতিকার | Anemia | Iron Deficiency Symptoms

ডাক্তারবাবু রোগী পরীক্ষা করতে করতে বললেন, ‘এবার একটু ওপরদিকে তাকান তো’। তারপর রোগীর চোখের তলার চামড়াটা আঙুল দিয়ে নীচের দিকে টেনে একঝলক কী দেখে নিলেন। 

কী যে দেখলেন তা আর বলে দিতে হবেনা। রোগী নিজেও জানেন, ডাক্তারবাবু দেখলেন অ্যানিমিয়া আছে কি না। যে-কোনো স্বাস্থ্য-পরীক্ষায় এটা দেখে নেওয়া একটা আবশ্যিক ব্যাপার। কারণ সমগ্র পৃথিবীতেই অ্যানিমিয়া এক অত্যন্ত বড় ধরনের সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুসারে এশিয়া মহাদেশে পুরুষদের মধ্যে শতকরা দশ জন এবং মহিলাদের মধ্যে শতকরা কুড়ি জন এই অবস্থার শিকার।

‘অবস্থা’ বলাই সমীচীন, কারণ অ্যানিমিয়া কখনই নিজে একটা রোগ নয় – রোগের একটা লক্ষণমাত্র। ছোট থেকে বড়, সাধারণ থেকে কঠিন, অপুষ্টি থেকে ক্যানসার—নানান ধরনের এক বিরাট সংখ্যক রোগের ক্ষেত্রেই অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। রক্তাল্পতা বলতে সেই অবস্থার কথাই বোঝানো হয়, যখন দেহে পরিবাহিত রক্তে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ বা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বা একযোগে উভয়েরই পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়।

লোহিতকণিকার নাম আমরা প্রায় সবাই জানি। রক্তের এক প্রধান কোষীয় উপাদান হল এই লোহিতকণিকা। কিন্তু হিমোগ্লোবিন? হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্তকণিকায় উপস্থিত এক জটিল জৈব যৌগ যেটি ‘হিম’ নামক এক লাল লৌহঘটিত রঞ্জক পদার্থ আর গ্লোবিন নামক এক প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত। এই হিমোগ্লোবিন থাকার জন্যই রক্তের এমন লাল রং।

একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের রক্তে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ ১৩:৫ থেকে ১৮ গ্রাম। মহিলাদের প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ ১১.৫ থেকে ১৬.৫ গ্রাম।

লোহিতকণিকা দেহে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম করে থাকে তার মূলে আছে এই হিমোগ্লোবিন। কাজের মধ্যে রক্তে অম্ল-ক্ষারের সাম্য বজায় রাখা বা রক্তের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করার কথা তো বলতেই হবে। কিন্তু লাল রক্তকণিকার বা বলা যায় হিমোগ্লোবিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শ্বসনে অংশগ্রহণকারী গ্যাসীয় পদার্থের পরিবহন। প্রশ্বাসে গৃহীত অক্সিজেনের সঙ্গে হিমোগ্লোবিন যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিনরূপে সকল সজীব কোষে আনীত হয়। সেখানে পৌঁছে অক্সিজেন অক্সিহিমোগ্লোবিনের খপ্পর থেকে ছাড়া পেয়ে কোষের প্রয়োজনমতো মুক্ত হয় ও ব্যবহৃত হয়। হিমোগ্লোবিন এবার শ্বসনে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে এবং কার্বামিনো যৌগ হিসেবে এই নিঃশ্বাসে পরিত্যাজ্য গ্যাসকে ফুসফুসে চালান করে।

কারো অ্যানিমিয়া হলে বোঝাই যাচ্ছে, রক্তের এই অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা কমে যাবে। কিন্তু প্রতিটি কোষের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত অক্সিজেন প্রয়োজন। তার ঘাটতি দেখা দিলে তাই ঘাটতির পরিমাণভেদে কম-বেশি মাত্রায় দেহে তার প্রকোপ পড়বেই। তাছাড়া স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কত দ্রুত একজন রক্তাল্পতায় আক্রান্ত হলেন, অবস্থা সামাল দেবার জন্য দেহ কতটা সময় পেল, প্রকোপের মাত্রার ক্ষেত্রে সেটাও একটা বিচার্য বিষয়।

অল্প মাত্রায় রক্তাল্পতা থাকলে শুধু পরিশ্রমের সময় অর্থাৎ যখন অক্সিজেনের চাহিদা বেশি তখনই কেবল শরীর জানান দেবে। সহজে পরিশ্রান্ত হয়ে যাওয়া, কাজেকর্মে অনাগ্রহ, অল্প খাটনিতেই হাঁপ ধরা ইত্যাদি তাই অ্যানিমিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। এরপর ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন অঙ্গেঅক্সিজেনের অভাবজনিত প্রকোপ এককভাবে বা সমষ্টিগতভাবে প্রকাশ পাবে। যেমন—খিদে কমে যাওয়া, মাথা ঘোরা, চামড়া ফ্যাকাশে হওয়া, কান ভোঁ-ভোঁ করা, চোখে ঝাপসা দেখা, বুক ধড়ফড় করা, মাথার যন্ত্রণা, ঘুম না হওয়া, হাত-পায়ের আঙুলে সাড় কমে যাওয়া ইত্যাদি। ঘাটতি রক্তেই দেহের চাহিদা মেটানোর তাড়নায় হৃৎপিণ্ড বেশি ঘন-ঘন রক্ত পাম্প করবার চেষ্টা করে। হৃৎপিণ্ডের ওপর এই বাড়তি কাজের চাপ পরে অনেক ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

যে কারণেই অ্যানিমিয়া হোক না কেন, তার সংজ্ঞার্থটা মাথায় রাখলেই বোঝা যাবে, অ্যানিমিয়ার লক্ষণ সব ক্ষেত্রেই মূলত একই রকমের। তাই বাইরের এইসব লক্ষণ দেখে অ্যানিমিয়া নির্ণয় করা গেলেও তার আসল কারণটিকে চেনবার জন্য কিন্তু অনুসন্ধান দরকার। এবং অ্যানিমিয়া নিরাময় বা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সেটাই আসল গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।

রক্তাল্পতার অর্থাৎ লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিন ঘাটতির এই কারণগুলো নিয়ে এবার আলোচনায় আসি।

আমাদের দিনযাপনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় ‘ঘাটতি’ শব্দটার সঙ্গে সবারই হাড়ে হাড়ে পরিচয়। তা, আমরা আপাতত কল্পনা করছি এমন এক দরকারি শিল্পজাত দ্রব্যের, প্রয়োজনের তুলনায় বাজারে যার রীতিমতো অভাব। এখন এই অভাবের কারণ কী হতে পারে? ধাপে ধাপে নানান সম্ভাবনার কথা একে একে সাজিয়ে নেওয়া যাক ৷

প্রথমেই একেবারে উৎসের কথা ভাবি। অর্থাৎ যে কারখানায় ওই সামগ্রীটি তৈরি হয়, সেখানেই কোনো গোলযোগ দেখা দিতে পারে। ফলত উৎপাদন ব্যাহত। যাকে বলে একেবারে গোড়ায় গলদ। কিংবা হতে পারে কারখানা ঠিকঠাক থাকলেও কাঁচামাল ঠিকমতো সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাছাড়া উৎপাদিত দ্রব্যে বিরাট কোনো ত্রুটি থেকে যাওয়া এবং সেইজন্য সেই দ্রব্য বাজারে আর না আসতে পারার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে, কারখানা থেকে উদ্দিষ্ট জায়গায় সরবরাহের পথে কোনো কারণে এক বড় অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। আর এই কারখানায় উৎপাদন থেকে শুরু করে সুষ্ঠু সরবরাহ অবধি সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেই যে ঘাটতি দেখা দেবে না, এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ ইতিমধ্যে উৎপাদন হারের তুলনায় বাজারে জিনিসটির চাহিদা অনেক বেড়ে যেতে পারে। সেটাও তো ঘাটতির একটা বড় কারণ।

শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে বলতে কেন যে হঠাৎ বাণিজ্য বিশেষজ্ঞের ভান করে এমন এক বিশ্লেষণে মেতে উঠলাম, সেটা নিশ্চয় এতক্ষণে স্পষ্ট। হ্যাঁ, লোহিত রক্তকোষ বা হিমোগ্লোবিনের ঘাটতির কারণগুলো এবার ওই আগের ‘উদাহরণের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে আলোচনা করা যাবে। তাতে ব্যাপারটা বোধহয় অনেক সরল হবে।

প্রথমেই তাহলে আসবে ওই কারখানায় গণ্ডগোলের কথা। লোহিতকণিকা তৈরির কারখানা হল অস্থিমজ্জা। শুধু লোহিতকণিকা বলা অবশ্য ঠিক হল না, কারণ অনুচক্রিকা আর কিছু শ্বেতকণিকা এই অস্থিমজ্জারই উৎপাদন। এখন অস্থিমজ্জার গণ্ডগোলের জন্য এই তিন জাতের কোষের একযোগে ঘাটতি হওয়ার ব্যাপারটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ—এই অবস্থাকে বলে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া ( Aplastic anemia )।

যাদের রক্তকোষ জন্ম থেকেই তৈরি হচ্ছে না, তাদের জন্য অধিকাংশ চিকিৎসকই আজকাল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পক্ষে মত দিচ্ছেন। কিন্তু উপযুক্ত দাতা পাওয়া, প্রতিস্থাপনের উপযুক্ত ব্যবস্থা, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি সংক্রান্ত অসুবিধে এই ধরনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।

তা যাক সেকথা। আমরা এবার আলোচনার পরের ধাপে চলে আসি। অর্থাৎ অস্থিমজ্জায় লোহিতকণিকা তৈরির কাঁচামাল ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না।

লোহিতকোষ তৈরির জন্য খাদ্যে প্রোটিন, নানান ভিটামিন এবং লৌহের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলাম। খাদ্যের মধ্যে উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যনালী থেকে এগুলিকে স্বাভাবিকভাবে শোষণ করারও দরকার আছে অবশ্যই। এগুলির অভাব থেকে অস্থিমজ্জায় উৎপাদন ব্যাহত হবে। তাই এই জাতের অ্যানিমিয়া এড়াতে হলে দেহে নিয়মিতভাবে এইসব কাঁচামালের যোগান রাখতে হবে। আর বেশি রকম অভাব দেখা দিলে, কীসের অভাব নির্দিষ্ট করে নিয়ে সে-অভাব পূরণ করতে হবে—মুখে খাওয়া ওষুধের মাধ্যমে বা এমনকী গুরুতর ক্ষেত্রে প্রয়োজনে রক্ত সরাসরি সঞ্চালিত করেও ।

প্রসঙ্গত জানাই, অধিকাংশ অ্যানিমিয়া রোগীই এই লৌহের অভাবজনিত কারণে আক্রান্ত হন। অর্থাৎ লৌহের অভাবঘটিত অ্যানিমিয়াই সারা পৃথিবীতে অ্যানিমিয়ার প্রধানতম কারণ।

এছাড়া লোহিতকণিকা প্রস্তুতিতে কিছু গলদ থাকতে পারে, যার ফলে নানান অস্বাভাবিক রক্তকোষের বা হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন ঘটে অর্থাৎ আগে দেওয়া উদাহরণে ঘাটতির তৃতীয় যে কারণটির কথা বলা হয়েছিল। লোহিতকোষের এই ত্রুটির মধ্যে তার প্রয়োজনীয় উৎসেচকের কর্মক্ষমতা, তার ভেতরে অবস্থিত হিমোগ্লোবিনের গঠন, তার বাইরের আকার-আকৃতি ইত্যাদি সবই পড়ছে।

হিসেবে প্রকাশ, হিমোগ্লোবিনের অস্বাভাবিক গঠনের জন্য পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষ আক্রান্ত হন। এই ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনঘটিত রোগের (হিমোগ্লো-বিনোপ্যাথি) মধ্যে ভারতবর্ষে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া ওড়িশা ও তার পার্শ্ববর্তী অংশে বর্তমানে সিকল সেল অ্যানিমিয়া (Sickle cell anemia)-র আক্রমণও দেখা যাচ্ছে—যদিও এই রোগটিকে আগে নিগ্রো মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলেই মনে করা হত।

Iron Deficiency Symptoms

এই দুটি রোগই বংশগত এবং মারণ রোগ। নিয়মিত রক্ত দেওয়ার মতো অস্থায়ী ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই প্রায় করার নেই। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এইসব রোগ থেকে বাঁচাতে বিবাহ-পূর্ব রক্ত পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

তবে লোহিত রক্তকোষের ধ্বংসের হার বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ যে তার গঠনগত কোনো ত্রুটি, এমন কিন্তু কখনোই নয়। একটু আগে কারখানাজাত দ্রব্যের ঘাটতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে গিয়ে দেখেছিলাম ত্রুটিশূন্যভাবে উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও সরবরাহের পথে সামগ্রীটি কোনো কারণে প্রচুর পরিমাণে নষ্ট হয়ে গেলে বাজারে অবশ্যই তার প্রভাব পড়বে। এখানেও তেমনি। লোহিতকণিকার গঠনে কোনো গলদ থাকছে না ঠিকই, কিন্তু সংবহনের পথে কোনো প্রতিকূলতার কারণে এই স্বাভাবিক রক্তকোষই প্রচুর পরিমাণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

এমন সব প্রতিকূলতার মধ্যে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর জাতীয় সংক্রামক রোগ, কিছু ওষুধের কুপ্রভাব, শরীরে ভুল গ্রুপের রক্ত চালিয়ে দেওয়া, কিডনি বা লিভারের কাজ থেমে যাওয়া ইত্যাদি প্রধান।

রক্তাল্পতার চতুর্থ কারণটি হল, চাহিদার বৃদ্ধি। যেমন ধরা যাক বয়ঃসন্ধিকালের কথা, ধরা যাক সদ্যোজাত শিশুর মায়ের কথা। এর থেকে রেহাই পেতে আগে থেকেই গৃহীত খাদ্যের মান এবং পরিমাণের উন্নতি ঘটানো খুবই দরকার। অবশ্য একথাও সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে, একটি রোগ অনেক সময়েই একাধিক ধারায় প্রভাব বিস্তার করিয়ে রক্তাল্পতা ঘটাতে পারে। যেমন সংক্রমণের ক্ষেত্রে একযোগে অস্থির-মজ্জার কাজ ব্যাহত হতে পারে, রক্তকোষ অপরিণত অবস্থায় ধ্বংস হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি ।

অ্যানিমিয়ার নানানতরো কারণ আর তার প্রতিরোধ বা প্রতিকারের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে এই যে দীর্ঘ কথাবার্তা বলা হল, তার মধ্যে থেকে একটা ব্যাপারের প্রতি এবার একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া ( Aplastic anemia ), থ্যালাসেমিয়া ( Thalassemia ) ইত্যাদির নিরাময় যে খুবই চেষ্টাসাপেক্ষ তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। থাকার কথাও নয়। কিন্তু সারা পৃথিবীর হিসেবেই এধরনের রোগাক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। অথচ তা সত্ত্বেও অ্যানিমিয়া আজকের বিশ্বে এক বড় সমস্যা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই, অ্যানিমিয়ার যেসব কারণগুলো সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব, উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে সেইসব কারণগুলোই আমাদের ওপর মারাত্মক আঘাত হানছে।

এই দুর্ভাগ্যজনক চিত্রটি আরও পরিষ্কারভাবে বোধগম্য করার জন্য আমরা অ্যানিমিয়ার প্রধানতম ধারাটি নিয়ে একটু বিশদভাবে আলোচনা করব। ‘প্রধানতম’ অর্থে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে প্রধানতম, সমস্যার ব্যাপকতার দিক দিয়ে প্রধানতম। আমরা আগেই জেনে গেছি, সেই ধারাটি হল লৌহের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া বা আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া।

এই অভাবের কারণ দুটি। এক, প্রয়োজনের তুলনায় গৃহীত খাদ্যে এর পরিমাণের স্বল্পতা। আর দুই, খাদ্যে উপযুক্ত পরিমাণে গৃহীত হলেও খাদ্যনালী থেকে তাদের শোষণ ব্যাহত হওয়া। এর মধ্যে প্রথম কারণটিই আমাদের দেশে বেশি সমস্যার।

তাছাড়া লৌহের অভাবের জন্য আরও একটি তৃতীয় কারণকেও দায়ী করতে হবে। সেই সূত্রে মনে করিয়ে দিই যে লোহিতকণিকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তার হিমোগ্লোবিনে উপস্থিত লৌহ-অণু আবার অস্থিমজ্জায় ফিরে যায় নতুন হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোনো রোগীর দেহে যদি কোনো কারণে রক্তপাত চলতেই থাকে, তাহলে প্রচুর লোহিতকণিকা দেহের বাইরে বেরিয়ে চলেছে। ফলে তার সঙ্গে সঙ্গে অনেকখানি লৌহও নষ্ট হচ্ছে, যে লৌহ সুস্থ অবস্থায় আবার নতুন হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারত। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এই অবস্থাও লৌহের অভাব ঘটার এক কারণ।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করতে বাধ্য হন। তাই কৃমি দ্বারা সংক্রমণ এখানে খুব সাধারণ সমস্যা। নানান কৃমির মধ্যে হুক ওয়ার্ম দ্বারা সংক্রামিত হলে খাদ্যনালীতে প্রায়শই রক্তক্ষরণ হয়। তাছাড়া পেপটিক আলসার জাতীয় রোগেও খাদ্যনালীতে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। আর এইরকম রক্তক্ষরণ থেকেই লৌহের অভাব এবং সেইসঙ্গে অ্যানিমিয়া। তাছাড়া এর সঙ্গে সঙ্গে লৌহ-সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ না করতে পারার জন্য অ্যানিমিয়া তো আছেই।

শিশু থেকে বৃদ্ধ যে-কোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়ার এগুলি এক-একটি বড় কারণ। এছাড়া বয়সভেদে আরো কিছু কিছু বাড়তি কারণ এগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমস্যাটা আরোই মারাত্মক করে তুলছে।

যেমন ধরা যাক শিশুদের কথা। জন্মানোর পর শিশুর দেহে, বিশেষত লিভারে যথেষ্ট পরিমাণে লৌহ জমা থাকে। সম্পূর্ণ পরিণতিপ্রাপ্ত অবস্থায় উপযুক্ত সময়ে জন্ম হলে লৌহের এই সঞ্চয় শিশুর প্রথম ছ’মাস লোহিতকণিকা উৎপাদনের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু তারপর? এই ছ’মাস সময় শিশুর প্রধান খাদ্য হল দুধ। এই দুধে—তা মাতৃদুগ্ধই হোক আর গরু থেকেই আসুক, অন্য নানান গুণাবলী প্রচুর থাকলেও তাতে লৌহের পরিমাণ খুবই কম। তাই শিশুর বয়স মাস ছয়েক হয়ে যাওয়ার পরই প্রচলিত রীতিনীতির দোহাই দিয়ে যদি তাকে অন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো আরম্ভ করা না হয়, তাহলে তার লৌহের ভাঁড়ারে টান পড়তে বাধ্য আর সেজন্য জীবনের শুরু থেকেই অ্যানিমিয়া। সমগ্র পৃথিবীর হিসেবে শিশুমৃত্যুর প্রথম দশটি কারণের মধ্যে অন্যতম এই অ্যানিমিয়া। 

মহিলাদের সন্তান-উৎপাদনক্ষম বয়সকালের মধ্যে এমনিতেই গড়ে প্রতি মাসে প্রায় তিরিশ মিলিগ্রাম লৌহ বাড়তি খরচ হয়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মায়েদের এই খরচটা বন্ধ ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে আবার ভ্রূণের বৃদ্ধিতে, প্ল্যাসেন্টার সংবহনে, সন্তান উৎপাদনের সময় রক্তক্ষরণে অনেকখানি বাড়তি রক্তের দরকার থেকেই যাচ্ছে। এইসব প্রয়োজন মেটাতে সন্তান ধারণকালে সাধারণ অবস্থার চেয়ে গড়ে প্রতিদিন তাই আরো প্রায় আড়াই মিলিগ্রাম রক্ত বেশি চাই। এমনিতেই হুক ওয়ার্ম সংক্রমণ জাতীয় কারণে রক্তাল্পতায় ভুগবার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাছাড়া আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত পরিবারে পুরুষের তুলনায় মহিলার খাবারের মান নীচু। এর ওপর আবার তাদের এইসব সম্ভাবনাগুলো যুক্ত হল। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সন্তানধারণক্ষম বয়সে মহিলাদের অ্যানিমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের থেকে অনেকখানি বেশি। শিশুদের জন্মকালে লৌহ জমা থাকার কথা বলছিলাম। সে লৌহ অবশ্য মায়ের দেহ থেকেই আসে। মনে রাখতে হবে, মা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত হলেও পূর্ণবয়স্ক ভ্রূণকে তার লৌহ সঞ্চয় তৈরি করে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কিন্তু কোনো কার্পণ্যই করেন না। ফলে মহিলা আরো বেশি করে লোহিতকণিকার ঘাটতিতে ভুগতে থাকেন। হিসেবমতো, এই এশিয়া মহাদেশে প্রতি একশো জন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মধ্যে চল্লিশ জনই অ্যানিমিয়ার শিকার।

লৌহের অভাবঘটিত এই যে ভয়াবহ চিত্র, তা প্রতিরোধ করার পথটি কিন্তু মোটেও জটিল নয়। খুব সহজলভ্য খাবারের মধ্যেই প্রচুর পরিমাণে লৌহ উপস্থিত। যেমন—মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, টাটকা শাক-সবজি। সাধারণভাবে এক পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক এক মিলিগ্রাম লৌহ জুটলেই যথেষ্ট। অবশ্য বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনের সময়ে বাড়তি জোগান দেওয়ার কথা মাথায় রাখতেই হবে। সেটা খাদ্যের মাধ্যমে বা ওষুধের মাধ্যমে যে-কোনো ভাবে দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে কৃমির সংক্রমণ ইত্যাদি থেকেও সাবধান থাকতে হবে। তাছাড়া ঠোঁটের কোণে বা জিহ্বায় লালচে ঘা (অ্যাঙ্গুলার স্টোমাটাইটিস বা গ্লোসাইটিস), ভঙ্গুর নখ ইত্যাদি লক্ষণ দ্বারা লৌহের অভাব সহজেই আগে থেকে নির্ণয় করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে আগে থেকে সাবধান হওয়ার সুবিধে রয়েছে। অথচ এই আপাত-সহজ কাজটাই যে করা সম্ভব হচ্ছে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

অ্যানিমিয়ার সবচেয়ে প্রচলিত ধারার আলোচনা শেষ করে সেই প্রাসঙ্গিকতাতেই সামগ্রিকভাবে উপসংহার টানি। মনে করিয়ে দেওয়ার কথা শুধু এইটুকুই যে, সবার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটু সচেতনতা, চিকিৎসা-ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ—ব্যস, এইমাত্র সম্বল করেই আমরা রক্তাল্পতার মতো এক ব্যাপক সমস্যার সমাধান করে তাকে এক দুর্লভ লক্ষণের তুচ্ছতায় নামিয়ে আনতে পারি । সুস্থ জীবনযাপনের পথে রক্তের এই ঘাটতিকে নির্মূল করা যে কত জরুরি, তা নিশ্চয় আর নতুন করে ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। স্বাস্থ্যবান হওয়ার আকুতিতে আমাদের তাই রক্তলোলুপ হতে হবে। আক্ষরিক অর্থেই।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version