Home মহিলাদের স্বাস্থ্য গর্ভাবস্থার পুষ্টি: গর্ভকালীন অবস্থায় কী খাবেন!

গর্ভাবস্থার পুষ্টি: গর্ভকালীন অবস্থায় কী খাবেন!

আমাদের সমাজে’ ভাগ্যের কি পরিহাস ! শুরুতেই বৈষম্য—কন্যা না পুত্র। সবাই জানে শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। এই ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন নির্ভর করে মায়ের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সচেতনতা ও পরিবেশের ওপর। মা তো আর একদিনেই হওয়া যায় না। তাই কন্যা সন্তান জন্মানোর পর থেকেই তাকে অবহেলা না করে তার সবচেয়ে বেশি যত্ন নেওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। এখনও দেশে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিবাহ হয়, যেখানে তাদের শরীর-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মন সঠিকভাবে তৈরি হয়ে ওঠেনি ; সেখানে এই বিবাহ এবং তার পরিণতিতে মা’র মৃত্যু ও অপুষ্ট বাচ্চা জন্মানো অভিশাপের মতো।

এবারে আসি আসল বিষয়ে। সম্ভব হলে হবু স্বামী-স্ত্রীদের বিশেষ কিছু কিছু জিনিস সম্বন্ধে সচেষ্ট থাকা উচিত।

মেয়েদের যেমন নিয়মিত রজঃচক্র হওয়া, অতিরিক্ত মোটাসোটা, পলিসিস্টিক ওভারি (পি.সি.ও), শরীরে অত্যধিক লোম-ব্রণ, রজঃস্রাবের আগে থেকেই খুব ব্যথা শুরু হওয়া এবং রজঃস্রাব শেষ হওয়া পর্যন্ত তা থেকে যাওয়া (এন্ডোমেট্রিওসিস) ইত্যাদির সঠিক চিকিৎসা বিয়ের আগে থেকেই করিয়ে নেওয়া উচিত। আবার হবু স্বামীর ইরেকটাইল ডিসফাংশন, ইজাকুলেশন অথবা সেই সংক্রান্ত কোনো রকম সমস্যা বা মেডিকেল ডিসঅর্ডার যেমন থাইরয়েডের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, সিফিলিস, গনোরিয়া, হাইড্রোসিল, হার্নিয়া ইত্যাদি থাকলে বিয়ের আগেই তার চিকিৎসা হওয়া উচিত।

আমি আমার প্র্যাক্টিস জীবনে (অন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদেরও) দেখেছি পুরুষ সম্পর্কিত (মেল ফ্যাক্টর) বিষয়গুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভালো রকম পরীক্ষা করা হয় না। যদিও পুরুষদের ব্যাপারটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয় ।

এছাড়া স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই অ্যানিমিয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, থ্যালাসেমিয়া, নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ, থাইরয়েডের সমস্যা, কিডনি ও হার্টের সমস্যা ইত্যাদি আছে কি না তা জেনে নেওয়া উচিত। আজকাল HIV- I & II, HBCAg, HCL টেস্ট বাধ্যতামূলক ।

বাচ্চা নেওয়া মনস্থ করলে তখন থেকেই রোজ একটি করে ফলিক অ্যাসিড (Vit Bg) ট্যাবলেট (1mgm) খেয়ে যাওয়া উচিত। রক্তে ফলিক অ্যাসিডের মাত্রা কম থাকলে বাচ্চা জন্মানোর সময় কনজেনিটাল ডিফেক্ট বা নিউরাল টিউবের সমস্যায় ভুগতে হতে পারে।

বিবাহিত মেয়েদের যাদের নিয়মিত রজঃস্রাব হয় তাদের রজঃচক্রের তারিখ পার হয়ে গেলে (এক সপ্তাহ) প্রেগনেন্সি টেস্ট করে দেখে নেওয়া উচিত যে গর্ভসঞ্চার ঘটেছে কি না।

প্রেগনেন্সি টেস্ট পজেটিভ হলে সরাসরি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। উনি আপনার শারীরিক অবস্থা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি শুনে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নরকম রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা ও আলট্রাসনোগ্রাফি করে, আপনার অবস্থা বুঝে প্রেগনেন্সি প্ল্যানিং করবেন। 

প্রেগনেন্সির সাথে অন্য বিশেষ ধরনের সমস্যা থাকলে তা সমস্যাসঙ্কুল (কমপ্লিকেটেড প্রেগনেন্সি), আর সেসব কিছু না থাকলে তা স্বাভাবিক প্রেগনেন্সির পর্যায়ে পড়ে। যদিও আমরা অভিজ্ঞতায় দেখেছি আনকমপ্লিকেটেড প্রেগনেন্সি বলে কিছু হয় না। কারণ আপাত স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা যেকোনো সময়ে যেকোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

এখন আপাত স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার আলোচনায় যাচ্ছি।

Ready or not, you and your body are about to embark on life’s most fantastic voyage-Pregnancy.

গর্ভসঞ্চার খবরটায় অধিকাংশই আনন্দিত হন ঠিকই, তবে অনেকেই উদ্বিগ্নও হন। এই সময় হরমোনের বিশেষ তারতম্যের ফলে বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

আমরা সবাই জানি যে সুষ্ঠভাবে গর্ভাবস্থার মোকাবিলা করার জন্য এবং একটি সুস্থ বাচ্চার জন্ম দেখার জন্য ভালো এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ও ব্যায়ামের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এর সাথে সাথে তৃতীয় একটি বিশেষ উপযোগী জিনিসের কথা ভুলে যাই। তা হল ভালো ঘুম। ভালো ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, তার সাথে পর্যাপ্ত ঘুমই বাচ্চার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।

কিছু না জানা কথা

মায়ের ফ্যালোপিয়ান টিউবে, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিষিক্ত (ফার্টিলাইজেশন) হওয়ার পর প্রথম কোষ (ভ্রূণ) আবার বিভাজিত হতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় নেয় দ্বিতীয় কোষ হতে। তারপর কোষ বিভাজন হতে হতে সে জরায়ুর দিকে অগ্রসর হয়। কোষ বিভাজনের সাত দিনের মাথায় কোষের সংখ্যা যখন প্রায় ১০০ মতো হয়, তখন ভ্রূণটি জরায়ুর সবচেয়ে ভিতরের আস্তরণে অবস্থান নেয়। তবে সবসময় এই প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয় না। শতকরা ১৫-১৬টি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। যাকে বলা হয় ইমপ্ল্যান্টেশন ফেলিওর।

এইরকম কোষ বিভাজন ও বিভিন্ন ধরনের কোষের রূপান্তরের ফলে বিভিন্ন ধরনের ‘বডি অর্গান’ তৈরি হতে থাকে সার্কুলেটরি সিস্টেম, ‘ডাইজেস্টিভ সিস্টেম, ইউরিনারি সিস্টেম। তার সাথে সাথে সেন্সের সিস্টেমগুলো যেমন কান (শ্রবণ), চোখ (দৃষ্টি), জিভ (স্বাদ) ইত্যাদিও পূর্ণতাপ্রাপ্ত (ডেভেলপ) হতে থাকে। সেইসময় মায়ের রক্তপ্রবাহের সঙ্গে প্রাণের বাইরের দিকের কোষগুলোরও সংযুক্তি ঘটে।

রজঃস্রাবের পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ সপ্তাহের মধ্যেই বাচ্চার হৃৎস্পন্দন শুরু হয়ে যায়। নিউরাল টিউব তৈরি হয়, যার থেকে পরে শিশুর মস্তিষ্ক ও শিরদাঁড়া তৈরি হবে। নাক, কান, ঠোঁট, দাঁত, মাড়ি, চোয়াল, চোখের পাতা ইত্যাদি নিজের মতো জায়গায় অবস্থান নিতে শুরু করে।

01

৮ থেকে ১০ সপ্তাহে হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, কিডনি, খাদ্যনালী আরও পূর্ণতা লাভ করতে থাকে। যকৃতে রক্ত তৈরি হতে শুরু করে, সেই সময় পাকস্থলী কিছু কিছু এনজাইমও তৈরি করতে পারে। ১১ সপ্তাহে ভ্রূণ  ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়।

১২ সপ্তাহের ফিটাস মোটামুটি একটি মানুষের চেহারা নেয়। Facial expression দিতে পারে, স্বরনালী (ভোকাল কর্ড) তৈরি হতে থাকে, সেক্সুয়াল অর্গান ডেভেলপ হতে থাকে। ১৫-১৬ সপ্তাহে ১০-১১ সেমি বা ৪ ইঞ্চির মতো লম্বা হয়, ওজন ৭০ গ্রামের মতো। এই সময় মায়ের তলপেট বেশ ফোলা ফোলা দেখা যায়। হাড়গোড় মজবুত হতে থাকে, ফিটাস বাঁকানো অবস্থা থেকে সোজা হতে শুরু করে। চুল ওঠা শুরু হয়, মাংসপেশি শক্তিশালী হতেথাকে।

১৮-২০ সপ্তাহে বাচ্চা ২০ সেমি বা ৮ ইঞ্চির মতো লম্বা হয় ও দ্রুত বাড়তে থাকে। মা বাচ্চার নড়াচড়া প্রথম উপলব্ধি করে।

২০-২২ সপ্তাহে সারা শরীর নরম লোমে ঢেকে যায়, যা শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে।

৬ মাস বা ২৪ সপ্তাহে বাচ্চার ওজন প্রায় ৫০০ গ্রামের মতো হয়। তখন সে বাইরের আওয়াজ শুনতে পারে এবং তাতে রিঅ্যাক্ট করে। বাচ্চা অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বা তরলে ভেসে থাকে, সেথায় অল্পস্বল্প প্রস্রাব করে। বড়দের মতো হেঁচকি তোলে, মা তা উপলব্ধি করতে পারে। বাচ্চা যখন তরলে ভাসে তখন বাচ্চার নরম লোম – ও মোমের মতো আবরণ তরল বা জলের শোষণ করা থেকে তাকে রক্ষা করে।

২৬-২৮ সপ্তাহের সময় বাচ্চা কখনো ঘুমোয়, কখনো জেগে ওঠে এবং আরও ভালোভাবে নড়াচড়া করতে পারে। চোখ খোলে ও বন্ধ করে, আলোয় সাড়া দেয় (রিঅ্যাক্ট করে)। ছেলে বাচ্চার অন্ডকোষ দুটো তার পেটের অবস্থান থেকে স্বস্থানে নামতে থাকে ৷

২৮ সপ্তাহে বাচ্চা প্রায় ১ কেজির মতো হয় ও লম্বায় প্রায় ১৩-১৪ ইঞ্চি। এই সময় বাচ্চা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে ও পরিপূর্ণতার দিকে এগোয়। চামড়ার নীচের চর্বি ডেভেলপ হওয়ার ফলে বাচ্চা কোঁচকানো অবস্থা থেকে মসৃণ আকার নেয়। গায়ের আঠার মতো (vernix) পদার্থ ও নরম লোম কমতে থাকে। ফুসফুস ও সমগ্র খাদ্যনালী তাদের পরিপূর্ণতা লাভের মতো জায়গায় আসতে থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এই সময় মস্তিষ্ক খুব দ্রুতগতিতে বাড়ে ও প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হতে থাকে। 

অবশেষে ৪০ সপ্তাহের পর সেই আবেগঘন মুহূর্ত— The baby is ready to born, তখন বাচ্চার ওজন প্রায় ৩ কেজি ও লম্বায় ১৮ ইঞ্চি (৪৮-৫০ সেমি)।

জানা কথা নতুন করে জানা

এবার মায়ের খাদ্যের প্রসঙ্গে আসা যাক। যা থেকে পেটের বাচ্চা সমস্ত রকম ক্যালোরি, প্রোটিন, জল, ভিটামিন, মিনারেল এবং আরও প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর সামগ্রী গ্রহণ করে এবং গর্ভস্থ বাচ্চাকে উপযুক্তভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি সময় থেকেই বাচ্চার মস্তিষ্কের গ্রোথ খুব ভালো হতে থাকে এবং তা শেষ পর্যন্ত চালু থাকে। এই সময় ভালো পুষ্টিকর খাদ্য ঠিকভাবে বাচ্চাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।

ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়ামের অভাব হলে বাচ্চার হাড় ও দাঁতের সমস্যা হয় পরে। আবার ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি হলে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট যেমন স্পাইন বাইফিডা হতে পারে। 

অনেকেই গর্ভাবস্থার শুরুতেই মর্নিং সিকনেস, অবসাদ ও ক্লান্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, অর্শ, গলা-বুক জ্বালা, মাড়ির সমস্যা, পা ফোলা ও ক্র্যাম্প ধরা ইত্যাদিতে ভোগেন। এর বিশেষ কারণ প্রধানত হরমোন ও জিনঘটিত। শরীরে ফ্লুইড হওয়ার জন্য সমস্যা হয়।

ভালো পুষ্টিকর খাদ্য এই সমস্ত সমস্যার অনেকটাই হয়তো সমাধানে সক্ষম। যেমন কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে। আবার কম চর্বি জাতীয় খাবার গলা-বুক জ্বালা থেকে রেহাই দিতে পারে। বমি বমি ভাব বা বমি কমানোর জন্য ভিটামিন-বি, যুক্ত খাবার সাহায্য করে। ভালোরকম জলীয় খাদ্য বা ওভারঅল নিউট্রিশন এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে।

খাদ্যে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাবে রক্তচাপ বাড়তে পারে বা প্রি-এক্ল্যাম্পশিয়া হতে পারে।

রক্তশুন্যতার জন্য হাঁফ ধরলে আয়রন ট্যাবলেট (সাপ্লিমেন্ট) নিতে হবে।

ওয়েল ব্যালান্সড ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট- প্রোটিন-ফ্যাট থাকবে নির্দিষ্ট পরিমাণে। যার মধ্যে ক্যালোরির সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল ও অন্যান্য নিউট্রিয়েন্ট থাকবে। যা গর্ভাবস্থায় অনেকরকম জটিলতা দূর করে একটি সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে সাহায্য করে।

সাথে সাথে ডেলিভারি বা প্রসবের জন্য মায়ের বিশেষ শক্তি বা এনার্জি (ক্যালোরি) থাকা দরকার। 

গর্ভাবস্থায় কী কী ধরনের খাদ্য খাওয়া উচিত

উপযুক্ত খাদ্যের পরিকল্পনা করে নিতে হবে। তার মধ্যে সিরিয়াল (দানাশস্য যুক্ত খাদ্য), প্রোটিনযুক্ত খাদ্য, চর্বি, বিভিন্ন রকমের ফল ও শাকসবজি থাকবে।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ২০০০ ক্যালোরির মতো হলেই চলবে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় আরও ৪০০ ক্যালোরি বেশি খেতে হবে তার গর্ভস্থ সন্তানের জন্য।

তার ওপর যারা নিয়মিত ভারী ও কঠোর পরিশ্রম করে তাদের আরও কিছু বেশি ক্যালোরি বা এনার্জির প্রয়োজন (২৮০০-৩০০০ ক্যালোরি)।

ভিটামিন ও মিনারেল : আমাদের শরীর মাত্র তিন রকমের ভিটামিন তৈরি করতে পারে। যেমন ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-কে, বি-ভিটামিন। তবে বেশিরভাগ ভিটামিনই আমরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধের মধ্যে থেকে পাই। সেজন্যই গর্ভবতী মায়েদের ভালো ধরনের খাদ্যদ্রব্য যার মধ্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন-মিনারেল থাকবে, সেগুলো বেছে বেছে খাওয়া উচিত। কারণ এসব মায়ের ও বাচ্চার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। ভিটামিন নিজে ক্যালোরি বা এনার্জি দেয় না, কিন্তু এসব কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের মেটাবলিজমে অংশ নিয়ে ক্যালোরির যোগান দেয়।

প্রয়োজনীয় ভিটামিন অর্থাৎ খাদ্যপ্রাণ

ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি১, বি২, বি৩, বি৬, বি৭ বি৯, বি৫, বি১২, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে। 

মিনারেল বা খনিজ, অজৈব

শুধুমাত্র ভিটামিন খেলেই হবে না, যদি না সঙ্গে খনিজ পদার্থ থাকে। যেসব আমাদের শরীরের সব সিস্টেমকে চালু রাখতে সাহায্য করে।

আমাদের শরীরে (বাচ্চারও) প্রায় ২৫ ধরনের প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকে। তার মধ্যে অনেকগুলোই গর্ভবতী মহিলাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। যেমন — ক্যালসিয়াম, ক্রোমিয়াম, কপার, আয়োডিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, মলিবডেনাম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি।

যে সমস্ত খাদ্যে উপরোক্ত ভিটামিন ও খনিজ পদার্থগুলো ভালো পরিমাণে থাকে তার একটা তালিকা দেওয়া হল।

  • আয়রন : যে সব খাদ্যে ভালো পরিমাণে আয়রন বা লোহা থাকে তা হল পালংশাক 

ও অন্যান্য সবুজ শাকসবজি, শুকনো বিনস্, মটর, ডুমুর, ব্রকোলি, আলু, মুসুর ডাল, পাস্তা, বাদাম, বিভিন্ন রকম ফল ও শুকনো ফল, বিভিন্ন রকম – শস্যদানা, মাংস, মাছ, ডিমেও রয়েছে আয়রন যা শরীরের পক্ষে খুব ভালো।

  • ফলিক অ্যাসিড : বিভিন্ন রকমের সবুজ শাকসবজি যেমন পালংশাক, ব্রকোলি, বিনস্, . বাঁধাকপি, ফুলকপি, ক্যাপসিকাম, বিট, লাউ, কুমড়ো, বিভিন্ন টক জাতীয় ফল, কলা, কমলাবেলু, আঙুর, বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, সোয়া ইত্যাদি।
  • ক্যালসিয়াম : কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাতীয় খাদ্য, যেমন দুধ, দই, চিজ, খোয়াক্ষীর, কমলালেবু, শুকনো ডুমুর, ব্রকোলি, আমন্ড, বিনস্ ইত্যাদি।
  • ভিটামিন-ডি : সাধারণভাবে শরীর নিজেই সূর্যের আলোর সাহায্যে ভিটামিন-ডি তৈরি করে। তাছাড়া বিভিন্ন রকম দুগ্ধজাতীয় খাদ্য, মাছ, ডিমের কুসুম ইত্যাদির মধ্যে কিছু ভিটামিন-ডি থাকে।
  • জিঙ্ক : দই, ডিম, মাংস, সামুদ্রিক মাছ, দুধ, সয়াবিন, সূর্যমুখী ও কুমড়োর বিচি, হুইট গ্রেন (গমের আটা) জিঙ্কের উৎস।
  • ভিটামিন-এ : পালংশাক ও অন্যান্য সবুজ শাকসবজি, হলুদ শাকসবজি (যেমন গাজর, মিষ্টি আলু, কুমড়ো), বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, আম, গমের আটা, দুধ, দই, ডিম ইত্যাদি।
  • ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, চিজ, বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, আমন্ড, হোল হুইট ইত্যাদি ।
  • ভিটামিন-সি : বিভিন্ন ধরনের টক ফল, কমলালেবু, টমেটো, ব্রকোলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বিভিন্ন ধরনের লঙ্কা, মিষ্টি আলু, আপেল, পাকা পেঁপে, আম, তরমুজ ইত্যাদি। 
  • ভিটামিন-ই : পালংশাক, মিষ্টি আলু, আম, আলমন্ড, সূর্যমুখীর বিচি প্রভৃতি।
  • ভিটামিন-কে : সবুজ শাকসবজি, কলা, অলিভ অয়েল, ব্রকোলি, ওলকপি, শালগম, আপেল (সবুজ) ইত্যাদি।
  • আয়োডিন : আয়োডিন যুক্ত লবণ, কিছু কিছু সামুদ্রিক মাছ ও দুগ্ধজাতীয় খাদ্য।
  • ক্রোমিয়াম : বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, পালংশাক, ছোলা, বিনস্, চিজ, মুরগির মাংস ইত্যাদি।
  • কপার : সবুজ শাকসবজি, শুকনো বিনস, বাদাম, শস্যদানা, চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া, ঢেঁকি ছাটা চাল ইত্যাদি ।
  • ফ্লোরাইড : টুথপেস্ট, চা, পালংশাক, দুধ,মাছ ইত্যাদি।
  • ম্যাগনেশিয়াম : বিভিন্ন ধরনের বাদাম জাতীয় খাদ্য, বিনস্, দই, দুধ, কলা, সবুজ শাকসবজি।
  • ম্যাঙ্গানিজ : পালংশাক, মূলো, ব্রকোলি, বিভিন্ন রকমের বাদাম ও শদ্যদানা, ঢেঁকিছাটা চাল, কলা, স্ট্রবেরি ইত্যাদি ।
  • মবিলডেনাম : সবুজ শাকসবজি, শুকনো বিনস্, শস্যদানা, দুধ, মেটে ইত্যাদি ।
  • ফসফরাস : ডিম, মাছ, মাংস, পোলট্রির ডিম, চিজ, দই ইত্যাদি ।
  • পটাশিয়াম : কলা, এপ্রিকোট, কমলা, ন্যাসপাতি, গাজর, আলু, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাতীয় খাদ্য।
  • সেলেনিয়াম : মাছ, মাংস, মুরগির মাংস, ডিম, ও শদ্যদানা ইত্যাদি ।
  • সোডিয়াম : প্রত্যেক খাদ্যেই আছে। তাছাড়া আলাদা করে লবণ ।

ভিটামিন ও মিনারেল ছাড়া আরও কিছু

গর্ভাবস্থার সময়ে হরমোনের কারণে বা স্বাভাবিক প্রসবের পর কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এই সময় ফাইবার যুক্ত খাবার খুবই উপকারী। নানা ধরনের ফল, শাকসবজি, বিনস্, শস্যদানা ইত্যাদি ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত ৷ এছাড়া প্রতিদিন সময় মেনে পায়খানায় বসা উচিত। ফলের রসের পরিবর্তে গোটা ফল বেশি করে খেতে হবে।

সম্পূর্ণ খাদ্যতালিকা

  • ফল : প্রয়োজনমতো একেকদিন দু-তিনটি করে বেছে নিন। যেমন কমলালেবু, মোসাম্বি, আপেল, কলা, পেঁপে, আমলা, আম, আনারস, ন্যাসপাতি, আঙুর, পেয়ারা, আতা, বিভিন্ন ধরনের শুকনো ফল ও ডুমুর ।
  • শাকসবজি : আলু, টম্যাটো, গাজর, মুলো, মটর, বিনস্, কুমড়ো, মিষ্টি আলু, ব্রকোলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংশাক ও অন্যান্য সবুজ শাকসবজি।
  • দানাশস্য (সিরিয়াল) : চাল, ভাঙা গম, চাপাটি—জোয়ার-বজরা-সয়া-গম, গমের পাস্তা, পপকর্ন, পাড় রাইস, ডালিয়া ইত্যাদি।
  • তেল ও অন্যান্য মশলাপাতি : অলিভ অয়েল,বাদাম তেল, সূর্যমুখী তেল (সানফ্লাওয়ার অয়েল), সরষের তেল, বিভিন্ন রকমের মশলা- হলুদ, সরষে, দারুচিনি, জায়ফল, ধনে। এছাড়া বিভিন্ন রকম ডাল (মুগ ডাল ভালো হজম হয়)।
  • দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য : দুধ, দই, সয়া দুধ, চিজ ইত্যাদি।
  • বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও বিচি : আমন্ড, আখরোট, কুমড়ো, সূর্যমুখী, তরমুজ ইত্যাদি।
  • মাছ-মাংস-ডিম মুরগির মাংস, মাছ। ডিমের সাদা অংশ বেশি করে, কিন্তু ডিমের কুসুম দু’একটার বেশি নয়।

এছাড়া ডাবের জল, হার্বাল চা, ফ্রেশ জুস। আগেই বলেছি, গর্ভের আগে ২০০০ ক্যালোরির মতো প্রয়োজন হয় যা আমরা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বি থেকে পাই। তবে প্রসবকালীন সময়ে আরও ৪০০ ক্যালোরির মতো অতিরিক্ত দরকার হয়। গর্ভবতীর নিজের ও গর্ভের সন্তানের জন্য। বিশেষ করে যাদের আবার ব্যাপক কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। 

  • টিপস্ : খিদে পেলে খান, অল্প অল্প খান। মাঝে মাঝে স্ন্যাক্স খেতে হবে। প্রয়োজনীয় ব্যায়াম করতে হবে।

জল

আমাদের শরীরের ওজনের শতকরা ৬০- ৬৫ ভাগ জল এবং তা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে চলেছে। যেমন জল পুষ্টি বহন করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেয়, বর্জ্য পদার্থ শরীর থেকে বার করে দেয় (শুধুমাত্র মায়ের শরীর থেকে নয়, বাচ্চারও)। জল শরীরের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। অস্থি সংযোগ চালু রাখে এবং সেখানে শক অ্যাবজর্বারের কাজ করে। মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে কাজ করতে হলে রোজ অন্তত ৮-১০ গ্লাস (২ ৩ লিটার) জল অবশ্যই খেতে হবে। তবে সবসময় যে মেপে জল খেতে হবে এমন নয়। তরমুজ, শাকসবজি ও ফল খেলেও শরীরের শতকরা ৩০ ভাগ জল খাওয়া হয়ে যেতে পারে। ১ গ্লাস করে জল প্রতি ২ ঘণ্টা অন্তর খেলেই হয়ে যাবে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় যা একান্ত প্রয়োজন । জল অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে, মুডের উন্নতি ঘটায়, . খাদ্য হজমে সাহায্য করে, ওজন কমায়, শরীরের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখে, মাথা ব্যথা, মাথা ধরা হতে দেয় না, ত্বকের উন্নতি ঘটায় ও শরীরের সমস্তরকম বর্জ্য পদার্থ বার করে দেয়। খাদ্যতালিকাটা এভাবে করা যেতে পারে

  • ঘুম থেকে ওঠার পর : হালকা চা সাথে একটা ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট।
  • ব্রেক ফাস্ট : দুধের সাথে চার-পাঁচটা আমন্ড, টোস্ট, ফল, দই, বাদাম ইত্যাদি। অথবা ওমলেট, ফল ও টোস্ট।
  • ব্রেক ফাস্টের দু’ তিন ঘণ্টা পর : ফলের রস।
  • দুপুরের খাবার : ২-৩টে রুটি অথবা ১ কাপ ভাত, অনেকটা স্যালাড, অনেক সবজি দিয়ে অল্প মশলায় একটা তরকারি, ১ কাপ ডাল (মুগ ডাল) অথবা মাছ (৫০ গ্রাম) বা চিকেন (২ পিস)। বিকেলে চায়ের সাথে কিছু স্ন্যাক্স।।
  • রাতের খাবার : অনেকটা স্যালাড, দু- তিনটে চাপাটি বা এক কাপ ভাত, অনেকটা সবজি দিয়ে তরকারি (অল্প তেলে, অল্প ভেজে), এক কাপ ডাল অথবা এক-দু’ টুকরো চিকেন কিংবা মাছ।
  • ঘুমের আগে এক গ্লাস গরম দুধ। খাদ্যতালিকা সঠিকভাবে অনুসরণ করলে ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ও আয়রন ছাড়া বাইরে থেকে অন্যান্য ওষুধপত্রের খুব একটা প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।

নিয়মিত ব্যায়াম ও যোগব্যায়াম খুবই উপযোগী। যা স্বাস্থ্য ও স্ট্যামিনা বাড়ায়। মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমায়। যেসব মায়েরা ঠিকমতো এটা করে তাদের বাচ্চারা ঠিকমতো ঘুমোয় ও মায়ের শারীরিক কষ্ট কম হয়। রোজ ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা অথবা সাঁতার কাটা এর জন্য উপযোগী। ব্যায়ামের সাথে সাথে ভালোরকম জল খেতে হবে। শরীর শুষ্ক, রুক্ষ হবে না। প্রসবকালীন সময়ে কতটা ওজন বাড়া উচিত ধীরে ধীরে ওজন বাড়া উচিত। হঠাৎ খুব বেশি ওজন বাড়া বা খুব কমে যাওয়া ঠিক নয়। গর্ভকালীন সময়ে (২০ সপ্তাহ) ১১-১৪ কেজির মতো ওজন বাড়া উচিত। যাদের কম ওজন তাদের ১২-১৬ কেজি পর্যন্ত, আবার যাদের বেশি ওজন (স্থূলকায়) তাদের ৭-১১ কেজির মতো ওজন বাড়া উচিত।

খুব বেশি করে যাদের ওজন বাড়তে থাকে, তারা কিছু কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। যেমন তাদের পিঠ-কোমর-পায়ে ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, অর্শ, বুক জ্বালা, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে রক্তচাপজনিত সমস্যা, টক্সিমিয়া, এক্ল্যামসিয়া, ডায়াবেটিস ইত্যাদি হতে পারে।

যাদের ওজন বেশি তাদের সাধারণত বড় বাচ্চা হয় এবং তাদের প্রসবকালীন সমস্যা হতে পারে। বড় বাচ্চা হওয়ার জন্য তাদের অনেক ক্ষেত্রেই ফরসেপ, সিজারিয়ান অপারেশন করতে হয়। স্থূলতার জন্য তাদের পরবর্তী সময়ে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, স্ট্রোক, হার্টের অসুখ ও ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়ে।

সাধারণত প্রথম ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত ওজন খুব একটা বাড়ে না। বাড়লে ০-১ কেজি পর্যন্ত। কখনো কখনো কমেও যায়। ১৩ সপ্তাহ থেকে ২৮ সপ্তাহে ১-২ কেজি পর্যন্ত প্রতি মাসে। ২৯ সপ্তাহ থেকে ৪০ সপ্তাহে ২-২ কেজি প্রতি মাসে। এই সময় বাচ্চারা খুব দ্রুত বাড়ে। 

স্ন্যাকস টাইম

ব্রেকফাস্ট এবং দুপুরের খাওয়ার মাঝখানে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খাওয়ার সময়। যেমন চিড়ে ভাজা, পপকর্ন, বিভিন্ন ধরনের বাদাম (আমন্ড, আখরোট), কলা, আপেল, পেয়ারা (চিলি পাউডার, নুন দিয়ে), শশা, গাজর, চাটনি, স্যান্ডউইচ ইত্যাদি।

গর্ভকালীন সময়ে সাধারণ কিছু সমস্যা 

ঘুম : সুস্থ বাচ্চার জন্য খাদ্য ও ব্যায়ামের পাশাপাশি ভালো ঘুমেরও খুব প্রয়োজন। ভালো ঘুমের অভাবে মস্তিষ্ক বেসামাল অবস্থায় থাকে, কাজে মন বসে না, কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পায় ও স্মৃতিভ্রংশ হতে পারে।

সারাদিনে কম করে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম না হলে স্ট্রোক ও হার্টের অসুখের সম্ভাবনা বাড়ে। খাদ্যের সাথে ঘুমের একটা সম্পর্ক আছে। খাদ্যে কলা, মেলাটোনিন পুষ্ট খাদ্য যেমন কমলা, চেরি জুস, টমেটো, ভাত, ফ্লেক্সসিড, সুইট কর্ন, মাছ, ডিম, দই, এগুলোতে ঘুম ভালো হয়। ক্যালসিয়াম ও ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার মাংসপেশিতে সংকোচন বা ক্র্যাম্প হতে দেয় না। আমন্ড, সবুজ শাকসবজি, হার্বাল চা ঘুমের পক্ষে ভালো। হার্বাল চা মাংসপেশি ও স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করে, ঘুমের আবহ তৈরি করে। এক কাপ হার্বাল চা খেলে ভালো হজম হয়, পেটের গ্যাস দূর করে ঘুম হতে সাহায্য করে। ঘুম না হলে মাঝরাতে সামান্য একটু মিষ্টি আলু বা একটি টোস্ট খেয়ে নিলেও অনিদ্রার উপশম হতে পারে। ভিটামিন-সি হচ্ছে, ন্যাচারাল ট্র্যাঙ্কুলাইজার।

এবার গর্ভাবস্থার শুরুতেই হবু মায়েরা যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয় তারই আলোচনা।

  • মর্নিং সিকনেস : এর প্রধান কারণ হল হরমোনজনিত। এই সময় প্রোজেস্টেরন হরমোন হঠাৎ করে অনেকটা বেড়ে যায়। এছাড়া ঘ্রাণশক্তি অনেকটা বেড়ে যায়। পাকস্থলির অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ায় মুখে একটা metallic taste আনে। এছাড়া অত্যধিক স্ট্রেসের জন্য ক্লান্তির ব্যাপারটা আরও ঘোরালো করে দেয়। পরিত্রাণের উপায় হল টক জাতীয় খাদ্য যেমন ফলের রস, অথবা ভিনিগারে ম্যারিনেটেড করা খাদ্য। এই সমস্ত খাদ্য মুখের স্যালাইভা বাড়িয়ে খারাপ টেস্ট দূর করতে পারে। এছাড়া দু ’বেলা ব্রাশ এবং বেকিং সোডা মুখের অম্লতা কমাতে সাহায্য করে। এই সময় আদা, ভিটামিন-বি যুক্ত খাবারও উপযোগী।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য : প্রধান কারণ শরীরে প্রোজেস্টেরন হরমোন বেড়ে যাওয়া। এছাড়া রক্তশূন্যতা ও মানসিক অবসাদও কারণ হতে পারে। সমাধানের উপায়—ফাইবারযুক্ত খাবার পায়খানা নরম করায়, মল বৃদ্ধি করে ও তাড়াতাড়ি মলত্যাগে সাহায্য করে। তাজা ফল ও শাকসবজি, শুষ্ক ফল যেমন ডুমুর, খেজুর, আখরোট, প্রচুর পরিমাণে জল, গোটা ফল খেতে হবে। দই হজমে খুব সাহায্য করে। কলা, পাউরুটি, কর্নফ্লেক্স ছাড়াও ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন বাদাম, হুইট গ্রাম, বিনস্ ও প্রচুর শাকসবজিও উপকার দেবে।
  • গ্যাস : এর জন্য খাদ্যনালীর শিথিলতা দায়ী। ফলে খাদ্যনালীতে অত্যধিক মল ও গ্যাস জমে, খাদ্যনালী ফুলে ফেঁপে ওঠে। বেশি বেশি ফাইবার খাবারের একটা সমস্যাও আছে। কিছু কিছু আন্ত্রিক জীবাণু নির্দিষ্ট ফাইবার ভেঙে দিয়ে গ্যাস তৈরি করতে পারে। সমাধানের উপায় হিসাবে প্রথমেই মায়েদের বুঝতে হবে কোন ধরনের ফাইবার বা রাফেজ গ্যাস তৈরি করছে এবং তা বর্জন করতে হবে। খাবার ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে খেতে হবে।
  • বুক জ্বালা : অল্প অল্প করে ধীরে ধীরে খেতে হবে। জল ও খাদ্য একসাথে নয়। খাওয়ার আগে ও পরে জল খেতে হবে। অনেক খাবার ও অনেক জল পাকস্থলিকে বাড়িয়ে দেয়, এতে বুক জ্বালা করার প্রবণতা বাড়ে।

যে সমস্ত খাবার বুক জ্বালা বাড়ায় তা পরিত্যাগ করতে হবে। যেমন খুব ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল, চা-কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস্ ইত্যাদি। এসব স্টমাক ও ইসোফেগাসকে আলগা করে দেয়। ফলে অ্যাসিড জাতীয় খাদ্য ওপরের দিকে উঠে বুক জ্বালা করে। চকলেট, মিন্ট টক জাতীয় খাদ্য, প্রচুর ফ্যাটযুক্ত খাবার, তৈলাক্ত খাবার বুক জ্বালার প্রবণতা বাড়ায়। সমাধান হিসাবে মাথা উঁচু করে শুতে হবে। খাওয়ার আধ ঘণ্টা বাদে সুগার-ফ্রি চুইংগাম কিছুক্ষণ চিবোলে মুখে শ্লেষ্মা বার হয় এবং তা মুখের অম্লকে কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া বুক জ্বালা না কমলে ক্যালসিয়ামযুক্ত অ্যান্টাসিড খেতে হবে।

  • অবসাদ, ক্লান্তি : আগের তুলনায় এখন শরীরকে অনেক বেশি কাজ করতে হচ্ছে। হার্ট রেট, মেটাবলিজম বেড়ে যাওয়ায় শরীরকে বেশি বেশি রক্ত তৈরি করতে হচ্ছে। শরীরে জল ও পুষ্টির ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এছাড়া শরীরে প্রোজেস্টেরন হরমোন বৃদ্ধি পাওয়া একটি বিশেষ কারণ। এই সময় রক্তচাপ ও ব্লাড সুগার কমে যাওয়া এবং রক্তাল্পতাও অবসাদ ও ক্লান্তি হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। প্রতিকার হিসাবে স্বাস্থ্যকর খাদ্য—তাজা ফল ও শাকসবজি, কম চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়া উচিত। ১২ সপ্তাহের পর থেকে এই সমস্যা কেটে যায়। ভালো ঘুম দরকার। রাতের খাবার ঘুমোতে যাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে খেলে ভালো হয়। রক্তাল্পতার জন্য আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে।
  • দাঁত ও মাড়ির সমস্যা : দু’ বার ব্রাশ করা দরকার। ভিটামিন-সি ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
  • মাথা ঘোরা (Dizziness) : ব্লাড সুগার কমে গেলে এটা হতে পারে। এতে দুর্বল লাগে, মাথা ঘোরে, হাঁটু ব্যথা করে। জল কম খেলেও – শরীর খারাপ লাগতে পারে।
  • পা-হাঁটুর ব্যথা : এটা সাধারণত গর্ভের  মাঝামাঝি সময় থেকে আরম্ভ হয়। এর জন্য মুখ্যত খাদ্যই দায়ী।
  • পায়ের ক্র্যাম্প : পায়ের ক্র্যাম্পের জন্য ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি বা জল খুব কম খাওয়ার জন্যও (ডিহাইড্রেশন) হতে পারে। কলা, সবুজ শাকসবজি, বিভিন্ন রকমের বাদাম, দুধ, দই ইত্যাদি এক্ষেত্রে উপকারী।
  • পা ফোলা : গর্ভাবস্থায় শতকরা ৭৫% ক্ষেত্রেই এমন হয়। কিন্তু যদি এর সাথে উচ্চ রক্তচাপ থাকে ও প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয়  তাহলে এটা ভয়াবহ কিছু ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে।
  • ত্বকের সমস্যা : মনে করা হয় খাদ্যই দায়ী। সাধারণত জল কম খাওয়া, ভিটামিন ও আয়রনের ঘাটতির কারণে হতে পারে। ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড (ভালো ধরনের চর্বি) কমে গেলেও  চামড়ার সমস্যা হতে পারে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version