সভ্যতার আদিম যুগ থেকেই মানুষ হার্নিয়া রোগটার সাথে পরিচিত। মিশরীয় প্যাপিরাসে অবধি এর বিবরণ মেলে। অথচ সাধারণভাবে রোগটির কারণ, গতি-প্রকৃতি, নিদান সম্বন্ধে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এখনও মেটেনি। হাৰ্নিয়া কথাটার সঙ্গে মানুষ ক্রমেই যেন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হার্নিয়া হলে ফেলে রাখলেই বিপদ। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে কিন্তু এই রোগের চিকিৎসায় নীরোগ হবার যথেষ্ট সুযোগ আছে। তাই ভয় পাবার কিছু নেই। হ্যাঁ, বারংবার হার্নিয়া হতে পারে, তাই বলে অযথা অবহেলা নয় ।
Table of Contents
হার্নিয়া কেন হয় | What Causes Hernia
শরীরের অন্তঃস্থিত কোনো অংশ যদি তার বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে ঠেলে বেরোনোর উপক্রম করে তখনই তাকে হার্নিয়া বলে ধরা হয়। মনে রাখতে হবে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হার্নিয়া তখনই হতে পারে কিংবা বারবার হতে পারে যখন সেই জায়গাটির অভ্যন্তরীণ চাপ তার আবরণীর ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয় ।
হার্নিয়ার প্রকারভেদ | Types of Hernia
হার্নিয়া শরীরের বাইরের দিকে হলে একটি ফোলা অংশ দেখা যায়, তাকে বলে এক্সটার্নাল হার্নিয়া। যদি এই একই প্রক্রিয়া শরীরের ভেতর দিকে হয় তখন বুঝতে হবে ইন্টার্নাল হার্নিয়া। তখন রোগটা বিচার করা অনেক সময়ই বড় জটিল ও কষ্টকর হয়। সাধারণভাবে হাৰ্নিয়া সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায় কুঁচকির অংশে বা পেটের বিভিন্ন অংশে। নাভির নীচে শরীরের দু’পাশে কুঁচকির ওপরে দুটো দুর্বল স্থান স্বাভাবিকভাবেই থাকে। পুঁশো সাহেবের নামাঙ্কিত এই জায়গাগুলোকে মায়োপেক্টিনিয়াল অরিফিস বলে। কুঁচকি বা জঙ্ঘার বিভিন্ন ধরনের হার্নিয়াগুলো (ডাক্তারি পরিভাষায় ডাইরেক্ট ইঙ্গুইনাল, ইনডাইরেক্ট ইঙ্গুইনাল বা ফেমোরাল) এই জায়গাগুলো থেকেই শুরু হয়। বিশেষ করে কোনো কারণে যদি এখানকার কোষকলার ক্ষমতা কমে যায় কিংবা দুর্বল হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, শরীরের মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে যে কোনো অংশে হার্নিয়া হতে পারে। যেমন ধরা যাক নাভিস্থানে যে হার্নিয়াগুলো হয় অর্থাৎ অ্যাম্বিলিকাল হার্নিয়া (Umbilical hernia)। এটা সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দুর্বল স্থানটি ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেলে হার্নিয়ার স্থানটি ছোট হতে হতে এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। যদি কোনো কারণে বন্ধ না হয় তাহলে অপারেশনের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। আর বয়স্ক কিংবা মাঝবয়সীদের ক্ষেত্রে নাভির পাশ দিয়ে যে হার্নিয়া হয় সেটা বারংবার হতে পারে। এগুলোকে বলে প্যারা অ্যাম্বিলিকাল হার্নিয়া, এ ধরনের হার্নিয়া দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়, ছোট হয় না। এই ধরনের হার্নিয়াগুলো অপারেশন করিয়ে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। আবার এও দেখা গেছে যে, অনেক সময় অপারেশন করার পরে সেই জায়গাটি ফুলে যায় আবার হার্নিয়া হতে থাকে। একে বলা হয় ইনসিশনাল হার্নিয়া (Incisional hernia)। সাধারণত পেটের মধ্যভাগেই এগুলো বেশি পাওয়া যায়। যদিও পাশের জায়গা দিয়ে হওয়া ইনসিশনাল হার্নিয়া অপরিচিত রোগ নয়।
হার্নিয়া মানেই কি অপারেশন
প্রথমেই বলব হার্নিয়া আছে জানতে পারলেই অপারেশন করিয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। এই অসুখের স্বাভাবিক নিয়ম হল বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। কারও ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি আস্তে আস্তে হয়। এমনকী দশ- পনেরো বছর ধরেও এই বৃদ্ধিটা হতে পারে। তখনই অনেকের আবার মনে হয় রোগটা ফিরে আসছে। ডাক্তারের পরামর্শ জরুরি। আবার কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে তিন-চার মাসের মধ্যে রোগের দ্রুতবেগে বৃদ্ধি। হার্নিয়া আছে জানতে পারলে তাই বজ্রপাতের অপেক্ষায় বসে না থেকে অপারেশন করিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত।
প্রসঙ্গত, অপারেশনের সময় হার্নিয়ায় আস্তরণগুলো একে একে সরিয়ে বর্ধিত অংশটিকে পেটের মধ্যে ফেরত পাঠানো হয়। তারপর আবার আস্তরণগুলোকে পুনরায় আগের মতো করে বসিয়ে দেওয়া হয়। লক্ষ্য থাকে এমনভাবে পুনর্নির্মাণ করা, যাতে ওই জায়গাটির দুর্বলতা হ্রাস পায় এবং আবার হার্নিয়া তৈরি না হয় । শল্যচিকিৎসার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এও জানা গেছে যে বিশেষ কিছু কৃত্রিম তত্ত্ব দিয়ে এই অংশের পুনর্নির্মাণ করলে অপারেশনের ফল ভালো হয়। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার কিংবা বারবার হার্নিয়া হবার সম্ভাবনা কমে যায়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে আরও জানা গেছে যে কৃত্রিম তন্তুর তৈরি জালিকা যেমন পলিপ্রোফিলিন মেশ দিয়ে পুনর্নির্মাণ করলে অপারেশনের ফল আরও ভালো হয়। যদিও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সর্বপ্রান্তে জালিকা দিয়ে অপারেশন এখনও তত জনপ্রিয় নয়। সমগ্র বিশ্বে অবশ্য এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বলে বর্তমানে সমাদৃত। উল্লেখ্য, ল্যাপারোস্কোপি করেও এই জালিকা দিয়ে অপারেশন করা হয় বিভিন্ন হাসপাতালে এবং সব ধরনের হার্নিয়াতে এই ধরনের অপারেশনের উপযোগিতা স্বীকৃত। এই পদ্ধতিতে একই সঙ্গে দু’দিকের হার্নিয়াই অপারেশন করা সম্ভব। তার জন্য কোথাও বেশি কাটতে হয় না। প্রথাগত পদ্ধতিতে অপারেশনের জন্য রোগীকে পুরো অজ্ঞান করার দরকার হয়। কিন্তু ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির জন্য রোগীকে অজ্ঞান করতে হয় না। অপারেশনের স্থানটিকে বিভিন্ন উপায়ে অসাড় করে অপারেশন সম্ভব। না করলে চলবে না। ল্যাপারোস্কোপিক অপারেশনের পর রোগীর যন্ত্রণা-ব্যথা অনেক কম হয়। ছুটি তাড়াতাড়ি হয় এবং রোগী নিজের কাজে দ্রুত ফিরতে পারেন। সেই কারণে ক্রমশ এই পদ্ধতি রোগীদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে হার্নিয়ায় আক্রান্ত রোগীর আর পেট কেটে অপারেশন করার দরকার হবে না। তবে বলতে পারি এর একমাত্র চিকিৎসাই হল অপারেশন ।
হার্নিয়া কি বংশগত? সব বয়সেই কি হতে পারে? | Is Hernia Hereditary?
হার্নিয়া হবার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে । বংশগত সমস্যাও এর মধ্যে আছে। এটা যে কোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে। শরীরের যে- কোনো অংশে এবং বারবার হার্নিয়া দেখা যায়। তবে ভয় পাবার কিছু নেই। হার্নিয়া যখন বাড়তে শুরু করে তখন শরীরের অন্তর্নিহিত অঙ্গটি (ক্ষুদ্রান্ত, বৃহদন্ত্র, ওমেন্টাম নামক অংশ ইত্যাদি) আরও বেশি করে হার্নিয়ার ভিতরে ঢুকতে থাকে।
অসুখের প্রথম দিকে রোগী শুয়ে পড়লে আস্তে আস্তে অঙ্গটি নিজে নিজেই পেটের ভিতর চলে যায় ও হার্নিয়াটি ছোট হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগী নিজেই আঙুল দিয়ে ঠেলে এটাকে ত্বরান্বিত করতে শিখে যায়। এই অবস্থার নাম রিডিউসিবল হার্নিয়া। অনেক সময় ফোলা, জায়গাটা ছাড়া রোগীর কোনো কষ্ট থাকে না। কষ্ট বলতে মাঝেমধ্যে ব্যথা বা একটু ভারভার ভাব অনুভূত হয়। মনে রাখতে হবে, সময়ের সাথে সাথে হার্নিয়ার আস্তরণগুলো গায়ে গায়ে লেগে আটকে যায়, অ্যাডেসনস্ তৈরি হয়। তখন হার্নিয়ার মধ্যেকার অঙ্গগুলো কোনো অবস্থাতেই আর পেটের মধ্যে ফিরে আসতে পারে, না। এই অবস্থার নাম ইরিডিউসিবল হার্নিয়া আবার কোনো কারণে যখন হার্নিয়ায় অন্তর্নিহিত অংশের স্বাভাবিক নড়াচড়া রুদ্ধ হয়ে যায়, তাকে অবস্ট্রাকটেড হার্নিয়া বলে। এই অবস্থায় তীব্র ব্যথা অনুভব হতে পারে। যদি বড় হতে হতে হার্নিয়ায় অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি পায় তাহলে প্রবিষ্ট অংশগুলোর রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একে বলে স্ট্রান্সলেটেড হার্নিয়া। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে হার্নিয়ার মধ্যে প্রবিষ্ট অঙ্গের পচন ‘অনিবার্য। এই অবস্থায় রোগীর প্রাণসংশয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই যে কারণেই হার্নিয়া হোক না কেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা জরুরি। অযথা তুকতাক, জড়িবুটি, ঝাড়ফুঁক না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার। মনে রাখবেন এটা সব বয়সেই হতে পারে। বারংবার হতে পারে।
হার্নিয়া বা হাইড্রোসিল কি এক?
হার্নিয়া ও হাইড্রোসিল একেবারে সম্পূর্ণ আলাদা রোগ। অনেক রোগী এটা গুলিয়ে ফেলেন। হার্নিয়া হল কুঁচকির কাছে তলপেটের মাংসপেশির মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ফাঁক বা ছিদ্র যার মধ্যে দিয়ে পেটের ভিতরকার নাড়িগুলো (অস্ত্র বা ইনটেস্টাইন) স্ক্রোটামের মধ্যে বেরিয়ে আসে এবং আবার ভিতরে ঢুকে যায়। কাশির সময় হার্নিয়া বড় হয় এবং চাপ দিলে ভিতরে ঢুকে গিয়ে ছোট হয়ে যায়। কিন্তু হাইড্রোসিল কাশি হলে বড় হয় না এবং এটাকে চাপ দিয়েও ছোট করা যায় না।