Home মানসিক স্বাস্থ্য মরচে পড়ছে মগজাস্ত্রে ! শান দেবেন কিভাবে ? | Brain Exercises |...

মরচে পড়ছে মগজাস্ত্রে ! শান দেবেন কিভাবে ? | Brain Exercises | Neuroplasticity

0

ক্ষমতা—ইতিহাস কিন্তু তা-ই বলে। কিন্তু বয়সের অব্যর্থ, অবশ্যম্ভাবী আক্রমণে শরীরের ত্বক যখন লোলচর্ম, তখন সমস্ত স্বাভাবিক নিয়মকে তুড়ি মেরে এই অভাবনীয় মানস-ক্ষিপ্রতার গোপন রহস্যটা কী? সে কি কোনও এক বিশেষ মননচর্চা, যার দৌলতে এই সজাগ সতেজ মস্তিষ্কের বিস্ময়কর ক্রিয়াকলাপ ? ঘটনা কিন্তু তাই বলছে। আর তার প্রমাণ স্নায়ু-মনোবিদ্যার অধুনা গতিমুখে। আরও বিশদে যাবার আগে আমরা বরং মনন-অনুশীলনের এই পদ্ধতিগুলোকে মস্তিষ্ক-এর চর্চা হিসাবেই দেখি। আর কিছু না হোক, এতে বিজ্ঞানের সংযোগটা বোঝা কিছুটা সহজ হতে পারে।

মস্তিষ্কচর্চার এই সাফল্য দাঁড়িয়ে আছে মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ওপর। যেমন- 

নিউরোপ্লাস্টিসিটি (Neuroplasticity): হতাশ হবার কিছু নেই। যতই আফশোস করুন না কেন, জন্মগত প্রাপ্ত এই মস্তিস্কটি আপনার ভবিতব্য, তার হাত থেকে আপনার পরিত্রাণ নেই ।

আধুনিক বিজ্ঞান সেই ভ্রান্ত ধারণার গালে এক সপাটে চড়। সোজাভাবে বললে, মস্তিষ্কের কিছু অংশের অভ্যন্তরীণ স্নায়ুকোষ (নিউরোন)- এর আমৃত্যু বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা থাকে।শুধু তাই নয়, স্নায়ুকোষে কোষে সংযোগও অপরিবর্তনীয় নয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলে এই বিভিন্ন স্নায়ু কোষের জোটবন্ধনের (নেটওয়ার্ক) ভিত্তিতে। মস্তিষ্কের যাবতীয় কাজকর্ম আর তার ফলশ্রুতিতে আমাদের ব্যবহার, আচার-আচরণ, চরিত্র বৈশিষ্ট্য—সবই মূলত নির্ভর করে থাকে এই বিভিন্ন জোটবন্ধনের ওপর। এক একটি স্নায়ুকোষ অন্তত দশ হাজার অন্য স্নায়ুকোষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন কররা ক্ষমতা ধরে। মোটামুটি যদি ধরে নেওয়া যায়, একটা পরিণত মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সংখ্যা প্রায় একশো বিলিয়ন, তাহলে চোখ বন্ধ করে একটু ভাবার চেষ্টা করুন, কী অবিশ্বাস্য স্নায়ু-জোটবন্ধনে বাঁধা থাকে আমাদের ব্রেন। । কিন্তু মজার ব্যাপার, নিউরোনদের মধ্যে এই সংযোগ সড়ক কিন্তু একেবারেই অনড়, অটল, অপরিবর্তনীয় নয়, এদের মধ্যে ক্রমাগত পরিবর্তন চলতে থাকে। যেমন ধরুন, পার্কসার্কাস থেকে চিংড়িঘাটা একটাই উড়ালপুল, এর বাইরে কিছু হবার নয়, অন্তত ব্রেনের ব্যাপারে এইরকম কিছু অলঙ্ঘনীয় নিয়ম নেই, অভিজ্ঞতা-পরিবেশ- অনুশীলনের প্রভাবে স্নায়ুপথ তৈরি হতে কোনও বাধা নেই। অন্তর্নিহিত এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটিরই নাম নিউরোপ্লাস্টিসিটি। অর্থাৎ ব্রেন পরিবর্তনশীল, বেশ কিছুটা স্থিতিস্থাপক, আগেকার ধারণা অনুযায়ী অনড়, অটল এক অচলায়তন মোটেই নয়।

ইউজ ইট অর লুস ইট (Use it or lose It) : ধরুন নতুন অভিজ্ঞতা বা ব্রেনচর্চার মধ্যে দিয়ে একটা নতুন স্নায়ুপথ তৈরি করা গেল। কিন্তু এই নতুন সড়কটি যে স্থায়ী হবেই, এমন গ্যারান্টি কিন্তু নেই। অর্থাৎ ‘মোদ্দা ব্যাপারটা হল, ক্রমাগত চর্চা করা, তবেই কোনও একটা নতুন তৈরি হওয়া স্নায়ুজোট স্থায়িত্ব পেতে পারে। তা না হলে অন্যভাবে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটতে মোটেই সময় লাগার কথা নয়। যে কারণে কোনও ভালো অভ্যাস আপনি একদিনে স্বভাবজাত করতে পারেন না। দরকার নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিচর্যা ও অনুশীলন।

নিউরোন দ্যাট ফায়ার টুগেদার ওয়্যার টুগেদার (Neuron that fire together wire together): কোনও একটা কাজের জন্য নির্দিষ্ট স্নায়ুকোষগুলো একসাথে যদি ক্রিয়াশীল হয়, তবেই সেই জোটবন্ধন সম্ভব, নয়তো নয়। একইসাথে আপনি মেডিটেশন করছেন আর পাশাপাশি মাঝে মাঝে চোখ খুলে মোবাইলে ‘হোয়াট্স অ্যাপ’ চেক করছেন দুটো সম্পূর্ণ আলাদা কাজ। ফলে তাদের আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট স্নায়ুপথ দুটো বিপরীতধর্মী কাজ একসাথে করার ফলে কোনো কাজটাই সুষ্ঠুভাবে হয় না। ফলে নতুন কেনো স্নায়ুপথ তৈরি হবার সম্ভাবনা কম। স্নায়ুকোষ তার আলাদা আলাদা স্নায়ুপথ দিয়ে তাদের মস্তিষ্ক চর্চার সাফল্য দাঁড়িয়ে আছে ওপরের ওই বিশেষ শর্তগুলোর ওপর।

এবার প্রশ্ন, এর ফলে আমাদের কী কী বিষয়ে উন্নতি ঘটার সম্ভাবনা। স্মৃতিশক্তি, যুক্তিবোধ, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, গাণিতিক উৎকর্ষতা, মনোযোগ, মানসিক অস্থিরতা বা উদ্বেগের উপশম এবং মানসিক অবসাদ থেকে উত্তরণ।

যে যে সমস্যায় মস্তিষ্কচর্চার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী

ছোটবয়সে বা কৈশোরে কিংবা পড়াশুনোর সময় : এ.ডি.এইচ.ডি (ADHD) অর্থাৎ অমনোযোগ—অতিরিক্ত চঞ্চলতার সমস্যা, বিভিন্ন ডিসলেক্সিয়া ও লার্নিং ডিসঅর্ডার, পরীক্ষাভীতি, স্মৃতিশক্তির সমস্যা, রাগ বা জেদ ইত্যাদি ।

বড়দের ক্ষেত্রে: টেনশন (Anxiety disorder), মানসিক অবসাদ (Depression), মাদকাসক্তি (Addiction disorder), রাগ প্রশমন (Bipolar disorder) ইত্যাদি।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে : অবশ্যই স্মৃতিপুনরুদ্ধারে : (Dementia-এর ক্ষেত্রে), হতাশা-উদ্বেগ-অবসাদে স্মৃতির মূলত তিনটি অংশ—মনোযোগ (Attention), স্মৃতি গচ্ছিত রাখা (Storage), স্মৃতি পুনরুদ্ধার (Retrieve)।

Neuroplasticity

স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে মনোযোগ বাড়ানো যাবে কীভাবে 

  • মন দিয়ে যা শুনছেন বা পড়ছেন, একবার জোরে জোরে আউড়ে নিন।
  • নিয়মিত শব্দজব্দ, সোদোকু খেলুন । 
  • ধাঁধার সমাধান করুন ।
  • রোজ খবরের কাগজ পড়ুন। সম্ভব হলে একটা নয়, একাধিক।
  • সকালের পড়া খবরের থেকে অন্তত তিনটে শিরোনাম সন্ধেবেলায় ডায়রিতে লিখুন। 
  • নিয়মিত বইপড়ার অভ্যাস করুন।
  • দাবা খেলুন।
  • সেই সমস্ত ভিডিও গেমস খেলতে পারেন যেগুলোতে মাথা খাটাতে হচ্ছে।
  • নানাভাবে মস্তিষ্ককে সতর্ক করার চেষ্টা করুন।

এর জন্য বিভিন্ন ইন্দ্রিয়কে সজাগ করুন । – যেমন—

গন্ধ বা স্বাদ : চেনা ছকের বাইরে গিয়ে মাঝে মধ্যে নতুন নতুন রান্নার পদ চেখে দেখুন ও রান্নার ঘ্রাণ নিন। তাতে ‘অর্ধভোজন’ হবে কি না জানি না, কিন্তু স্বাদকোরক ও ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয় সজাগ হবার ফলে আপনার মনোযোগ বাড়ার সম্ভাবনাই যথেষ্ট। কিংবা অচেনা ‘সুগন্ধি (পারফিউম)-এর ঘ্রাণ পরখ করুন।

দৃশ্য : দর্শনেন্দ্রিয়কে কিছু নতুনত্ব দিতে সিনেমা দেখুন। নতুন বেড়ানোর জায়গা খুঁজে ‘দেখার’ স্বাদবদল করুন। পুরনো ফটো অ্যালবাম খুলে স্মৃতিরোমন্থন করুন ।

শব্দ : প্রতিদিন গান-বাজনা শোনার অভ্যাস করুন। রোজ কিছুক্ষণ করে বাড়ির বাগানে বা ছাদে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির শব্দ শুনুন।

স্মৃতি মজবুত করতে তথ্যকে মজাদার করুন। যেমন ছড়া বেঁধে, অনেকগুলো নাম বা সূত্র মনে রাখতে তাদের আদ্যক্ষর দিয়ে Acronym /Mnemonics-এর ব্যবহার। ধরুন রামধনুর সাতটা রং মনে রাখতে ‘VIBGYOR’ মনে করা।

কোনো কিছু মনে রাখতে সেই তথ্য বা পাত্র- পাত্রী অথবা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য কোনও কিছুকে সংযোগ করানো আর সেটা মাঝে মাঝেই মনে করা। ধরা যাক, সুতপাকে আমি মনে রাখতে চাই। সুতপা, মানে কোঁকড়া চুলের ওই বাচ্চা মেয়েটা তো? আর সেই দৃশ্য বা অবয়বের মন- ছবিটা বারবার মনে করা।

সুতরাং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা এক ধরনের মস্তিষ্কের ব্যায়াম। শুনতে সহজ, মনে হতে পারে এ আর এমন কী, সবাই তো পারে! নিশ্চয়, পারেই তো, কিন্তু করে কে? শুধু তাই নয়, মাথায় রাখতে হবে, এই নিতান্ত সাধারণ সহজ ব্যায়ামগুলো মর্জিমাফিক, এক আধদিন করলে বিশেষ লাভ হবার কথা নয় ।

কীভাবে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়কে আরও সজাগ করে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার উৎকর্ষ বাড়ানো যায়, এবার দেখি—

শোনা : কোনো একটা ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডার অন করে চারপাশের শব্দগুলো রেকর্ড করুন । পরে কোনো একটা জায়গায়, যেমন পার্কে বা অফিস ক্যান্টিনে একই জিনিস করুন আর সময়মতো বিভিন্ন শব্দের উৎস সন্ধান করুন।

গন্ধ : সকাল মানেই ধোঁয়া ওঠা চা আর তার নির্দিষ্ট গন্ধ। আপনি হয়তো নিজেও জানেন না, কবে থেকে আপনার ‘ব্রেন’ এই অভ্যাসের পুনরাবৃত্তিতে এই গন্ধকে সকালের ওই বিশেষ সময়টির সাথে একটা ‘ডিফল্ট মোড’-এ গাঁটছড়ায় বেঁধে ফেলেছে। আর যাই হোক, চেনা গন্ধ-সংবেদনবাহী স্নায়ুপথ ধরে মস্তিষ্কের নড়াচড়া হওয়া মুশকিল, কেননা ওতে কোনো নতুনত্ব নেই। কাজেই মস্তিষ্কের এই বিশেষ অংশটিতে  স্নায়ুপ্রবাহ বাড়াতে হলে ‘ব্রেন’-এর কাছে অন্য কোনো অচেনা গন্ধ মেলে ধরুন। হালকা কিছু সুগন্ধি, ‘লেমন’ বা ‘ল্যাভেন্ডার’ কিনে তার ছিপি খুলে নাকের সামনে ধরুন আর প্রাণভরে শুঁকুন বেশ কিছুক্ষণ। সপ্তাহখানেক একই গন্ধে অভ্যাসের পর বদলে ফেলুন অন্য কোনো সুগন্ধিতে। ভাবছেন, বোকা বোকা, কিন্তু অবাক হলেও সত্যি, এটাও আপনার ‘ব্রেনে’র কাছে নতুন একটা ব্যায়াম।

স্পর্শ: চোখ বন্ধ করে হাতের আঙুল নিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ‘কয়েন’ গুলো বুঝতে চেষ্টা করুন—কোনটা কী। কিংবা একই জামাকাপড়ের ওয়ার্ডরোব ঘেঁটে খুঁজে নিন পছন্দের জামাটি। অথবা ধরুন না-তাকিয়ে মুখে খাবার নিয়ে ঠোঁট বা জিভ দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করা কোনটা কী খাবার, তারমধ্যে উপাদান কী কী।

এবার এমন একটা ব্যায়াম যা দিয়ে খুঁজে নিতে পারবেন আপনার ভিতরের লুকোনো সৃষ্টিশীল সত্তাটিকে। পুরনো কোনো বেড়ানোর ছবি বা ফ্যামিলি অ্যালবাম থেকে বের করে আনা কোনো একটা গ্রুপ ফটো উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখুন দেওয়াল ক্যালেন্ডারের ওপর কিংবা আপনার রেফ্রিজারেটারের দরজায়। এবার ভাবুন ছবিটা কবেকার, কোথাকার আর ঘটনাটাই বা কী ছিল। সোজা করে রাখা ফটো চোখের সামনে এলে, অবধারিতভাবে আপনার মস্তিষ্কের বাম দিকের অংশ সক্রিয় হয়ে উঠবে, আর আপনি ভাববেন—ও, ওই তো অমুক অমুক আছে ওটাতে। কেননা ‘ব্রেন’-এর বামদিকের অংশ বেশ কেজো, যুক্তিবাদী, তবে তার এত তলিয়ে ভাবার, চিন্তার সময় নেই। যথাযথ তথ্য সরবরাহ করেই সে খালাস। আবেগের রং মিশিয়ে কিছু ভাবতে গেলে, ছবির প্রেক্ষাপট, তার চরিত্রদের সাথে মিলিয়ে যে পুরনো ছবির গল্প, সেটা কিন্তু ব্রেন- এর ডান দিকের অংশের কাজ। ফটোটা উল্টো রেখে দেখা বা চেনার অভ্যাস করলে তবেই সেই আড়ালে থাকা ডান দিকের মস্তিষ্ককে কাজে লাগানো সম্ভব। কে বলতে পারে, আপনার মধ্যেকার লুকোনো শিল্পীসত্তা এইরকম কিছু অভ্যাসের হাত ধরে বেরিয়ে আসবে না !

ভাবছেন, যাঃ ! এগুলো আবার ব্যায়াম নাকি। উঁহু, অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি, এগুলো একেক ধরনের মস্তিষ্কচর্চা। লেখাপড়া, অঙ্ক করা, পাজল, করার মতোই। কেউ কেউ বলেন ‘নিউরোবিকস’ (Neurobics) এগুলোকে । কেননা, বারংবার অনুশীলনে এই সব সাধারণ, সহজ খেলাগুলোই তৈরি করে দিতে পারে ভালো অভ্যাসের নতুন নতুন স্নায়ুপথ (Neural pathway)। Neuroplasticity- র শক্তিতে ভর করেই অনেক কম্পিউটার- নির্ভর ‘ব্রেন এক্সারসাইজ’ বিদেশের বাজারে বিকোচ্ছে দেদার, কিন্তু এতদূর ভাবার’ই বা দরকারটা কি, হাতের কাছেই যখন সহজলভ্য এমন অনায়াসে করা যায় বেশ কিছু ‘ব্যায়াম’ ! . . . “ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া” . . . ররীন্দ্রনাথের সতর্ক সাবধানবাণী কী করেই বা ভুলে যাই আমরা, তাই না?

টেনশন বা উত্তেজনা কমাতে মাইন্ডফুলনেস ব্যায়াম

এই ব্যায়ামগুলো কীভাবে কাজ করে, বুঝতে গেলে, আসুন একটু দেখি নিই, বিবর্তনের হাত ধরে ‘ব্রেন’-এর পরিকাঠামোগত বিভাজন।

মস্তিষ্কের পিছনের অংশ (Brain stem)। এই অংশটাতে জন্ম নেয় বিভিন্ন ইনস্টিংক্টস্। মস্তিষ্কের মাঝামাঝি অংশ (Midbrain): যেটা আবেগের আঁতুড়ঘর। মস্তিষ্কের সামনের অংশ (Cortex brain) : যা আমাদের যুক্তিবোধ সরবরাহ করে। এই সেই অংশ যার উত্তরাধিকার আমাদের আলাদা করে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে।

মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চা আদতে এই কর্টেক্স বা যুক্তিবাদী ‘ব্রেন’ কে আরও উন্নত, সম্পদশালী করার ব্যায়াম। কেননা, ব্রেনস্টেমে তৈরি হওয়া ইনস্টিংক্ট বা মিডব্রেনে জন্ম নেওয়া আবেগ— কোনোটাই পরিবেশ-পরিচিতি অনুযায়ী সম্পূর্ণ সঠিক নাও হতে পারে। কাজেই অনিয়ন্ত্রিত আবেগ বা অপরিণামদর্শী ইনস্টিংক্ট আমাদের টেনে নিয়ে যেতে পারে সর্বনাশের চোরাবালিতে। সেই হাতছানিকে উপেক্ষা করে যুক্তিগ্রাহ্য, বোধসমৃদ্ধ পরিণত ব্যবহার বা আচার-আচরণের জন্য আমাদের উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় সেই কর্টেক্সের দিকে। মননচর্চার অধিকাংশ ব্যায়ামের লক্ষ্যই সেই কর্টেক্সের স্নায়ুসংবেদন বাড়ানো।

এই ব্যাপারে আজকাল মাইন্ডফুলনেসের সফল প্রয়োগ করছে এমন একজন মনোবিদ শ্রী অনুভব মৈত্র কী বলছেন দেখা যাক—

“এই থেরাপিতে শেখানো হয় আমাদের মনকে কঠিন সময়ে শান্ত ও বর্তমান কাজে ফোকাস রাখতে ও নিমগ্ন হয়ে কাজটা করতে। এই পদ্ধতিকে অনুসরণ করলে খুব সহজেই মানসিক চাপকে এড়ানো যায় ও জীবনকে আনন্দময় করে তোলা যায়।”

মাইন্ডফুলনেস থেরাপি একটা সহজ ব্যায়াম —মাটিতে বা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসুন । চোঁখ বন্ধ করে শরীরে অনুভূতির দিকে মন দিন। মনকে চিন্তা থেকে সরিয়ে আনুন। এরপর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ওপরে মনোনিবেশ করুন এবং সেই অঙ্গে ঘটে যাওয়া অনুভূতির দিকে ধ্যান রাখুন। প্রথমে বাম পায়ের আঙুল দিয়ে শুরু করে ডান পায়ের আঙুল, তারপর বাম পায়ের চেটো, তারপর ডান পায়ের চেটো। এইভাবে হাঁটু কোমর, বুকের ছাতি, ডান হাতের আঙুল, বাম হাতের আঙুল, চোয়াল, কপাল ও মাথার ব্রহ্মতালুর ধ্যান করুন। এইভাবে মাইন্ডফুলনেস থেরাপির বিভিন্ন এক্সারসাইজ নিয়মিত ভাবে অভ্যাস করলে মনকে চিন্তামুক্ত রাখা যায়।

মনোনিবেশের ক্ষমতায় ব্রেনের ভূমিকা

আধুনিক গবেষণার সূত্র ধরে আমরা জানতে পারছি, মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল লোব (PFL)-এর বেশ কিছুটা জায়গা ঠিকমতো কাজ না করলে মনোযোগের অভাব দেখা দিতে পারে। সুতরাং PFC-কে উন্নত করার লক্ষ্য সামনে রেখে বেশ কিছু সাধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করলে মনোযোগ বাড়ানো দুরূহ কোনো ব্যাপার নয়। যেমন-

একটা চেয়ারে চুপ করে বসে থাকার অভ্যাস করুন। খুব সহজ ভাবছেন, তাই তো? কিন্তু যতটা অনায়াস ভাবছেন, আদতে কিন্তু তা নয়। শরীরের কোনও মাংসপেশিকে (শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া) না নাড়িয়ে সম্পূর্ণ চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকা বেশ কষ্টকর। সেটাই করার চেষ্টা করুন। প্রথমে মিনিট পাঁচেক, তারপর আস্তে আস্তে বাড়িয়ে অন্তত ১৫ মিনিট।

চেয়ারে শান্তভাবে বসে ডান হাত সম্পূর্ণ প্রসারিত করে কাধের উচ্চতা অবধি এনে আঙুলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন ১ মিনিট। এবার একইভাবে বাঁদিকেও।

ডান হাত দিয়ে ছোট্ট জলভর্তি গ্লাস ধরে সোজা নাক বরাবর প্রসারিত করুন আর স্থির হয়ে মিনিট খানেক এক দৃষ্টিতে গ্লাসটার দিকে চোখ রাখুন। এবার বাঁ হাত বাড়িয়েও একই ব্যায়াম।

চেয়ারটাকে সামনে টেনে নিয়ে একটা টেবিলের কাছে আনুন, ও দুটো হাতের কনুই ঠেকিয়ে রাখুন। এবার পর্যায়ক্রমে ডান ও বাঁ হাতের আঙুলগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন। হাতের আঙুলগুলো মুঠো করুন ও খুব আস্তে আস্তে খুলুন। সমস্ত মনোযোগ এই কাজটাতেই কেন্দ্রীভূত করুন যেন পৃথিবীতে সেই মুহূর্তে এটাই একমাত্র কাজ আপনার। দুই হাতের মুঠো খোলা ও বন্ধ করা-পালা করে, প্রথমে পাঁচবার, পরে বাড়িয়ে দশবার।

যেকোনো পার্কে বা বাগানে আধঘণ্টা হাঁটুন আর অনুভব করার চেষ্টা করুন কত বিভিন্ন ধরনের গন্ধ আপনার নাকে আসছে। এবার কোনও একটা বিশেষ গন্ধকেই শুধু ফোকাস করুন, চেষ্টা করুন অন্যান্য গন্ধের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করতে।

শুয়ে পড়ুন আর সমস্ত মাংসপেশিকে শিথিল করে নিন। এবার শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে ফোকাস করুন। কীভাবে প্রতিটা শ্বাস ও প্রশাসের সঙ্গে বুক ও পেট ওঠানামা করে, নজর করুন সেই দিকে। এবার ফোকাস করুন হৃদস্পন্দনের ওপর। মনে মনে কল্পনা করতে থাকুন, একটা বিরাট জলাধার থেকে পাইপ বেয়ে সমস্ত দূরবর্তী অঞ্চলে জল পৌঁছনোর মতো কীভাবে হৃৎপিন্ড থেকে রক্ত নির্গত হয়ে ধমনী বেয়ে অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে মাথা থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে শরীরের অন্যান্য অংশ হয়ে পায়ের আঙুল পর্যন্ত। শুধু ভাবনা নয়, মনের চোখ দিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে থাকুন নিবিড় ঔৎসুক্যে।

শুধু ফ্রন্টাল বা প্রি-ফ্রন্টাল নয়, ব্রেনের আর একটি অংশ যার নাম সেরিবেলাম (শরীরের ভারসাম্য যেমন রক্ষা করে, কেউ কেউ বলছেন, মনোযোগের সার্কিটেও সেরিবেলামের অলক্ষ্য উপস্থিতি)— তার উৎকর্ষ বাড়ানো যেতে পারে বেশ কিছু ব্যায়াম করে। যেমন-

দু’ হাতে দুটো কলম নিলেন বা পেনসিল, আর নিলেন দুদিকে দুটো বোর্ডের ক্লিপে আটকানো কাগজ। এবার একইসঙ্গে দুদিকে আঁকুন দুটো বৃত্ত, অথবা ত্রিভুজ অথবা চতুর্ভুজ । এভাবে করার পর, এবার মিলিয়ে মিশিয়ে করার চেষ্টা করুন। অর্থাৎ ডান হাত দিয়ে গোল করেছেন তো বাঁ হাত দিয়ে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ এইরকম। স্বভাবগত ভাবে আপনার ডানহাত – সক্রিয় বলে হয়তো এই আঁকিবুকি বাঁহাতে মোটেই জুতসই হবে না। তা হোক। দিনে কিছুক্ষণ, ধরুন ১৫ মিনিট, টানা এই ব্যায়ামটা করলে, মনোযোগ, ভারসাম্য, মন-দৃষ্টি-হাত- এদের সমন্বয় সবই বাড়তে বাধ্য।

শুধু বড় বয়সে নয়, ছোটদের অমনোযোগের ক্ষেত্রেও বেশ কার্যকরী হতে পারে এই ধরনের ব্যায়াম।

হাসুন। গোমড়ামুখো ‘রামগরুড়ের ছানা’রা সাবধান। হাসির মতো অনন্য সাধারণ একটা সম্পদ থেকে তারা বঞ্চিত। আশ্চর্য লাগলেও সত্যি, হাসি খুব কার্যকরী একটা ব্রেনচর্চা, যার নিয়মিত ব্যবহারে এমনকী আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও (ইমিউনিটি) বাড়ার সম্ভবনা। শুধু তাই নয়, হাসির ফলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে প্রবাহিত হয় ‘এনডরফিন’, আপনার সহজাত স্টেসরোধী যৌগ।

মুশকিল হল স্বতঃস্ফূর্ত হাসির আবহ না পেলে আপনি কী করবেন? সেক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ, চোখ-কান খোলা রাখুন, আপনার চারপাশে নিত্যদিনই কিন্তু ঘটে চলেছে হরেকরকমের মজাদার ঘটনা, হয়তো খুব নজর করে খেয়াল করেননি এতদিন। এবার দেখুন, কাজ সেরে বাড়ি ফিরে সেগুলো ভাবুন, অন্যদের বলুন বা অভিনয় করে দেখান। কখন যে আপনার অজান্তে আপনার ‘ব্রেন’ জবরদস্ত ‘Gym’ পেয়ে গেল, বুঝতেই পারবেন না।

মাইন্ডফুলনেস শুধু নয়, যেকোনও মেডিটেশনই মনের জন্য অনবদ্য ব্যায়াম। এ হল সেই আতসকাচ যার তলায় রেখে দেখে নেওয়া মনের আনাচ-কানাচ, বিবর্তনের হাত ধরে পাওয়া আপনার মস্তিষ্কের যে ‘অ্যানিম্যাল ব্রেন’ অংশ— তার আড়ঘরে জন্ম নেওয়া আপনার লোভ- হিংসা-নীচতা-ক্রুরতা-দীনতা—এসবকিছুকে খুঁজে নেওয়া আর তার থেকে তৈরি হওয়া অস্থিরতা-অশান্তির হাত থেকে উত্তরণের পথ।

‘মেডিটেশন’ কি বিজ্ঞান নাকি, এই সংশয়ী নিন্দুকদের কাছে বিজ্ঞানের উত্তর—অবশ্যই। কেননা, বিজ্ঞানসম্মত ‘মেডিটেশন’ আপনাকে পৌঁছে দিতে পারে আলফা ব্রেনওয়েভ’-এ, যেটা মনের সবচেয়ে প্রশান্ত, স্থিতধী অথচ সতর্ক অবস্থার নামান্তর (অনেকগুলো ব্রেনওয়েভ থাকে, যেগুলো মাপা যায় ই.ই.জি করে, তার মধ্যে আলফা (α) তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি মনের সবচাইতে শান্ত স্তর)।

কেন মনন-অনুশীলন করব?

কেননা, এছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই । আমরা কেমন থাকব, তার দায় অনেকটাই বাইরের পৃথিবীর বা আমাদের আশপাশের পরিবেশের, যার ওপর পৃথিবীর বা আমাদের নিয়ন্ত্রণ। আমরা শুধু অনেকটাই প্রভাব ফেলতে পারি ‘আমার আমি’কে (জন্মসূত্রে লব্ধ জেনেটিক উত্তরধিকারকে শিরোধার্য করেও)। ভালোথাকার অনলস পরিচর্যায় এই ‘আমার আমি’ হতে পারে আরও পরিণত, মননঋদ্ধ, স্থিতধী, প্রায় ধীমান। জীবনশৈলী বদলের সেই কঠিন পথে মন- অনুশীলন বা স্নায়ু বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ব্রেন এক্সারসাইজ’ একটা বড় পদক্ষেপ মাত্র। তার জন্য যেমন জরুরি সঠিক বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা, উপলব্ধি, প্রত্যয় আর আশাবাদ, তেমনই জরুরি তার নিবিষ্ট-নিবিড় অনুশীলন। কাজটা কঠিন, সন্দেহ নেই, কিন্তু ভালো অভ্যাস তৈরির পথটা কবেইবা খুব সহজ ছিল ?

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version