ঘুমের সমস্যা বর্তমানে একটা জ্বলন্ত সমস্যা। এর পিছনে বহু কারণ থাকতে পারে। যেমন শারীরিক সমস্যা, মানসিক দুশ্চিন্তা, ভয়, উৎকণ্ঠা প্রভৃতি আছে, তেমনই আছে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণও।
ঘুম নিয়ে আমাদের সঙ্গীতে, সাহিত্যে বহু চর্চা হয়েছে। ‘খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে’, একটা জনপ্রিয় সঙ্গীত ‘ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা, এই মাধবী রাত’। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘ঘুমের ঘনগ্রহণ হতে যেমন আসে স্বপ্ন তেমনি উঠে এসো এসো।’
Table of Contents
ঘুম বলতে আমরা কি বুঝি ?
মস্তিষ্কের স্নায়ুর কার্যাবলির স্বাভাবিক অথবা কৃত্রিম ভাবে ঘটানো সাময়িক অধিকার হরণের অবস্থাকে ঘুম বলে। ঘুম আমাদের শরীর ও মনকে পুষ্টি দিতে সাহায্য করে। সেক্সপিয়ারের কথায় ‘ঘুম দৈনন্দিন জীবনের মৃত্যুতে মুক্ত হাতের যত্ন, দৈহিক পরিশ্রান্তের স্নান, ব্যথিত মনের সুগন্ধি, জীবনের ভূরিভোজের প্রধান পুষ্টিদাত্রী। ঘুম সাধারণভাবে শরীরের গতিহীন বা নিষ্ক্রিয় অবস্থাকে বোঝায়।
সারাদিনে কতটা ঘুমের প্রয়োজন?
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সারাদিনে আট থেকে ন’ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। ঘুমের এই প্রাসঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহকে পাঁচ থেকে ছ’টা কালচক্রে ভাগ করা হয়। যার প্রতিটি সময়কাল নব্বই মিনিটের হয়। প্রতিটি কালচক্রকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়— ধীরগতির ঘুম সত্তর মিনিটের, দ্রুত চোখের অবস্থান পরিবর্তন যুক্ত ঘুম কুড়ি মিনিটের। তবে শিশুদের ঘুম বেশি এবং বয়স্কদের ঘুম সাধারণত কম হয়।
ঘুমের প্রয়োজনীয়তা
অনেকেই দাবি করেন ঘুম ছাড়া বা অল্প ঘুমেই কাজ করতে পারেন। কিন্তু এটা ঘটনা যে, একজন ব্যক্তির দেহ যন্ত্রাদির কার্য সম্বন্ধীয় পূর্ণতার জন্য স্বাভাবিক ঘুমের বিশেষ প্রয়োজন। একজন স্বাভাবিক ঘুম বঞ্চিত ব্যক্তির মধ্যে মনোযোগের অভাব, স্মৃতিশক্তির অকৃতকার্যতা এবং সাথে সাথে দৈহিক দুর্বলতা; কম্পন প্রভৃতি লক্ষণ প্ৰকাশ পায় ৷ একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে যেসব কর্মচারি আট ঘণ্টা কাজ করেন তাদের টিফিনের পর আধ ঘণ্টা বিশ্রামের ব্যবস্থা করলে পরবর্তী সময়ে কাজ ভালো হয়।
ঘুমের সময়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন
ঘুমের সময় হার্ট রেট, রক্তচাপ, কার্ডিয়াক আউটপুট, বিপাকের হার সবই কম থাকে সার্বিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াও কম হয় । মূত্র তৈরী থেকে সকল ক্ষরণই কমে যায়। কেবলমাত্র পটুইটারি গ্রন্থি থেকে গ্রোথ হরমোন ক্ষরণ বেড়ে যায় ধীর গতির ঘুমের সময়। পেশির টোন এবং জার্ক কমে যায় ৷
কেন ঘুম জরুরি ?
ঘুমের মধ্যে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ হয়। বাচ্চাদের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। তাছাড়া ত্বক ও চুলের সেলুলার গ্রোথের জন্য ঘুম প্রয়োজন। গ্রোথ হরমোনের প্রভাবে ত্বক ও চুলের নতুন কোষ জন্মের পর বৃদ্ধি পায়। যদি ঘুম কম হয় তাহলে গ্রোথ হরমোন ক্ষরণের মাত্রা কমে যায় ৷ এর ফলে চুল পড়ে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে। ঘুমের মধ্যে সেবেসাস গ্রন্থির ক্ষরণ বেড়ে যায়, যা কিনা ত্বক ও চুলকে উজ্জ্বল করে। ঘুম কম হলে সেবেসাস গ্রন্থির ক্ষরণ কমে গিয়ে শরীরের জৌলুস বা উজ্জ্বলতা কমে যায়।
ঘুম কম হওয়ার জন্য বুদ্ধির প্রখরতা কমে যেতে পারে। কমে যেতে পারে চিন্তাশক্তি । খিটখিটেও হয়ে যেতে পারেন। এমনকী মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে। পড়াশোনা মনে থাকবে না, স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে।
অনিদ্রার প্রাথমিক চিকিৎসা
অনিদ্রার কারণগুলো জেনে সেসব দূর করার চেষ্টা করতে হবে। মানসিক কারণের মধ্যে ভয়, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, কোনো দুঃসংবাদ প্রভৃতি থাকলে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে। শারীরিক কারণের মধ্যে আছে রাত্রি জাগরণ, মদ্যপান, ধূমপান, অতিরিক্ত কফি সেবন প্রভৃতি। সহজপাচ্য খাদ্য গ্রহণ, রাতের খাওয়া দশটার মধ্যে গ্রহণ করা দরকার। বেশি রাত করে টিভি না দেখা, মোবাইল ও কম্পিউটার নিয়ে রাত না করা উচিত। কারণ এগুলো অনিদ্রা ডেকে আনে। শোওয়ার আগে হাত-পা জল দিয়ে ধুয়ে গোটা শরীরটা ভিজে গামছা বা তোয়ালে দিয়ে মুছে নিলে ভালো হয় ।
অনিদ্রার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা হল লক্ষণভিত্তিক সদৃশ-বিধান মতে চিকিৎসা পদ্ধতি। ওষুধ নির্বাচন সঠিক হলে, ওষুধের শক্তি ও মাত্রা সঠিক থাকলে অনিদ্রার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিতে অবশ্যই সুফল পাওয়া যায়। অনিদ্রায় ব্যবহৃত কয়েকটি ওষুধের লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করছি।
অ্যাকোনাইট । Aconite
অস্থিরতা, উত্তেজনা, ভয়, দুশ্চিন্তা, মৃত্যুভয়, আকস্মিক স্নায়বিক আঘাত, শুষ্ক শীতল হাওয়ার জন্য হঠাৎ কাঁপুনি। অ্যাকোনাইটের অবস্থা সাধারণত রাত্রে আসে এবং অ্যাকোনাইট প্রয়োগে শান্তির ঘুম আসে।
ক্যামোমিলা । Chamomilla
ঘুম ঘুম ভাব কিন্তু ঘুমোতে পারছে না, অস্থিরতা। রাত্রে প্রচন্ড যন্ত্রণার জন্য স্থির থাকতে পারে না। খুব খিটখিটে, খামখেয়ালি, অভদ্র আচরণ।
কফিয়া । Coffea
কফি পান করার জন্য নিদ্রাহীনতা, সাধারণভাবে সম্পূর্ণ জাগরিত অবস্থা, মাথায় রাজ্যের চিন্তা, সেই কারণে ঘুমোতে পারে না । হঠাৎ প্রবল উত্তেজনা, সে সুখবর বা খারাপ খবর যাই হোক না কেন তার ফলে ঘুমোতে না পারা।
পালসেটিলা । Pulsatilla
একটা স্থির চিন্তার জন্য প্রতিদিন মধ্যরাত্রের পূর্বে ঘুম বাধাপ্রাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় সম্পূর্ণ জেগে থাকে, বিছানায় যেতে চায় না। প্রথম ঘুম অস্থিরতাপূর্ণ, ঘুম থেকে ওঠার আগে গভীর নিদ্রা। রোগী শান্ত, ভদ্র। একগুঁয়ে নয়, পরিবর্তনশীল।
নাক্সভমিকা । Nux-vomica
মানসিক পরিশ্রম, অতিরিক্ত কফি, মদ্যপান, আফিম এবং তামাকের কুফলে নিদ্রাহীনতা। শেষরাত্রে অত্যধিক পড়াশোনার ফলে অনিদ্রা; সন্ধ্যায় ঘুম পায়, রাত তিনটে-চারটে পর্যন্ত জেগে থাকে; সকালে স্বপ্নযুক্ত ঘুম তা’ থেকে জাগানো কষ্টকর। নাক্সভমিকার রোগী ক্রোধপ্রবণ এবং অত্যধিক সংবেদনশীল।
আর্নিকা । Arnica
অত্যধিক ক্লান্ত, ঘুমোতে চায়। বিছানা শক্ত অনুভব করে, শুয়ে থাকলে শরীর ভীষণ ব্যথাযুক্ত মনে হয়। নিরাময়ের জন্য নড়াচড়া করে। শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম ও খাটুনির জন্য অনিদ্রা।
আর্সেনিক এল । Arsenic album
মধ্যরাত্রির পর নিদ্রাহীনতা সহ অস্থিরতা এবং গোঙানি। উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। আর্সেনিকের রোগী খুঁতখুঁতে, উদ্বেগপূর্ণ, অস্থির প্রকৃতির। সাধারণত শীতকাতুরে। সর্বদা অল্প অল্প জলের পিপাসা থাকে ৷
ওপিয়াম । Opium
ঘুম ঘুম ভাব কিন্তু ঘুমোতে পারে না। নিদ্রাহীনতার সঙ্গে শ্রবণের তীক্ষ্ণতা। দূরবর্তী ঘড়ির শব্দ এবং মোরগের ডাকে জেগে ওঠে। বিছানা এত গরম মনে হয় যে, তাতে শুতে পারে না, শীতল স্থানের জন্য নড়াচড়া করে ।
সিফিলিনাম । Syphilinum
নিদ্রাহীন রাত্রি, ভীতিপ্রদ রাত্রি, সকল কষ্টই রাত্রে বৃদ্ধি।
থুজা ।Thuja
নাছোড়বান্দা নিদ্রাহীনতা। টিকা নেওয়ার কু-ফল। স্থির ধরনের ব্যক্তি।
ক্যাকটাস ।Cactus
নিদ্রাহীনতা, দমবন্ধ করা চাপবোধ এবং বুক ধড়ফড়ানি।
ইগ্নেশিয়া। Ignatia
শোক, দুঃখের ফলে নিদ্রাহীনতা ।
সালফার । Sulphur
ভোর তিনটে, চারটে, পাঁচটায় জেগে ওঠে পরে আর ঘুমোতে পারে না। যদি ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম থেকে জাগানো যায় না। সর্বাপেক্ষা বেশি এবং গভীরতম ঘুম হয় শেষ সকালে। পায়ের তলা রাত্রে জ্বালা করে, সেজন্য পা বাইরে রাখতে হয়। বিছানার গরমে বৃদ্ধি।
প্যাসিফ্লোরা ইন্ডিকা । Passiflora incarnata
এটিও ঘুমের একটা ভালো ওষুধ।