আমাদের শরীরে কোষ বিভাজন একটা নিয়ম মেনে হয়। শরীরের কোনো স্থানে জখম হলে কোষ বিভাজন হয়ে জায়গাটা ভরাট হয়ে যাওয়ার পরই কোষ বিভাজন সাধারণত বন্ধ হয়ে যায়। এটা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের একটি বিশেষ জিন। যদি সেই জিনে কোনো পরিবর্তন ঘটে তখন কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রণ হারায়। তখন স্বাভাবিক হারে কোষ বিভাজন হয় না। কোষগুলো বাড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। জায়গাটা ক্যানসারে পরিণত হয়। শরীরের সমস্ত পুষ্টি খেয়ে নেয়, আশেপাশের সমস্ত জায়গাকে জখম করে। শরীরের যে কোনো জায়গাতে এটা হতে পারে। যেমন চামড়া, মাংসপেশি, খাদ্যনালী, পাকস্থলি, স্তন প্রভৃতি।
Table of Contents
আধুনিক জীবনযাত্রা কতটা দায়ী
এটা ঠিকই যে আমাদের পূর্বপুরুষদের আমলে ক্যানসারের এত প্রকোপ ছিল না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ক্যানসারের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। আর এর জন্য দায়ী আমাদের পরিবেশ ও আধুনিক জীবনযাত্রা। আজ পর্যন্ত আমরা ক্যানসারের সঠিক কারণ অনেকক্ষেত্রেই জানি না। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কারণ অবশ্য জানা গেছে এবং তার বেশিরভাগ আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত।
তামাক, গুটখা, গুড়া, জর্দা, সুপারি, পানমশলা, সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা, চুরুট, খৈনি, দোক্তা, গড়গড়া ইত্যাদি আমাদের গলা, খাদ্যনালী ও শ্বাসনালীর ক্যানসার হতে সাহায্য করে। অত্যধিক মদ্যপান আমাদের লিভার ও পাকস্থলির ক্যানসারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
আমাদের জীবনযাত্রা এখন অতি দ্রুত। বাড়িতে খাবার তৈরি করার সময় খুব কম। ফলে বাজারের খাবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, প্যাকেটজাত খাবার, প্রিজার্ভ করা খাবার ক্যানসারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। অনেকে খাবার বানিয়ে ফ্রিজে রেখে সাতদিন ধরে খান। একদিন, দু’দিন ঠিক আছে তবে দিনের পর দিন খাওয়া একেবারেই ঠিক নয়।
অফিসের অত্যধিক কাজের চাপ, অত্যধিক চিন্তাও সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। এদিকে এক্সারসাইজ না করার ফলে বডি ওয়েট বেড়ে যাচ্ছে। তার থেকে ব্রেস্ট ক্যানসার, কোলন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।
মহিলাদের অনেকেই যারা ব্রেস্ট ফিডিং করাতে চান না, বাচ্চা নিতে চান না, তাদের ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মহিলাদের জরায়ু ক্যানসার হয় বিশেষত অল্প বয়সে মা হওয়া, বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়া, একাধিক শয্যাসঙ্গী থাকা ইত্যাদি কারণে। যা নিশ্চিতভাবেই ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে দায়ী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। সেক্সুয়াল কারণে এটা ছড়ায়। অল্প বয়সে অর্থাৎ কুড়ি পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে এইচ.পি.ভি ভ্যাকসিন নিলে জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়।
ক্যানসার প্রতিরোধ করতে হলে
যেভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা জীবন যাপন করতেন, সেটাই অনুসরণ করতে হবে। সকালের বিশুদ্ধ বাতাস, তাজা শাকসবজি, ফলমূল খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত যোগা এক্সারসাইজ করতে হবে, বডি ওয়েট ঠিক রাখতে হবে। আর যে সব জিনিসে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে যেমন হলুদ, রসুন, পেঁয়াজ, গ্রিন টি ইত্যাদি খাবারের তালিকায় রাখা প্রয়োজন।
যা করবেন না
রোল, চাউমিন ইত্যাদি ফার্স্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, মশলাদার খাবার খাবেন না। খাবেন না পোড়া মাংস, একই তেলে বারবার ভাজা। যে সব খাবারে ‘কেমিকেল, লেড, রঙ, আজিনামোটো দেওয়া থাকে সেগুলো এড়িয়ে চলুন। প্যাকেটজাত খাবার, প্রিজার্ভ করা ফাস্ট ফুড, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফুড নৈব নৈব চ।
বাচ্চাদের এর থেকে কীভাবে দূরে রাখবেন
বাচ্চাদের জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড, রঙ দেওয়া খাবার, লেড, কেমিকেল যুক্ত খাবার দেবেন না। বাড়ির তৈরি টিফিন দেবেন। কোল্ডড্রিঙ্কস, চিপস যা বডি ওয়েট বাড়ায় সে-সবে অভ্যস্ত করবেন না। বাচ্চাদের যদি কিছু অস্বাভাবিক সমস্যা থাকে যেমন দীর্ঘদিন ধরে জ্বর, রক্তশূন্যতা, ব্লিডিং হলে রক্ত বন্ধ না হওয়া ইত্যাদি থাকলে ডাক্তার দেখান। এসব লিউকেমিয়ার লক্ষণ হতে পারে। অস্বাভাবিক কোনো ফোলা অর্থাৎ টিউমার টাইপের— সে হাড়, চোখ যেকোনো জায়গায় হতে পারে, এমনটা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সতর্কতা
বংশগত কিছু ক্যানসার আছে যেমন স্তন, জরায়ু ক্যানসার (জেনেটিক শতকরা পাঁচ ভাগ), বংশে কারোর থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের সেটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
রেটিনো ব্লাস্টোমা একটি বংশগত চোখের ক্যানসার। বাবা-মা’র থাকলে শতকরা সত্তর ভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চা এই রোগ নিয়ে জন্ম নিতে পারে। সেক্ষেত্রে দত্তক নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। বাচ্চার জন্য যারা স্পার্ম নেন, তাদের ডোনারের ফ্যামিলি হিস্ট্রি জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ তাদের বংশে ক্যানসার জাতীয় কোনো রোগ ছিল কি না। সেক্ষেত্রে স্পার্ম বর্জনীয়।
নেশা অর্থাৎ মদ, বিড়ি, সিগারেট, গুটখা, পানমশলা ইত্যাদি একদম বন্ধ।
ক্যানসার রোধে সরকারের দায়বদ্ধতা
পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা; খোলা, বাসি, পচা জিনিস বিক্রি হতে না দেওয়া, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ও সেবন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা, ক্যানসার ভীতি দূর করা, পাবলিক অ্যাওয়ারনেসের জন্য স্কুল, কলেজ, সামাজিক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সচেতন করা।