মহাভারতের অভিমন্যুর কথা সবার নিশ্চয়ই জানা আছে। পান্ডব এবং কৌরবদের দ্বিতীয় প্রজন্মের সবচাইতে বড় যোদ্ধা, অর্জুন এবং সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যু। বিয়ে হয়েছিল বিরাট রাজার সুন্দরী কন্যা উত্তরার সাথে। তাদের পুত্র পরীক্ষিত যুধিষ্ঠিরের পর হস্তিনাপুরের রাজা হয়েছিলেন। অবশ্য অভিমন্যু তা দেখে যেতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর পরীক্ষিতের জন্ম। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের তেরোদিনের দিন সেই ভয়ংকর যুদ্ধ। সংসপ্তক বাহিনী অর্জুন এবং কৃষ্ণকে নিয়ে গেছে অনেক দূরে, যুদ্ধক্ষেত্রের এক পাশে। আর জয়দ্রথের নেতৃত্বে কৌরবরা চক্রব্যুহ তৈরি করে পান্ডব সেনাদের ছিন্নভিন্ন করছে। এমন অবস্থায় যুধিষ্ঠির উপায় না দেখে অভিমন্যুর শরণাপন্ন হলেন। অভিমন্যু সুভদ্রার গর্ভে থাকা অবস্থায় শুনেছিলেন, পিতা অর্জুন তার মা সুভদ্রাকে চক্রব্যূহে ঢোকার কায়দা বলছেন। কিন্তু শুনতে শুনতে সুভদ্রা ঘুমিয়ে পড়ায় এই ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে আসার ব্যাপারটা তার শোনা হয়নি। জ্যাঠার অসহায় অবস্থা দেখে ষোল বছরের অভিমন্যু বীরের মতো ব্যুহে ঢুকে পড়লেন। প্রচন্ড যুদ্ধ করে প্রায় দশ হাজার কৌরব সেনা ধ্বংস করে শেষমেশ প্রাণ হারালেন। ব্যূহ থেকে বের হওয়ার পথ না জানায়।
আমাদের কৃত্তিকার কাছে মহাভারতের এই অংশটুকু বড়ই প্রিয়। অভিমন্যু তার কাছে সবচাইতে বড় হিরো। অভিমন্যুর জন্য তার চোখে জল আসে।
এই ঘটনা থেকেই তার মনে একটা জিজ্ঞাসা, পেটের ভেতর শিশু কি শুনতে পায় ? মহাভারতের ঋষিরা কি তাহলে এত কথা বানিয়ে বলে গেছেন ?
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কিন্তু প্রমাণ করে দিয়েছে, না—মিথ্যে নয় এ কাহিনী। গর্ভস্থ শিশু সত্যিই শুনতে পায়। পাশাপাশি প্রমাণ হয়েছে সুপ্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চা কতই না আধুনিক ছিল।
কৃত্তিকা নিজে খুব ভালো মেয়ে ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে বিদেশেও পড়াশোনা করেছে। এখন সে মা হতে চলেছে। `স্বামী ভাবা অ্যাটমিক এনার্জির গবেষক। তাদের সন্তান আসছে তার তো স্বাভাবিক ভাবেই মেধাবি হবার কথা। কিন্তু কৃত্তিকা চাইছে সন্তান যেন ওদেরও ছাড়িয়ে যায়। তার জন্য সে চাইছে গর্ভে থাকতে থাকতেই তার সন্তান যেন মেধাবি আর সর্বগুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে।
কিন্তু কথা হচ্ছিল গর্ভস্থ শিশুর শুনতে পাওয়া নিয়ে। এ নিয়ে বিশদ আলোচনার আগে আমরা দেখে নিই শ্রবণযন্ত্রণটা কীভাবে আর কখন তৈরি হয়ে ওঠে।
মাতৃত্বের দ্বিতীয় সোপানের (সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার) শুরু থেকেই মা’র শরীরের বাইরের শব্দ শিশু শুনতে শুরু করে। তার মানে যে জগতে সে আসবে তার পরিবেশের সাথে পরিচিতিটা শুরু হয়ে যায় আর কি।
মাতৃত্বের একদম শুরুতেই, যখন ভ্রূণের বয়স ছয় সপ্তাহ আর ভ্রূণের আকৃতি একটা মটর দানার বেশি নয়, তখনই মস্তিষ্ক গঠন শুরু হয় আর যে কোষগুলো দিয়ে তৈরি হবে মগজ, চোখ-মুখ- নাক এবং কান, তারা নিজেদের সাজিয়ে নিতে শুরু করে। অবশ্য আলট্রাসাউন্ডে তখনও কানটা বিশদ ভাবে বোঝা যায় না। নয় সপ্তাহের কাছাকাছি এলে গলার দু’পাশে ছোট ছোট দু’টো গর্তের মতো দেখা যায়, যেটা পরে আরো ওপরে উঠে ছোট কোঁচকানো বোতামের মতো আকৃতি নিয়ে নেয় ৷
মাতৃত্বের প্রথম এবং দ্বিতীয় সোপান (ফার্স্ট এবং সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার) ধরে এই শ্রবণযন্ত্র তৈরি হতে থাকে। অম্ভকর্ণ, মধ্যকর্ণ এবং বহিঃকর্ণের মধ্যে মগজের যে নিউরোনগুলো শব্দ তৈরি করে তাদের সাথে অন্তঃকর্ণ যুক্ত হয়ে যায় এবং মধ্যকর্ণে যে ছোট হাড়গুলো শব্দের কাপুনি খেয়াল করতে পারে তারাও তৈরি হয়ে যায়। ষোল সপ্তাহে মোটামুটি সবাই তৈরি। কিছু কিছু শব্দ যেটা হয়তো মা-ও খেয়াল করেন না যেমন পেট গুড়গুড়, শ্বাস নেওয়ার হুস-হাস শব্দ সেগুলো বুঝতে পারে। তার পরের কয়েক সপ্তাহে আরো, আরো বাইরের জগতের শব্দ শোনার জন্য সোনামণি তৈরি হয়ে যায়। চল্লিশ সপ্তাহে তো কথাই নেই, মা’র শরীরের কাছাকাছি কোনো শব্দ বা কথা হলে দস্তুরমতো সেদিকে মাথা ঘোরায়। বেশ সেয়ানা হয়ে উঠছে আর কি !
এখানে বলা উচিত কী রকম শব্দ শুনতে পায় শিশু। খোলা জায়গায় শব্দ চমৎকার ভাবে যাতায়াত করে। খোলা মাঠের চিৎকার পুকুরে মাথা ডুবিয়ে রাখলে কি অত ভালো শোনা যাবে ? সেরকম শিশুর চারপাশ ঘিরে থাকে জল (অ্যামনিওটিক ফ্লুইড), তার চারপাশে জরায়ুর দেওয়াল এবং মা’র শরীরের দেওয়াল। সুতরাং শব্দটা যে কীরকম শোনাবে অনুমান করুন।
একটা দৃষ্টান্ত দিয়েছেন বৈজ্ঞানিকরা। কৃত্তিকা বা আরো যারা মা হতে চলেছে তারা, মুখে হাত চাপা দিক আর বড়দের বলুন তারাও যেন মুখে হাত চাপা দেন। এবারে দু’জনে কথা বলুক। এরকম শব্দই শিশু শুনতে পায়। মা’র গলা বোঝা যায়, বাবার গলাও বোঝা যায় কিন্তু শব্দগুলো ধরা যায় না। ঠিক যেমন মুখে হাত চাপা দিয়ে গান গাইলে সুরটা হয়তোবা ধরা যায় কিন্তু বাণীটা অধরাই থেকে যায়। তবে অভিমন্যুর কথা আলাদা। তিনি ভগবানের অংশ (চন্দ্রের) নিয়ে জন্মেছিলেন তাই হয়তো সব শুনতে পেয়েছিলেন।
যত জোরে শব্দ হবে গর্ভস্থ শিশু ততই ভালো শুনতে পাবে। যেমন হালকা চালে সঙ্গীতের মূর্ছনার চাইতে সাইরেনের শব্দ, কুকুরের তীক্ষ্ণ ডাক ইত্যাদি। শব্দ তীক্ষ্ণ হলেই যে কিছু ক্ষতি করবে তা কিন্তু নয়।
সব চাইতে নিখুঁতভাবে যে শব্দ গর্ভস্থ শিশু শোনে সেটা হচ্ছে তার মায়ের গলার শব্দ। গবেষকরা দেখিয়েছেন মা’র কথা শুনলেই গৰ্ভস্থ শিশুর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সুতরাং হবু মায়েরা কথা বলুন, গান করুন, আপনার শিশু বেশি বেশি করে আপনার স্বরের সাথে পরিচিত হবে।
বাবারা হতাশ হবেন না। মায়ের গলা ছাড়াও গর্ভস্থ শিশু আর যাদের কথা বেশি শুনতে পায় তাদের গলাও চিনে রাখে। মাতৃত্বের তৃতীয় সোপান থেকেই (থার্ড ট্রাইমেস্টার) গবেষকরা দেখিয়েছেন শিশু বিভিন্ন শব্দে বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। মায়ের গলা ছাড়া যে গলা বারবার শুনছে আর একটু অন্যরকম, ভারী তাকে চিনে রাখা তার পক্ষে খুব সোজা।
কৃত্তিকার খুব ইচ্ছে তার সন্তান সঙ্গীতের ভক্ত হোক। তার জন্য তার জিজ্ঞাসা, তাহলে আমি কি প্রায় সময়ই মোজার্ট, বিটোফোন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শুনতে থাকব ? হালে একটা কথা খুব চালু হয়েছে যে এগুলো শুনলে শিশুর বুদ্ধ্যংক (আই.কিউ) খুব ভালো হয়, কিন্তু এটার সপক্ষে খুব ভালো প্রমাণ এখনো নেই। তবে শুনতে বাধা নেই। সঙ্গীত ভক্ত হলেই তো হল !
কৃত্তিকার মতো অতি উৎসাহী মায়েদের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বারবার সাবধান করে দিচ্ছেন এই বলে যে, পেটের ভেতরে থাকা শিশুকে অতি বুদ্ধিমান করে তোলার প্রচেষ্টা যেন একটা ক্লাসরুম তৈরি করে না ফেলে। যেমন শৈশব, তেমনি জন্ম নেবার আগের সময়টাও যেন তার আনন্দময় হয়। নইলে ভালো হবার চাইতে খারাপও হতে পারে। কারণ তাতে গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক নিদ্রার ব্যাঘাত হয়ে বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।
গবেষকরা আরও বলেছেন হালকা চালে সঙ্গীত মূর্ছনা ঘরের ভেতর চালিয়ে রাখলে ক্ষতি নেই, আওয়াজ তীব্র করারও কোনো দরকার নেই। এই গান-বাজনা বা মা-বাবা কথা বলার মধ্যে কেমব্রিজ বা হাভার্ড যাবার স্কলারশিপের গ্যারান্টি না থাকলেও একটা গ্যারান্টি আছে, সেটা হল গর্ভস্থ শিশুর সাথে মা-বাবার আত্মীয়তা এবং মা-বাবার গলার শব্দের সাথে তার পরিচিত হওয়া।
হবু মায়েরা ভুলো না যেন; স্পর্শেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। ‘এই দুষ্টু সোনাটা কি করছিস’ বলে আস্তে পেটে টোকা মারলেও শিশুর চেতনায় সেটা যায় এবং মায়ের সাথে আত্মীয়তা বাড়ে।
সুতরাং সেলফ থেকে ঝেড়েঝুড়ে গীতাঞ্জলি, গীতবিতান, সেক্সস্পিয়ার বেরোক, ইচ্ছে করলে এগুলো পড়ে শোনাও। বিদ্যাদিগগজ বা ধনুর্বীর হবার জন্য নয়, শুধু আরো আরো কাছাকাছি হবার জন্যেও।
কৃত্তিকা শুধু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নয়, আধুনিক ব্যান্ডের গানও ভালোবাসে। বর টিকিট নিয়ে এসেছে। কিন্তু ভয়, যদি শিশুর ক্ষতি হয় এত চড়া আওয়াজ শুনলে। গবেষকরা অভয় দিচ্ছেন, সাত বা আট মাসে গর্ভস্থ শিশুর কান প্ৰায় পুরোমাত্রায় তৈরি হয়ে গেলেও তার অন্তঃকর্ণ এবং মধ্যকর্ণ এমপ্লিফায়ারের কাজ করতে পারে না, কাজেই শব্দ অত উচ্চ তরঙ্গে তার কানে পৌঁছবেই না ।
তবে হ্যাঁ, যদি এমন জায়গায় কাজ করেন যেখানে প্রচন্ড আওয়াজ (৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল), সেখানে আট ঘণ্টা টানা কাজ করার সময় তার আওয়াজ বাচ্চার কানের ক্ষতি করার একটা ভয় জাগিয়ে তুলতেই পারে ।
তাই হবু মায়েদের কাছে সতর্কবার্তা, ব্যান্ডের গান সোনার টিকিট বাতিল করার প্রয়োজন নেই। তবে পেছন দিকে বসো বা যদি বাইরের লনে – চেয়ার থাকে তাতে আরাম করে বসো, গান শোনো। আর তোমার নিজের কানেরও তো ভয় আছে নাকি, অত উচ্চগ্রামে অনেকক্ষণ গান শুনলে!
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা ক্ল্যাসিকাল মিউজিক শুনলে শিশুর বুদ্ধ্যংক বাড়বে, এই ধারণা প্রথম চালু করেন ১৯৯০-র প্রথম ভাগে একজন ফরাসি গবেষক (ডাঃ আলফ্রেড টমাটিস) যেটা ‘মোজার্ট এফেক্ট‘ নামে বিখ্যাত। তিনি বলেছিলেন মগজের বৃদ্ধি হতে নাকি এই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সাহায্য করে। কিন্তু পরবর্তী কালে বৈজ্ঞানিকরা এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাননি। বরং পত্রপত্রিকা এবং নানান গেজেট প্রচুর প্রচুর বিক্রি হয়েছে এই ধারণাকে অবলম্বন করে। শুধু ব্যবসায়ীদের লাভ বাড়িয়ে।
সুতরাং ‘সর্বম অত্যন্তম গর্হিতম’। অতি বাড়াবাড়ি কোনো সময়ই ভালো নয়। কিন্তু গর্ভে তার নিজের মতো করেই শিশু বড় হয়ে উঠুক, মা তাকে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে নিজে আনন্দ পান আর শিশু মুগ্ধ থাকুক মায়ের গলার সাথে পরিচিত হয়ে।